Foodie Jagannath | ভোজনরসিক জগন্নাথ | New Article 2023

Sharing Is Caring:
Foodie Jagannath

ভোজনরসিক জগন্নাথ – অভিজিৎ পাল [Foodie Jagannath]

ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের পঞ্চাঙ্গ ধর্মশাখার মধ্যে বৈষ্ণব ধর্ম বোধ হয় সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়। বৈষ্ণবগণের বিষ্ণু উপাসনা শুধুমাত্র কয়েকটি প্রাচীন নিয়ম নিষ্ঠার বেড়াজালে সীমাবদ্ধ নয়, তা যেন জীবনের জয়গান গায়, জীবনকে প্রতিনিয়ত উদ্‌যাপন করে — celebration of life — সাধনার মধ্যে দিয়ে জীবনের আনন্দ উদ্‌যাপন করেই তাঁরা কাঙ্ক্ষিত দেবতার প্রত্যক্ষ সাহচর্যে আমোদিত হন। ঈশ্বরের সঙ্গে দূরত্ব রাখা নয়, বরং সম্পূর্ণ সহাবস্থান বৈষ্ণবদের সাধনার অঙ্গ। তিনি (ঈশ্বর) বড় বেশি রকমের ঘরের লোক তাঁদের কাছে, ঈশ্বরের প্রতি পরিপূর্ণ আপনার বোধ রয়েছে। এই জন্যই তাঁদের দেবতা সাধারণ মানুষের মতোই ভোরে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে শয্যায় যাওয়া পর্যন্ত রঙিন দিন কাটান। পর্বে পর্বে আনন্দোৎসব করেন। জীবনের জয়গানে ভক্ত ও ভগবান এক হয়ে যান। রঙিন জীবনশৈলী বৈষ্ণব ধর্মের প্রসারে সহায়তা করেছে। প্রাচীন ভারতীয় সনাতনী বৈষ্ণবগণ মনে করেন তাঁদের আরাধ্য দেবতা শ্রীবিষ্ণু প্রতিদিন স্বর্গলোক থেকে পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং ভগবান বিষ্ণু দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরমে স্নান করেন, পূর্ব ভারতের শ্রীক্ষেত্রধামে তিনি ভোজন করেন, পশ্চিম ভারতের দ্বারকাধাম শৃঙ্গার ও শাসন করেন, উত্তর ভারতের বদ্রীধামে বিশ্রাম ও ধ্যান করেন। এই দৃষ্টিকোণে শ্রীক্ষেত্র পুরীধাম ভোজনরসিক শ্রীবিষ্ণুর ভোজন উৎসবের পীঠভূমি। মনে করা হয়, স্বয়ং দেবগণ শ্রীবিষ্ণুর যে মহাপ্রসাদের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন, সেই মহার্ঘ মহাপ্রসাদ পৃথিবীতে শুধুমাত্র এই স্থানেই এত অনায়াসে পাওয়া যায়। এই মহাপ্রসাদে আদ্বিজচণ্ডাল সকলের সমান অধিকার, এমনকি ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী একাদশী তিথিতেও মহাপ্রসাদ গ্রহণ করা হলে তা দোষমুক্ত, বিধবাগণও এর অধিকারী। স্কন্দপুরাণের বিষ্ণুখণ্ডের পুরুষোত্তমমাহাত্ম্য অংশে এর সাক্ষ্য রয়েছে। যে সময়ে ভারতের বুকে বিধবার নিত্যকার আহারের জন্য বরাদ্দ থাকত সিদ্ধ সবজি আর আতপ চাল, তখনও শ্রীজগন্নাথের রকমারী আহার্যে বিধবাদের সম্পূর্ণ অধিকার ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে শ্রীজগন্নাথের ভোগ শুধুমাত্র শ্রীজগন্নাথের আহারের পরেই তা মহাপ্রসাদে পরিণত হয় না, প্রথমে শ্রীজগন্নাথ ভোগ গ্রহণ করেন, তারপর সেই নিবেদিত ভোগরাগ সর্বপ্রথমে দেবী শ্রীবিমলা প্রসাদরূপে গ্রহণ করেন, শ্রীবিমলা দেবীর স্পর্শ পেলে তবেই শ্রীজগন্নাথের প্রসাদ মহাপ্রসাদে রূপান্তরিত হয়। আরও চমৎকার একটি বিষয়, বৈষ্ণব ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী শ্রীজগন্নাথের মহাপ্রসাদ কখনও উচ্ছিষ্ট হয় না। এটি অদ্ভুত রীতিটি প্রচলিত ভারতীয় ভোগসংস্কৃতির সঙ্গে সংযুক্ত উচ্ছিষ্টের ধারণা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, ব্যতিক্রমীও। শ্রীজগন্নাথের মহাপ্রসাদের মধ্যে রান্না করা চাল আবার শুকিয়ে নিয়ে তা দীর্ঘস্থায়ী করে রাখা হয়। বহু মানুষ এই শুকনো ভাতরূপী মহাপ্রসাদ নিত্য এক দানা করে গ্রহণ করেন। উনিশ শতকের যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনেও এই দৃশ্যটি দেখা গেছে। তিনি শ্রীজগন্নাথের শুকিয়ে রাখা মহাপ্রসাদের সামান্য একটু প্রত্যেকদিন সকালে মুখে দিতেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে। এই দৃশ্য শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-এ প্রামাণিক দলিল হয়ে রয়েছে। শ্রীজগন্নাথের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে যুক্ত এই শুকনো মহাপ্রসাদের বিষয়টি অন্যান্য হিন্দু প্রাচীন মন্দিরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। রান্না করা ভোগের পুনরায় শুকিয়ে তা গ্রহণ করার রীতি সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে সামান্যই দেখা যায়।

শ্রীজগন্নাথ মহাপ্রভু উৎকলের রাজা। উৎকলে প্রজাতন্ত্র বা রাজতন্ত্র যাই থাকুক না কেন, এখানে যুগ যুগ ধরে রাজা একজনই। এবং সেই রাজা শুধু উৎকলের নয়, সমস্ত জগতের নাথ, জগতের রাজা — Lord of the Universe — শ্রীজগন্নাথ। তিনি রাজা, তাঁর খাদ্যাভ্যাসও রাজকীয়, নিত্যদিন তাঁর ভোগতালিকায় থাকে ছাপ্পান্ন ভোগ। অবশ্য প্রথাগত শব্দে ছাপ্পান্ন ভোগ বলা হলেও ভোগতালিকায় পদের সংখ্যা একশো পার হয়ে যায় অনায়াসে। জগন্নাথ, জগন্নাথসংস্কৃতি ও জগন্নাথসাহিত্য মূলত ওড়িশা প্রদেশে ধ্রুপদী মাহাত্ম্য লাভ করেছে। ওড়িশার ঠিক পরেই জগন্নাথসংস্কৃতি ও জগন্নাথসাহিত্যে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, তৃতীয় স্থানে রয়েছে মণিপুর রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গে জগন্নাথসংস্কৃতির প্রসারের প্রধান কারণ চৈতন্য মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর কর্মকাণ্ড, এবং মণিপুরে রয়েছে চৈতন্যদেবের পার্ষদ অদ্বৈত মহাপ্রভুর প্রভাব। এই তিন যুগপুরুষের হাত দিয়েই বাঙালির ঘরে শ্রীজগন্নাথের বিশাল একটি আসন তৈরি হয়েছে। বঙ্গের বহু পরিবারে প্রধান দেবতা শ্রীজগন্নাথ। শ্রীজগন্নাথের প্রসাদই বহু পরিবারের প্রধান ভোগ। শ্রীজগন্নাথ যা গ্রহণ করেন না, এই সমস্ত পরিবারে তেমন ভোগ একেবারেই ভুলেও প্রবেশাধিকার পায় না। শ্রীজগন্নাথের সংস্কৃতির সঙ্গে, এই সমস্ত পরিবারে প্রচলিত রয়েছে শ্রীজগন্নাথের ভোগসংস্কৃতি। সংস্কৃতি শব্দটির মধ্যে সংস্কার শব্দটি বিদ্যমান। অনেককিছু গ্রহণ ও বর্জনের মধ্যে দিয়ে এই সংস্কার তৈরি হয়। পারিবারিক সংস্কার, সামাজিক সংস্কার, আঞ্চলিক সংস্কার ও ধর্মীয় সংস্কার প্রভৃতির সমন্বয়ে একটি জীবন্ত জাতির খাদ্যাভ্যাসের সংস্কার গড়ে ওঠে। এখান থেকেই জন্ম নেয় সেই জাতির খাদ্যাভ্যাসের সংস্কৃতি, আরও একটু সংক্ষিপ্ত করে বললে ভোগসংস্কৃতি। মহাপুরুষ শ্রীজগন্নাথকে ঘিরেও তাই গড়ে উঠেছে ভোগসংস্কৃতির এক চমৎকার ঘরাণা‌। শ্রীজগন্নাথের পূজাপীঠের সূত্রেই উৎকল ও বঙ্গের বহু শ্রীজগন্নাথ সম্পৃক্ত পরিবারেও এই ভোগসংস্কৃতি বিদ্যমান।

আনুমানিক ১৩০০ বছর আগে আচার্য আদি শঙ্করের মধ্যস্থতায় শ্রীক্ষেত্রে শ্রীজগন্নাথের বিগ্রহের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়, বর্তমান চিল্কা হ্রদের কাছাকাছি স্থানে পূর্বদিকে একটি প্রাচীন বটবৃক্ষের (মতভেদে অশ্বত্থ) তলা থেকে শ্রীজগন্নাথের প্রাচীন সম্পদ পরিপূর্ণ রত্নভাণ্ডার উদ্ধার হয়। এর পূর্বে অহিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বারা শ্রীক্ষেত্র আক্রান্ত হলে তৎকালীন পূজারীগণ শ্রীজগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহ সরিয়ে রাখেন ও শালগ্রাম শিলার ওপর নিত্যকার পূজা চালিয়ে যান। উৎকলখণ্ডে রয়েছে শ্রীজগন্নাথের দারুময় বিগ্রহের চেয়ে রত্নবেদীই প্রকৃত সিদ্ধপীঠ। শ্রীজগন্নাথদেব রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে বলেছিলেন, ইন্দ্রদ্যুম্নর বানানো মন্দির ভূমিতে মিলিয়ে গেলেও শ্রীজগন্নাথ কোনোদিনও রত্নবেদী ত্যাগ করবেন না। কথিত আদি শঙ্করাচার্য পুরীতে রত্নবেদীর চারপাশে এক লক্ষ শালগ্রাম শিলা বপন করেছিলেন। এই দর্শন শ্রীসারদা দেবীরও পুরীক্ষেত্রে পুরুষসিংহ শ্রীজগন্নাথের দর্শনের সময়ে ঘটেছিল। আদি শঙ্করাচার্যের পুরীতে আগমনের বহু আগে অহিন্দু লুটেরাদের ভয়ে পুরীর মন্দিরের বহুমূল্য রত্নভাণ্ডার লুকিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন পূজারীরা। প্রজন্মান্তরে বহুকাল ব্যয় হওয়ায় প্রাচীন বিগ্রহ ও রত্নভাণ্ডারের স্মৃতিও লুপ্ত হয়। আদি শঙ্করের প্রচেষ্টায় পুরীক্ষেত্র তার হারানো শ্রী ফিরে পায় ও শ্রীজগন্নাথের পূজা পুনরায় আয়োজনপূর্ণ সমারোহে চালু হয়। ভোগ-রাগাদির জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল ব্যয় মন্দিরের রত্নভাণ্ডারের থেকেই চলতে থাকে। পুরীর মন্দিরের রত্নবেদীতে শ্রীজগন্নাথের বিগ্রহের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ভোগ নিবেদনের সময়ে স্বয়ং আদি শঙ্করাচার্য তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। প্রায় এই সময়েই শঙ্করাচার্য পুরীধামে গোবর্ধন মঠের স্থাপনা করেন। আচার্য শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত এই প্রাচীন মঠটি এখনও রয়েছে। অর্থাৎ শ্রীজগন্নাথদেবকে ঘিরে এই বৈচিত্র্যময়‌ ভোগসংস্কৃতির কর্মসূচি আনুমানিক প্রায় ১৩০০ বছরের প্রাচীন। বর্তমানে শ্রীজগন্নাথের ভোগের আয়োজিত করে শ্রীজগন্নাথের নিত্য আগত অজস্র ভক্ত, শ্রীক্ষেত্রের মন্দির কর্তৃপক্ষ, পুরীর বিভিন্ন মঠ, পুরীর গজপতি মহারাজের পরিবার থেকেও ব্যয় করা হয়। পূর্ববর্তী সময়ে পুরীর মন্দির ভিন্ন সম্প্রদায়ের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার জন্যই পরবর্তী সময়ে মন্দিরের ভেতরে অহিন্দু সম্প্রদায়ের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চৈতন্য পরবর্তী সময়ে আনুমানিক ১৫৬৮ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ কালাপাহাড়ের মতো উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক শ্রীজগন্নাথ বিগ্রহের চরম ক্ষতি করে। এত বড় ক্ষতির পরে জনৈক বিসর মহান্তি শ্রীজগন্নাথের ব্রহ্মবস্তু সংগ্রহ করে যত্ন করতে থাকেন। পরে শ্রীজগন্নাথের দারুময় নবকলেবর তৈরি করা হলে পুনরায় ব্রহ্মবস্তু আবার তাঁর মধ্যে স্থাপন করা হয়। এরপর থেকে নবকলেবর উৎসব চালু হয় পুরীতে। আর পূর্ববর্তী ভয়ংকর অভিজ্ঞতা ও দেববিগ্রহের অঙ্গে বারবার ক্ষতিকর আক্রমণের ভয়ে ইসলামপন্থীদের জন্য মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। যদিও ভক্তি ও ভক্তদের অনুগত মহাপ্রভু জগন্নাথ নিজে মন্দিরের বাইরে এসে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের পাশাপাশি তাঁর অহিন্দু সম্প্রদায়ের প্রেমিক ভক্তদের সঙ্গেও রথে চেপে দেখা করেন প্রত্যেক বছর নিয়ম মেনে। তিনি নিজে খেতে ভালোবাসেন, আবার ভক্তদের খাওয়াতেও ভালোবাসেন। আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি একাধিক ইসলামী মানুষও শ্রীজগন্নাথের মহাপ্রসাদ যথেষ্ট শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে নিজের অন্তরের শুদ্ধতা কামনা করেন, আত্মশুদ্ধি অনুভব করেন। উৎকলের মুসলমানরাও শ্রীজগন্নাথের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধসম্পন্ন। শ্রীজগন্নাথক্ষেত্রে আমীষের ব্যবহার না থাকলেও দেবী শ্রীবিমলার পঞ্চ-ম-কার পূজাপদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। মদ্য-মাংসের সরাসরি ব্যবহার না করে রূপান্তরিত আমীষের ব্যবহার দেখা যায় ভগবতী বিমলার পূজা। যেমন শাস্ত্রীয় বিধি মতে, কাঁসা পাত্রে ডাবের জল মদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়, তেমনই কিছু রীতি এক্ষেত্রে মান্য করা হয়। তবে শ্রীজগন্নাথদেবের ভোগে মৃত্তিকা নির্মিত পাত্রের ব্যবহার করা হয় সবচেয়ে বেশি এবং ভোগের পাত্রগুলি একবার ব্যবহার করা হয়ে গেলে আর দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা হয় না। পাত্রগুলি আঘাত করে ভেঙে ফেলা হয়। শ্রীজগন্নাথের ভোগসংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত এই বৈশিষ্ট্যটির একটি গভীর সামাজিক তথা পেশামুখী তাৎপর্য রয়েছে। কুম্ভকার সম্প্রদায়ের বৃত্তির প্রসারে শ্রীজগন্নাথের এই অভ্যাসটি অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীজগন্নাথের মহাপ্রসাদের প্রতিটি উপকরণে তুলসীপত্রের ব্যবহার স্মরণ করিয়ে দেয় ঐতিয্যবাহী বৈষ্ণব সংস্কৃতিকে।
শ্রীজগন্নাথ মহাপ্রভুর নিত্যদিনের রুটিন অনুযায়ী প্রতিদিন সকাল আটটায় তাঁকে দেওয়া হয় বাল্যভোগ (বল্লভভোগ), এরপর বেলা বাড়লে সকাল দশটায় রাজভোগ (সকালধূপভোগ), আরও দুই ঘণ্টা পর বেলা বারোটায় বসে ছত্রভোগ, তিনি দুপুরের আহার অর্থাৎ মধ্যাহ্নভোগ (দ্বিপ্রহরধূপ) করতে বসেন বেলা দুটোয়, এরপর বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যারতির পরেই ঠিক সন্ধ্যাকালে তাঁর সান্ধ্যভোগের (সন্ধ্যাধূপ) আয়োজন করা হয়, সান্ধ্য শৃঙ্গারের পর তিনি চমৎকারভাবে সেজে বা বড় শৃঙ্গার করে বড়শৃঙ্গারভোগ (বড়শৃঙ্গারধূপ) গ্রহণ করতে বসেন, রাতে শয়নকালে তিনি শয়নকালীন ভোগ (পহুড়) গ্রহণ করেন। প্রতিটি ভোগ গ্রহণের আগে বা পরে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলভদ্রের বস্ত্র পরিবর্তন করা হয়, নতুন করে শৃঙ্গার করানো হয়। এতগুলি সময়ের ভোগের মধ্যে দ্বিপ্রহর ধূপ আয়োজনের দিকে থেকে সবথেকে বড় ও পহুড় সবচেয়ে ছোট। এছাড়াও বিভিন্ন ঋতুতে শ্রীজগন্নাথের ফরমাশে দেওয়া হয় বরাতি ভোগ, রথযাত্রার সময়ে দাণ্ডপন্তিভোগ, রথযাত্রার দিন রথোপরি ভোগ, রথের পুনর্যাত্রার দিনে অধরপনা ভোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে। অধরপনার বিরাট বিরাট হাঁড়িগুলি ভেঙে প্রসাদ বিতরণের দৃশ্যটি দেখার মতো। আবার রামনবমী ও কৃষ্ণজন্মাষ্টমীর আগে শ্রীজগন্নাথকে নিবেদন করা হয় জেউড় ভোগ। উৎকল প্রদেশে জেউড় ফল খাওয়ানো হয় আসন্নপ্রসবা নারীকে প্রসব স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। রামচন্দ্র ও কৃষ্ণকে উৎকলবাসী স্বয়ং জগন্নাথদেবের সঙ্গে অভেদ দর্শন করেন, তাই জেউড় তাঁকেও অর্পণ করা হয়। সমগ্র পূর্ব ভারতে শ্রীজগন্নাথ যথেষ্ট প্রভাবশালী দেবতা, বাংলার মঙ্গলকাব্য ও মহাকাব্যে দিকবন্দনায় শ্রীজগন্নাথের বন্দনা পাওয়া যায়। বিশেষত বঙ্গের জনগণের ওড়িশায় শ্রীক্ষেত্র দর্শনের রীতিটি সুপ্রাচীন। বাংলার তীর্থমঙ্গলে শ্রীক্ষেত্রের উল্লেখ না থাকলেও বহু প্রাচীন সাহিত্যে শ্রীক্ষেত্রের উল্লেখ থেকে বোঝা যায় বাঙালির কাছে শ্রীজগন্নাথ অপরিচিত দেবতা নন, শ্রীজগন্নাথের দিব্য মহাপ্রসাদও প্রাচীন বাঙালির অনাস্বাদিত নয়। বরং তা বাঙালির প্রাণের আরামের, মনের আধ্যাত্মিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান কারণও।

বিরাট ব্রহ্মপুরুষ শ্রীজগন্নাথের ভোগের সময় যেমন বিচিত্র, ভোগের তালিকাও তেমন বৃহৎ। এই তালিকায় রয়েছে — অটকালি, অটখিচুড়ি, অতরছমণ্ডা, অন্ন, অরখফুল, অমালু, আলুকদলী, অমৃত রসাবলী, আরিষা, এণ্ডুরী, কঅঁলপুলি, কণিকা, কদল বড়া, কর্মাবাই খিচুড়ি, কড়ম্বা, কাকরা, কাকাতুয়াঝিনি, কাঞ্জী, খইরচুর, খটেই, খণ্ডমণ্ডা, খজা, খলিরুটি, খড়িকামরা, খিরিষা, খুরমা, খেচরান্ন, খোয়ামণ্ডা, গজা, গুড়াখিরিষা, ঘষাজল, ঘি মাখানো ভাত, ঘৃত, চউতাপুরী, চন্দ্রকান্তি, চড়েইনদা, চিতউপিঠা, চুঁচিপত্র, চুলিয়াচুপড়া, ছানাচকটা, ছানাপিঠা, ছানা মাণ্ডুয়, জগন্নাথবল্লভ, জগন্নাথভোগ আম, জেনামণি, টভা পখাল, ডাবের জল, ডালিম্ব-দন্তভাঙ্গা, তিতো, তিপুরী, দই, দইকড়ি, দধি পখাল, ধনুশ্বরণ, ননি, নড়িয়াখুদি, নারকেল লাড্ডু বা নাড়ু, নিমপাতা, নিমকি, নুখুরা খিচুড়ি, নুনখুরমা, নুনফেণী, পণশুয়া, পরমান্ন, পাগ-আরিষা, পারিজাতক, পীতান্ন বা পোলাও, পুড়ি, পোড়াপিঠা, ফড়ি শুকতো, ফেণা, ফেণামণ্ডা, বগড়া অন্ন, বল্লভ, বল্লভকোরা, বলিবামন, বড়খিরিয়া, বড়ঝিলি, বড়নাড়ী, বড়পুরি, বড়া, বুঁদিয়াখিরি, বেসর, ভজা, ভাজাভুজি, মগজনাড়ু, মরিচজল, মরিচ লাড্ডু, মহাদেঈ, মহুর, মাখন, মাঠপুলি, মাণ্ডুয়, মালপোয়া, মিঠাই, মেনঢাশিঙ্গিয়া, মোহনভোগ, রহনি, রাঈতা, রাধাবল্লভী, লবণ, লক্ষ্মীবিলাস, শাক, শাকর, শান্তুলা, শেউ, শ্রীহস্তকোরা, সর, সরকাকরা, সরকুম্পা, সরপণা, সরমণ্ডা, সরপাপুড়ি, সরভাজা, সরু অন্ন, সরুচকুলি, সাতপুরি বা সপ্তস্তরীপুরি, সানঝিলি, সাননাড়ী, সুয়ারি, সেবতিঝিলি, সোনাথালি খিচুড়ি, হংসকেলি, হংসবল্লভ, ক্ষীর আরও কত শত রকমারি ভোগ। ওড়িআ‌ সাহিত্যের পাশাপাশি এই দীর্ঘ ভোগের তালিকা বাঙালি কবি বিশ্বম্ভর দাসের ‘জগন্নাথমঙ্গল’-এ পাওয়া যায়। এছাড়াও রয়েছে কবি রাধামাধব ঘোষের ‘জগন্নাথলীলা সারাবলী’তে। ঐতিহ্যবাহী উপকরণগুলি দিয়েই শ্রীজগন্নাথের ভোগ তৈরি করা হয়। শ্রীজগন্নাথের খাদ্যাভ্যাসের সঠিক চর্চা করা হলে সমগ্র পূর্ব ভারতের বা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় প্রাচীন খাদ্যাভ্যাসের সঠিক চর্চা সম্ভব। তবে কিছু উপকরণ জগন্নাথদেবের ভোগতালিকায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ যেমন সিদ্ধ চাল, গোল আলু, বিলিতি টমেটো, পেঁয়াজ, সাদা লবণ, কলে পেশা আটা ও ময়দা, রসুন, পেঁয়াজ, ঢেঁড়স, কলে তৈরি করা চিনি, কয়েকটি ধরনের ডাঁটা, বিনস্, লাউ, কপি, পুঁই শাক, উচ্ছে, সজনে, বিলিতি লঙ্কা, ঝুড়ঙ্গ, কয়েকটি ড্রাই ফ্রুট ও সমস্ত রকমের মাছ-মাংস-ডিম সহ আমীষ ভোগ। প্রকৃতপক্ষে যে সমস্ত সবজি বর্হিভারত থেকে এনে এই দেশে চাষ করা শুরু হয়েছিল সেই সমস্ত সবজিই বর্জন করা হয়। এই সমস্ত নিষিদ্ধ দ্রব্যের মধ্যে কোনো একটি যদি ভুল করেও মহাপ্রভু জগন্নাথদেবের ভোগের মধ্যে পাওয়া যায় তবে সেদিনের জন্য আনা সমস্ত দ্রব্য শ্রীজগন্নাথের ভোগতালিকা থেকে সঙ্গে সঙ্গে বাদ দিয়ে আবার নতুন করে সমস্ত আয়োজন করা হয়। সম্পূর্ণ রান্নাঘর পরিশুদ্ধ করা হয়ে গেলে, আবার নতুন করে রান্নার পর তবে শ্রীজগন্নাথের ভোগ ওঠে। এই বিষয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সতর্ক থাকেন শ্রীজগন্নাথের সেবকরা। ‌লক্ষ্মীবাজার থেকে আনাজপাতি সংগ্রহ করার সময় জগন্নাথের সেবকরা, লক্ষ্মীবাজারের বিক্রেতারা, লক্ষ্মীবাজারে সবজি পৌঁছে দিতে আসা চাষীরা এই বিষয়টি সবসময় খেয়াল করেন। জগন্নাথের সেবাসূত্রে এরা একই সুতোয় গাঁথা মালা। শ্রীজগন্নাথের রান্নাঘরের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণই সংগ্রহ করা হয় নিকটবর্তী লক্ষ্মীবাজার থেকে। মন্দিরের নিকটস্থ এই লক্ষ্মীবাজার পুরীর শ্রীজগন্নাথদেবের প্রকারান্তরে সবজি ভাণ্ডার। লক্ষ্মীবাজার পুরীর অন্যতম প্রাচীন ব্যবসার ক্ষেত্র, বাজারটি প্রায় ১০০০ বছরের বেশি সময়ের প্রাচীন, এমনটি দাবি করেছেন পুরীর মন্দিরের প্রধান রন্ধনশিল্পী তথা আহার-সেবক Samanth Rai ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে। লক্ষ্মীবাজারের সবজি আশেপাশের ক্ষেত থেকেই সরাসরি এখানে আসে। ওড়িশার কৃষক শ্রেণির অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে লক্ষ্মীবাজার একটি বড় ভূমিকা পালন করে এখনও। বিচিত্র এই দেবতার মতোই তাঁর রান্নাঘরেও বৈচিত্র্যের অভাব নেই কোনো। হাজার হাজার মানুষের অন্নপূর্তি ঘটে যায় শ্রীজগন্নাথের মহাপ্রসাদে। ১৫০ ফুট লম্বা ও ১০০ ফুট চওড়া শ্রীজগন্নাথের রান্নাঘরে প্রায় ৬০০ জন রন্ধনশিল্পী সেবক শ্রীজগন্নাথের বিপুল তথা বৈচিত্র্যময় ভোগ তৈরি করেন। আনুমানিক প্রায় হাজার, বারো শো পাত্রে তৈরি করা হয় শ্রীজগন্নাথের মহাপ্রসাদ। আধুনিক কোনো চুল্লির ব্যবহার এক্ষেত্রে করা হয় না, আরও অদ্ভুত কথা এক্ষেত্রেও শ্রীক্ষেত্রের একটি চমৎকারিত্ব রয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন ফুট উঁচু চুল্লি বা উনানের ওপর গড়ে নয় থেকে বারোটি পাত্রে একসঙ্গে রান্না করা হয়। বলাবাহুল্য প্রাচীন পূর্ব ভারতীয় রন্ধনশিল্পীদের ভোগশিল্পের এখানেও একটি রহস্য রয়েছে, নয় থেকে বারোটি পাত্রের মধ্যে সবচেয়ে ঊর্ধ্বতন পাত্রটির রান্না সবার আগে শেষ হয়, ক্রমে নিচের পাত্রগুলি। পুরীর দেবতার মহাপ্রসাদ দেবদুর্লভ, তাই এর কণামাত্র পাওয়ার জন্য মানুষের আর্তি থাকে আজও। ভক্তি ও বিশ্বাসের সঙ্গে এখানে আরও একটি জিনিস মিশে থাকে, সেটি অবশ্যই জাগতিক, তা হলো শ্রীজগন্নাথের মহাপ্রসাদের অপূর্ব স্বাদ। মহাপ্রসাদের এই ঐতিহ্যবাহী স্বাদের কোনোদিন পরিবর্তন ঘটে না, এটিও শ্রীজগন্নাথ মাহাত্ম্যের বিশেষ দিক হিসেবেই দেখা যায়। এতজনের পেট ভরিয়ে দেওয়ার মতো রান্না যা কিনা প্রায় ছয়শো রন্ধনশিল্পী মিশে তৈরি করে এক ফোঁটাও আগে থেকে এক ফোঁটাও না চেখে দেখে, তা শতাব্দীর পর শতাব্দী এক ও অভিন্ন স্বাদ কীভাবে বজায় রাখতে পারে সেটিও যথেষ্ট আশ্চর্যের বিষয়। ‘জগন্নাথমঙ্গল’-এ পাওয়া যায় স্বয়ং দেবী লক্ষ্মী ও সরস্বতী এই ভোগ তৈরির কাজে অলক্ষ্যে নিযুক্ত থাকেন, তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে থাকেন দেবী গঙ্গাও যাতে অশুদ্ধি প্রবেশাধিকার না পায়। বৈষ্ণবগণ মনে করেন দেবতা যা গ্রহণ করতে চান না, ভক্তও তা গ্রহণ করতে পারেন না। ভক্ত ও ভগবানের রসও এক, আবার তাদের রসনা এক। আসলে বৈষ্ণব ভক্ত যা ভালোবাসেন, তা-ই তিনি ভগবানকে নিবেদন করে তৃপ্তি পান।

মহাপুরুষ শ্রীজগন্নাথের এই সুবিশাল ভোগতালিকায় এমন বহু উপাদেয় সামগ্রী রয়েছে যেগুলি প্রাচীন ভারতের ভোগসংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দেয়। এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত এমন বহু ভোগ রয়েছে যেগুলি বঙ্গদেশ সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ভিন্ন নামে পরিচিত। এবং এর বিশেষত্ব বেড়ে যায় আরেকটি কারণে এর সবগুলিই সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ ভারতীয় ভোগ। ভারতীয় রন্ধনশিল্পীগণ যে নিরামীষ খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে এত চমৎকারিত্ব আনা যায়। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রান্নাঘরগুলি যে রীতিমতো নারীদের রন্ধনশিল্পের গবেষণাগার ছিল, তার প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রীজগন্নাথের রান্নাঘর স্বাভিমান বহন করে। ভোগসংস্কৃতির অন্যতম দিক ভোগের মান ও খাদ্যাভ্যাসের উৎকর্ষতা সাধন। পূর্ব ভারতে শ্রীজগন্নাথের সূত্রে ভোগ সংস্কৃতির বৈচিত্র্য শ্রীক্ষেত্রই একা অনেকটা বৃদ্ধি করতে পেরেছে। তাছাড়া ভারতের খাদ্যাভ্যাসের মানচিত্রে নিরামীষভোজী মানুষের সংখ্যা এখনও যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়। আমীষের মধ্যে মাছের ব্যবহার মূলত গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলেই সুপ্রাচীন সময় থেকে চলছে, মুরগীর মাংস ও ডিম আনুমানিক উনিশ শতকের শেষভাগে ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে এসে বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে জায়গা করতে পেরেছে। কিন্তু এখনও এই একুশ শতকেও মূলত পক্ষে চৈতন্য প্লাবিত বঙ্গের গৌড়ীয় তথা বঙ্গীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে নিয়মিত নিরামীষ খাদ্যাভ্যাসের রীতি রয়েছে। আজকাল সমাজের সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসের বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেলেও বৈষ্ণবদের পরম উপাস্য শ্রীজগন্নাথের ভোগতালিকায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর কোনো পরিবর্তন হয়নি বলেই শ্রীজগন্নাথ দেবের এই চমৎকার সব ভোগগুলি ভারতীয়দের জীবন থেকে এখনও হারিয়ে যায়নি। বহু বৈষ্ণব পাটবাড়িতে বিশেষ পর্বদিনে এমন আয়োজন এখনও ঘটতে দেখেছি। নদীয়ার ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরেও জামাইষষ্ঠীর তিথিতে এমন ঐতিহ্যবাহী ভোগ তৈরি করা হয়, যদিও এই মন্দিরের ভোগে বর্তমানে নতুন সময়ের নিরামীষ ভোগও তৈরি করা হয়। শ্রীজগন্নাথের রন্ধনসেবক ও সাধারণ গৃহস্থদের দেব নির্ভর পরিবারগুলিতে দেখা যায় দেবতার ভোগ রান্নার দায়িত্ব তারা পুরুষানুক্রমে বহন করেন। পুরী ধামের মহাপ্রভু জগন্নাথের রসনার প্রতিটি সামগ্রী মন্দিরের রন্ধনসেবকগণ পুরুষানুক্রমে তৈরি করে চলেছেন। রন্ধনশিল্পীদের এক পিঁড়ি থেকে আরেক পিঁড়ি পর্যন্ত এই রন্ধনশিল্প নিয়মিত চলেছে। শ্রীজগন্নাথের ভোগতালিকা ও মহাপ্রসাদের অলৌকিক স্বাদ তাই রয়েছে সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত। প্রাচীন ভারতের ভোগসংস্কৃতির অপরিবর্তিত, প্রামাণিক ও জীবন্ত দলিল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রীজগন্নাথের রান্নাঘর। প্রযুক্তির কলাকৌশল পর্যন্ত প্রবেশাধিকার পায়নি শ্রীজগন্নাথের রন্ধনকক্ষে।

শ্রীজগন্নাথের ভোগের প্রস্তুত প্রণালী বড় চমৎকার। এর মধ্যে কয়েকটি সরল ও আবার কয়েকটি যথেষ্ট জটিল, সময়সাপেক্ষ। যেমন — সরপাপড়ি তৈরি করা হয় গরুর খাঁটি দুধ ফুটিয়ে ফেনিয়ে। উনানে গনগনে আগুনে প্রথমে দুধ ভালোভাবে ফুটিয়ে নিয়ে নামিয়ে ঠান্ডা করে নেওয়া হয়। পরপর এভাবে তিনবার দুধের ঘন সর তুলে নিয়ে, তা ভোগ দেওয়া হয়। আবার বল্লভ তৈরির প্রণালী আরও চমৎকার। গাওয়া ঘি দিয়ে সাদা খই হাল্কা আঁচে ভেজে নেওয়া হয়। পাতলা পাতলা সরু করে নারকেল কাটা দিয়ে গুড় জ্বাল দিয়ে সেই গুড়ে আগের ভেজে নেওয়া খই মেশানো হয়। পাক দেওয়া নারকেল কাটা, খই, গুড়ের এই মিশ্রণটি আঁচ থেকে নামানোর পর তার মধ্যে মেশানো হয় লবঙ্গ আর বড় এলাচের গুঁড়া, খাওয়ার কর্পূর, গোলমরিচ। এভাবে তৈরি হয় বল্লভ, এটি মহাপ্রভু জগন্নাথদেবের সকালের প্রাতঃরাশের মতো ভোগ। আর বল্লভকোরা ভোগটিও এর কাছাকাছি, নারকেল নাড়ুর জন্য যেভাবে বাঙালি ঘরে নারকেল কাঁটা বা কোরা হয় ঠিক সেভাবে নারকেল কেটে সুগন্ধি গুড়ে জ্বাল দিয়ে, পাক দিয়ে নামিয়ে নেওয়া হয়। তারপর সেই মিশ্রণটির সঙ্গে গাওয়া ঘি, লবঙ্গ, গোলমরিচ, বড় এলাচের গুঁড়া, খাওয়ার কর্পূর মিশিয়ে হাল্কা ঠান্ডা হয়ে এলেই হাতে ধরে পাকিয়ে পাকিয়ে গোল বড় নাড়ু বা লাড্ডুর আকার দেওয়া হয়। শ্রীজগন্নাথকে নিবেদিত এই বল্লভকোরা আপামর বাঙালির ঘরের লক্ষ্মীপূজায় ব্যবহৃত গুড়ের নারকেল নাড়ুর মতো কিছুটা দেখতে হলেও স্বাদে এটি অনেকটাই ভিন্ন রকম। শ্রীজগন্নাথের ভোগে বিশুদ্ধ গাওয়া ঘি আর গুড়ের ব্যবহারই বেশি, কারখানার কলে তৈরি চিনি মহাপুরুষ জগন্নাথের ভোগে ব্যবহার করা হয় না। তবে শর্করা মিছরির ব্যবহার রয়েছে। শ্রীক্ষেত্রের মতো অড়হর ডাল বোধ হয় ভারতের আর কোথাও এত সুন্দর হয় না। বঙ্গে অড়হর ডাল খাওয়ার এখন আর তেমন খুব একটা রেওয়াজ না থাকলেও একটা সময় পর্যন্ত বাঙালির ঘরে এই উপকরণটির প্রতিপত্তি ছিল। শ্রীজগন্নাথের ভোগরসনায় মুগের ডালের ব্যবহার হয় বহুভাবে। বহু উপকরণের সঙ্গে ভেজা মুগ, গোটা মুগ, মুগের ডাল বাটা মিশিয়ে নিয়ে অনেক রকমের ভোগ তৈরি করে তা নিবেদন করা হয় শ্রীজগন্নাথের কাছে। শ্রীজগন্নাথের ভোগরসনায় বহু ভোজ্যেই হিং দেওয়া হয় স্বাদ বৃদ্ধির জন্য। আতপ চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি বহুরকম পিঠা তৈরি করা হয়, পুলিপিঠার উৎকৃষ্ট নির্মাণ রয়েছে এখানেও। এই বিশ্বায়নের যুগেও বঙ্গের বাইরে বোধ হয় একমাত্র উৎকল প্রদেশেই দ্বিতীয় এত সুন্দর পিঠা তৈরির রেওয়াজ রয়েছে। দেবতাকে উৎসর্গ করা মিষ্টি দ্রব্যের মধ্যে গজা, খাজা ও ক্ষীর সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। প্রত্যেক বাঙালির কাছেই পুরীর জগন্নাথদেবের গজা ও খাজা প্রসাদ অত্যন্ত পরিচিত আশীর্বাদী ভোগ। ভারতে খিচুড়ি একটি সর্বজন পরিচিত চমৎকার ভোজ্য। পুরীধামে এই খিচুড়িই তৈরি হয় বহু রকমের। পৃথক উপকরণ ব্যবহারের জন্যই এক একটি খিচুড়ির স্বাদ-গন্ধ-বর্ণের পার্থক্য ধরা পড়ে। উপকরণের পার্থক্যে একেক রকম খিচুড়ির একেক রকম নাম রয়েছে। মন্দিরের সামনে সন্ধ্যায় শ্রীজগন্নাথের ঘন সুগন্ধি চালের খিচুড়ি মহাপ্রসাদ লাভ করেন বহু মানুষ। এই প্রাসাদটি পাওয়ার জন্য মানুষের আর্তি ও অপেক্ষা দেখা যায়। এই মহাপ্রসাদের শেষ দানা পর্যন্ত সংগ্রহ করেন মানুষ। প্রত্যেকটি উপকরণ আধুনিক মেশিনের মধ্যে দিয়ে তৈরি না হওয়ায় পাক করা শ্রীজগন্নাথের মহাপ্রসাদের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি খাদ্যগুণ অনেক। পুষ্টিবিজ্ঞানের দিক থেকে দেখলেও এর বিশেষত্ব রয়েছে। এখন ভারতীয় খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু এখানের অভ্যাস অপরিবর্তিত। ভেষজ রং পর্যন্ত এখানে ব্যবহার করা হয় না। ভোজ্য সমূহের খাদ্যগুণ ও পুষ্টি নষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই এখানে।

শ্রীজগন্নাথ মহাপ্রভু বড়ই ভোজনরসিক। তিনি রকমারি খেতে ভালোবাসেন, তাঁর প্রাণপ্রিয় ভক্তদের খাওয়াতে ভালোবাসেন। তাই এত আয়োজন, এত উপকরণের নিত্য ব্যবহার। ভারতীয় ভোজনবৈচিত্রের এক চমৎকার চলমান নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুরীর মহাপুরুষ জগন্নাথদেবের রান্নাঘর ও তাঁর দেবদুর্লভ মহাপ্রসাদ।

অভিজিৎ পাল | Avijit Pal

Bengali Article 2023 | এক নিভৃত কবির উচ্চারণ : সপ্রসঙ্গ কবি দীপক হালদার

Shesh Belay | শেষবেলায় | মনসুর আলি | Best 2023

New Bengali Article 2023 | সংবাদ মাধ্যমের নিরপেক্ষতা

New Bengali Article 2023 | কবিতার অন্তরাত্মা

Foodie Jagannath | Foodie Jagannath Article | New Foodie Jagannath | New Foodie Jagannath 2023 | Foodie Jagannath PDF | Foodie Jagannath video | Foodie Jagannath viral video | Foodie Jagannath wallpaper | Foodie Jagannath trending images | Foodie Jagannath trending articles | Foodie Jagannath trending blog | Foodie Jagannath trending history | old history Foodie Jagannath | pdf Foodie Jagannath | pdf article Foodie Jagannath | new article Foodie Jagannath | new video Foodie Jagannath | documentary film Foodie Jagannath | Foodie Jagannath document | Foodie Jagannath whatsapp status | new film Foodie Jagannath | trending film Foodie Jagannath | know about Foodie Jagannath | new photo Foodie Jagannath | Foodie Jagannath real story | Foodie Jagannath web story | Foodie Jagannath video song | old history pdf Foodie Jagannath | Shabdodweep Founder | Shabdodweep Web Magazine

Leave a Comment