Doob De Re Mon Kali Bole | ডুব দে রে মন কালী বলে | অভিজিৎ পাল | New 2023

Sharing Is Caring:
Doob De Re Mon Kali Bole

ডুব দে রে মন কালী বলে – অভিজিৎ পাল [Doob De Re Mon Kali Bole]

হিন্দুদের শাস্ত্রভাণ্ডারের মধ্যে বিশেষ করে শ্রীমৎ-দেবীভাগবতপুরাণ ও শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে যখনই পৃথিবীতে ও অমৃতলোকে অহিতকারী কোনো পাশবিক শক্তির উত্থান হয়েছে, তখনই বিশ্বপ্রসবিনী আদ্যাশক্তি মহামায়া দেবী নানা রূপ পরিগ্রহ করে তাঁর সন্তানদের রক্ষা করতে নানারূপে আবির্ভূত হয়েছেন। ভগবতী কালী দেবীর উৎপত্তিও অনাদির আদি সেই আদ্যাশক্তি মহামায়ার থেকে। প্রথম মহাবিদ্যা দেবী কালী। দেবী ভগবতী মহামায়ার কালী রূপ তমোময়ী, উগ্রা, প্রচণ্ডা, ভীষণা হলেও তিনি স্বরূপত ত্রিগুণাতীতা, প্রশান্তা, স্নিগ্ধা, মাতৃরূপা। একই সঙ্গে দুই বিপরীত ভাবের অসামান্য সমন্বয় তাঁর মধ্যে রয়েছে। তিনি সাক্ষাৎ বিপরীত রতাতুরা। তিনি মহাকাশের মতো। দূর থেকে মহাকাশের এক এক উদ্ভাসিত হলেও তার নিজস্ব কোনো রঙ নেই। মহাকাশ অন্তহীন। মহাকাশের যেমন বর্ণহীন স্বরূপ সত্য, তেমনই সত্য বর্ণময় স্বরূপও। মহাজগতের যা কিছু পরম, ধ্রুব ও শুভ তার মধ্যে এই বৈপরীত্য বড় অনায়াসে থাকে। ভগবতী কালী দেবীও এক বিরাট শক্তিতত্ত্ব। প্রচলিত বৈপরীত্যই তাঁর কাছে তাই অতি স্বাভাবিক।

শ্রীমৎ-দেবীভাগবতপুরাণ ও শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত দেবী কালীর বিবরণ অনুসরণ করে অখণ্ড বঙ্গদেশে দেবী কালী বর্তমানে বহুল প্রচলিত মাতৃময়ী রূপ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছেন। এর প্রসারে সহায়তা করেছে বঙ্গবলয়ে দীর্ঘকাল প্রচলিত বিষ্ণুক্রান্তা তন্ত্রসাধনা। উগ্ৰা মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠিত দেবী কালী মহাশক্তির উৎস। সিংহহৃদয়ের মাতৃভক্ত এই মহাদেবীর উপাসক। পৌরাণিক ও তান্ত্রিক পথের আরাধ্য দেবী কালীই পরবর্তী সময়ে বাংলার মাতৃসঙ্গীতে অভয়া বরদা, কখনও মাতা, কখনও কন্যা হয়ে উঠেছেন। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের অনতি পরবর্তী সময়ের বিখ্যাত মাতৃসাধক তন্ত্র-আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রথম মহাবিদ্যা দেবী কালীকে বঙ্গের সাধারণ জনমণ্ডলীর উপযোগী রূপকল্পে সাজিয়ে তুলেছিলেন, এমন একটি কিংবদন্তি বঙ্গময় প্রচলিত রয়েছে। এই কিংবদন্তির সত্য-অসত্য নির্ণয় করা আজ কঠিন ব্যাপার। তবে প্রাচীন সময় থেকেই বঙ্গদেশ ছিল শক্তিসাধনার পীঠস্থান। বঙ্গে অজস্র প্রাচীন মাতৃকাদেবীর মূর্তি রয়েছে। অখণ্ড বঙ্গময় সতীপীঠের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বঙ্গ শক্তির উপাসনালয়। সপ্তম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য পূর্বভারতের অসম-বঙ্গদেশে তন্ত্রের প্রভাবকে নষ্ট করে দিয়ে অদ্বৈতবেদান্তের সিদ্ধান্ত প্রসারের জন্য জ্যোতির্মঠ স্থাপন করতে চাননি। বঙ্গ-অসমে পরিব্রজ্যাকালে তিনি এই অঞ্চলে তন্ত্র সাধনমার্গের শুভশক্তি অনুভব করেছিলেন। বঙ্গদেশের মাতৃসাধক ও তাঁদের সাধনার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন আদি শঙ্করাচার্য। এই বিষয়েও একাধিক কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে।

বঙ্গের স্নিগ্ধা দক্ষিণাকালিকা রূপের আদিতম রূপকার তন্ত্র-আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। কিংবদন্তি অনুসারে, সাধনায় সিদ্ধ হওয়ার পর কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ভগবতীর কাছে দৈবী আদেশ পেয়েছিলেন। সেই আদেশেই ভগবতী কালীর দক্ষিণাকালী রূপ নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। দৈব নির্ধারিত পদ্ধতিতে আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশই পেরেছিলেন পৌরাণিক ভ্রকুটি ভীষণা ভীমা প্রায় উন্মত্তা রণরঙ্গিনী মহাদেবীকে বঙ্গমাতা করে তুলতে। শ্মশানের আরাধ্যা দেবী ধীরে ধীরে প্রবেশ করেছিলেন লোকালয়ে। সিদ্ধিলাভের পরে মাতৃসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের ততোধিক কঠোর তান্ত্রিক সাধনায় তাঁর কাঙ্ক্ষিত আরাধ্যা ভগবতী কালী দেবীই হয়ে উঠেছিলেন প্রকারান্তরে তাঁর নিজের মা, একেবারে ঘরের গর্ভধারিণী মায়ের মতো মা। তন্ত্রসাধনায় বিশ্বাস করা হয়, যা আছে মানুষের দেহ ভাণ্ডে, তা আছে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে। পুরাণ-তন্ত্র-শাস্ত্রাদির সেই মহতী ভগবতী অখণ্ড অনন্ত চেতনা স্বরূপে সমগ্র বিশ্ব চরাচরে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। সমস্ত কিছুই তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে, আবার সবকিছুই তাঁর মধ্যে লয়ও হয়ে যাচ্ছে, আবার তিনিই সৃষ্টি থেকে বিনাশ পর্যন্ত সবকিছুকে সযত্নে নিরলসভাবে লালন করে চলেছেন। সমগ্র মহাজগতের এই প্রকাশ ও বিনাশ তাঁর অনন্ত লীলার মাত্র এক ছটা। সাধক আচার্যদেব কৃষ্ণানন্দের মাতৃচেতনার এই মহান ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর যোগ্য উত্তরসূরীরা, শিষ্য ও ভাবশিষ্যরা। এঁদের মধ্যে অন্যতম মাতৃসাধক ও মাতৃপদ রচয়িতা রামপ্রসাদ সেন। রামপ্রসাদের সমসাময়িক আরেকজন বিখ্যাত মাতৃসাধক ও শাক্তপদকর্তা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের মতো রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্যেরও সাক্ষাৎ মাতৃদর্শন হয়েছিল। এঁরা দুজনেই প্রথাগত তন্ত্রোক্ত পদ্ধতিতে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।

সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে সাধকদের বাহ্যত দুটি ভিন্ন পথ দেখা যায়। প্রথমটি, সাধকেরা সিদ্ধি অর্জন করে নিত্য সমাধিস্থ হয়ে লোক-জীবনোত্তীর্ণ এক আধ্যাত্মিক পথ গ্ৰহণ করেন। দ্বিতীয়টি, সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেও সাধকরা লোককল্যাণের জন্য সাধারণের উপযোগী আদর্শ তৈরি করে দিতে থাকেন, যা অনুসরণ করে সাধারণ মানুষও দৈনন্দিন জীবনের কাজের মধ্যে থেকেও সাধনায় ব্রতী হতে পারেন। তাঁরা তাঁদের সাধন লোককল্যাণে ব্যয় করেন। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের পর রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের হাত ধরে অব্যক্ত অখণ্ডমণ্ডলাকার চেতনাতীত মহাদেবী কালী শ্মশানচারী রূপ মুছে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন বাংলার স্নেহময়ী মা-তে, তিনি আসন পাততে শুরু করেছিলেন লোকালয়ের মাঝে, এমনকি ভদ্রাসনেও। এই পর্বে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (রায়) শাক্তধর্মের প্রসারের কাজে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি কৃষ্ণনগরে শাক্তরাসের সূচনা করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই বঙ্গময় ছোট বড় অজস্র শক্তিপীঠের সংস্কার শুরু হয়েছিল। এই পর্বেই বঙ্গময় একাধিক রাজার তত্ত্বাবধানে একাধিক শাক্তমন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। অখণ্ড চব্বিশ পরগনার গ্ৰামে গ্রামে বার্ষিক রক্ষাকালীর উপাসনা শুরু হয়েছিল। কবিরঞ্জন রামপ্রসাদের গানে শ্যামা, শ্যাম, শিব, রাম এক রূপে দেখা দিয়েছিলেন। রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য গানে গানে বলেছিলেন পরমাত্মার পরম সত্তা আসলে এক, শুধু তাঁর প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন। সেই পরমতত্ত্বকে কেউ জগদীশ্বর বলে চেনেন, কেউ আবার জগদীশ্বরী বলে চেনেন। শাক্ত পদরত্নে ঘোষিত হতে শুরু করেছিল, মাতৃসাধনায় তন্ত্রোক্ত পদ্ধতির পাশাপাশি শুধুমাত্র মাতৃনাম জপেও সিদ্ধি মেলে। তিনি মন্ত্রের অধীন হন না, তিনি সন্তানের প্রতি বাৎলস্যে অধীন। দেবী সাক্ষাৎ মহামায়া হলেও সহজেই মা-পুত্রের মায়ার বাঁধনে নিজেকে বাঁধেন।

সমকালীন সহজসাধনার স্পর্শ পেয়ে তন্ত্র ও পুরাণের আরাধ্যা দেবী কালী হয়ে উঠেছিলেন সহজ-সুন্দরী ভগবতী, একেবারে ঘরের গর্ভধারিণী মায়ের মতো সহজগম্য। অবশ্য এর সমান্তরালে চলেছিল প্রথাগত তন্ত্রসাধনার ধারা। বিগ্ৰহ-শিলা-তন্ত্র-মন্ত্র-যন্ত্রের পাশাপাশি মাতৃসাধনা হয়ে উঠতে শুরু করেছিল ভাবের ভাবীর, সাধকের আবেগের। কালক্রমে অখণ্ড বঙ্গদেশের আধ্যাত্মিক ভাবধারায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল একটি সুন্দর তত্ত্ব, মায়ের জাত হয় না, মাতৃত্বের জাত হয় না। কবিয়াল এন্টনি ফিরিঙ্গির মতো ভিন্নধর্মী পোর্তুগীজও হয়ে উঠেছিলেন কালী-অনুরাগী, মাতৃভক্ত। তিনি মাতৃপদ আয়ত্তে এনেছিলেন। এভাবে কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী জন্মসূত্রে অহিন্দু হয়েও ভগবতী মায়ের পরম শরণ পেয়েছিলেন কত অনায়াসে! তিনি হয়ে উঠেছিলেন মাতৃসাধক। কলকাতার বর্তমান বৌ-বাজার অঞ্চলে এন্টনি ফিরিঙ্গী সাহেবের উপাস্য দেবী কালী আজও কৃপা বিলিয়ে চলেছেন। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী সাহেবের কিছুকাল পরে এই ধারায় এলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস। তিনি দেখালেন শুধু অখণ্ড ভালোবাসা দিয়েও উপাস্য মাকে পাওয়া যায়, নিত্য তাঁর সাহচর্য লাভ করা যায়। ভগবতীকে জীবন্ত দেখা যায়, অন্যকেও দেখিয়ে দেওয়া যায় যে তিনি কোনো কাল্পনিক চরিত্র নন। তাঁর ক্ষেত্রে দেখা গেল, শুধু আর্তি মাখানো ভালোবাসা দিয়েই সাধনাতীত আদ্যাশক্তি ভবতারিণী ভগবতীকে একেবারে খুব কাছে পাওয়া যায়, তাঁর সঙ্গে একত্রে বসা যায়, কথা বলা যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ এখানেই থেমে থাকলেন না, আরও একধাপ এগিয়ে তিনি শেখালেন সর্বজীবে তাঁকে অনুভবও করা যায়। তখন গৃহস্থ বাড়ির সতীলক্ষ্মী নারীও ভগবতী, পতিতাপল্লির বেশ্যাও ভগবতী। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে, সমস্ত স্ত্রী সাক্ষাৎ জগদীশ্বরী। আর শ্রীরামকৃষ্ণ তা জীবনে প্রয়োগ করে দেখালেন। শুধুমাত্র তীব্র সহজসাধনায় আবেগমথিত হয়ে ভগবতীর দর্শনের পর রামকৃষ্ণ পরমহংস করেছিলেন তন্ত্রের সাধন। তাঁর তন্ত্রোক্ত পদ্ধতির সাধনার পথ প্রদর্শক ছিলেন এক নারী—ভৈরবী যোগেশ্বরী ব্রাহ্মণী। শ্রীরামকৃষ্ণজীবনে এ তো সত্যিই ছিল অপূর্ব সাধ্য-সাধন! অখণ্ড বঙ্গদেশে মাতৃসাধনার ধারায় এমন আর দ্বিতীয় হয়নি। শ্রীরামকৃষ্ণের সমসাময়িক আরেকজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মাতৃচিন্তার এই ধারায় যুক্ত করেছিলেন স্বদেশচেতনা। পুরাণ ও তন্ত্রোক্ত অখণ্ড শক্তিময়ী কালী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন দেশজননী রূপে। বাস্তবিকই সৃষ্টি-পালন-সংহারের ত্রিতত্ত্ব যেভাবে কালীর সঙ্গে যুক্ত সেভাবেই দেশমাতৃকার সঙ্গেও জুড়ে যেতে শুরু করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, আগামী পঞ্চাশ বছর (স্বাধীনতার পূর্বের পঞ্চাশ বছর!) এদেশের একমাত্র উপাস্য হবেন দেশজননী। দেশে বইবে শক্তির উপাসনার মলয় বাতাস। সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চাইবে, মৃত্যুরূপা মাতা কালী করালিনী তাঁর কাছে প্রকাশিত হবেন। এইবার ভগবতী হবেন বীরজননী।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মা রূপে তিনি প্রকাশিত হলেন কালী ও অন্য শক্তিদেবীরা। স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতাও ভগবতী কালী ও দেশজননীকে এক করে দেখিয়েছেন। এই ভাবনা প্রসারিত হলে বীর মাতার বীর সন্তানদের হাতেই দেশের প্রকৃত সমৃদ্ধি আসতে শুরু করেছিল। ইংরেজ শাসনের আসন টলতে শুরু করেছিল এই সময় থেকেই। এর আগে দেশমাতা রূপে শক্তির উপাসনা দক্ষিণ ভারতের মারাঠাদের হৃদয়সম্রাট তথা মহারাষ্ট্রের নবজাগরণের পথিকৃৎ ছত্রপতি শিবাজি মহারাজও করেছিলেন। বঙ্গদেশে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ও বিংশ শতাব্দীর শাক্তচেতনা পরিপক্ক আসন তৈরি নিতে পেরেছিল। কাজেই ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মমতের প্রোটকল না ভেঙে এই ধারায় প্রচ্ছন্নভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি দেশমাতৃকার বন্দনায় ডান হাতে খড়গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ রূপের বর্ণনা করেছিলেন পরম কৌশলে। দেশমাতার মধ্যে এ যে কালীরই আবেশ। তা তিনি পূর্বে রাজর্ষি উপন্যাসে যতই কালীকে নিয়ে বিরূপ চিন্তা করুন না কেন। একদিকে সংহার ও একদিকে প্রতিপালক ভগবতী দেবী কালী। নিজে আমৃত্যু ব্রাহ্ম রীতি মেনেও রবীন্দ্রনাথ কালীকে দেশমাতৃকা রূপে অস্বীকার করতে পারলেন না।

পরবর্তী সময়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতায় বসবাসকালে শক্তির উপাসনা শুরু করেছিলেন উত্তর কলকাতার বাগবাজারে। বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব শুরুর দিকে নেতাজীও ছিলেন এর সঙ্গে যুক্ত। নেতাজীর আগ্ৰহে দুর্গাষ্টমী তিথি বীরাষ্টমীতে পরিণত হলো। বৈচিত্র্যময়ী দেবীর লীলাবৈচিত্র্যে এরপর আরও সমৃদ্ধি দিতে এলেন কবি নজরুলও। জন্মসূত্রে মুসলমান হয়েও তিনি নিজে ছিলেন মাতৃসাধক। অসীম বিরাটকে তিনি আদরের মেয়ে রূপে দেখলেন, আবার পূর্বসূরি কবিদের মতো নিজে শিশু হয়ে দেবীর কোলে মাথা রাখলেন। নজরুল ইসলামও কালী দেবীকে দেশমাতা রূপে চিহ্নিত করেছিলেন। নজরুলের শাক্ত গানগুলিতে বহু রাগ রাগিনীর ব্যবহার রয়েছে। সঙ্গীতের মাধ্যমে মাতৃচর্চার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল এই সময় থেকে। এই ধরনের শাক্ত পদাবলী যখন বাংলার শক্তিসাধনাকে সমৃদ্ধি দিতে শুরু করেছিল সেই সময়ে আর একজন শাক্ত পদকর্তা ও মাতৃসাধক নজরুলের সমান্তরালে বাংলার কালীচেতনায় এনেছিলেন মাধুর্যের উচ্ছ্বাস, তিনি আন্দুল কালীকীর্তন সমিতির প্রাণপুরুষ প্রেমিক মহারাজ। মাতৃসাধক প্রেমিক মহারাজও রামপ্রসাদের মতো গানে সিদ্ধ ছিলেন। সাধকোচিত গভীর মাতৃভাবপূর্ণ বাণী ও সঙ্গীতের রাগরাগিনীর সুসম ব্যবহার প্রেমিক মহারাজের গানকে বঙ্গময় পরিচিতি দিয়েছিল। রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য যদি বাংলা মাতৃসঙ্গীতের মাধ্যমে বাঙালির কালীচেতনা ও কালীচর্চার প্রসারের প্রথম যশস্বী জুটি হন তবে মাতৃসাধক প্রেমিক মহারাজ ও নজরুল ইসলাম পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় দ্বিতীয় জুটি।

বিংশ শতাব্দীতে স্বামী কৃষ্ণানন্দও এই ধারাকে সমৃদ্ধি দিয়েছিলেন। যদিও তাঁর মাতৃগীতিগুলির বেশিরভাগই ভাবপ্রধান। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের পর থেকে বাঙালির কালীচেতনা আবার একবার নতুন করে গতি পেতে শুরু করেছিল। বাংলার চার মাতৃসাধক— রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও বামাক্ষ্যাপার জীবনীর ওপর বেশ কয়েকটি সিনেমা তৈরি হয়েছিল এই পর্বে। এই সময় থেকে দূরদর্শন ও সিনেমার মাধ্যমেও মাতৃধর্মের একটি প্রসার ঘটেছিল সকলের অলক্ষ্যে। বিশেষ করে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ওপর তৈরি হওয়া প্রধান সিনেমা দুটি বাঙালি সমাজে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এরপরে নয়ের দশকে দূরদর্শন কলকাতায় সম্প্রচারিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ ধারাবাহিকটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। বাংলার কালী ও কালীসাধকের অনন্য আখ্যান বাঙালির কাছে শুধুমাত্র বিনোদন হয়ে থেমে থাকেনি। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে এই সময়ে ছোট ছোট অনেক কালী মন্দির গড়ে উঠতে শুরু করে ও সেই সব মন্দিরে কালী দেবীর বিগ্ৰহের দুই পাশে শ্রীরামকৃষ্ণ দেব ও সারদা দেবীর বিগ্ৰহ স্থাপিত হতে থাকে। এই পর্বেই বাংলা গানের অ্যালবামের বলয়ে মাতৃসঙ্গীতগুলি জায়গা করে নিতে শুরু করেছিল। বিশেষ করে প্রসাদী সুরে স্নাত রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের গানগুলি রেকর্ড করা শুরু হয়। প্রথমে ডিস্ক, তারপর ক্যাসেড, সবশেষে সিডি ও ডিভিডিতে এই গানগুলি বাণিজ্যিক সাফল্যও এনে দিয়েছিল। দীর্ঘ সময় ধরে রেকর্ডের মাধ্যম বদলে গেলেও গানগুলির চাহিদা একই ছিল। এর থেকে বোঝা যায় বাঙালির কালীচেতনা ও কালীচর্চার ইতিবৃত্তে এই গানগুলি কতটা গুরুত্বপূর্ণ অন্তত তখনও পর্যন্ত ছিল। বাংলার পৌরাণিক সিনেমা ও সাধক জীবনীমূলক সিনেমাতেও এই ধরনের গানের ব্যবহার শুরু হয়। রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য ও শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী মাতৃসঙ্গীতের ধারায় জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছিলেন। এই ধারার জনপ্রিয়তা দীর্ঘদিন বজায় থাকায় পরবর্তী সময়ে মান্না দে, অনুরাধা পারোয়াল, অমৃত সিং, কুমার শানু সহ আরও অনেক শিল্পী কালীসঙ্গীতের অ্যালবাম প্রকাশ করেন। এই সময়ের মধ্যেই রাগাশ্রয়ী কালীকীর্তনের অ্যালবাম প্রকাশ করেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। প্রচলিত প্রসাদী সুর ও রাগাশ্রয়ী কালীকীর্তন উভয় ধারাই বাঙালি জাতির কালীচর্চার প্রসারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এভাবেই অখণ্ড বঙ্গদেশে সব ধারা এসে মিশে গিয়েছিল কালীতে। আর ভগবতী কালী মিশে গিয়েছিলেন সব সাধনার ধারায়…

অভিজিৎ পাল | Avijit Pal

Matritva | মাতৃত্ব | পুনম মায়মুনী | New Bengali Story 2023

Valentine Day Speciality | ভালোবাসা দিবস | Top New Bengali Article 2023

Mokkhada Pishi | মোক্ষদাপিসী | শিখা কর্মকার | New Bengali Story 2023

Emblem of Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীকের অর্থ | নক্‌শা ও তাৎপর্য | 2023

Doob De Re Mon Kali Bole | Doob De Re Mon Kali Bole Mp3 | Doob De Re Mon Kali Bole Song | Doob De Re Mon Kali Bole song download | Doob De Re Mon Kali Bole mp3 download | Shyama Sangeet – Doob De Re Mon Kali Bole | Doob De Re Mon Kali Bole lyrics | Sabuj Basinda | High Challenger | Lyrics – Doob De Re Mon Kali Bole | Article – Doob De Re Mon Kali Bole | Doob De Re Mon Kali Bole in pdf | Bhakti Geet – Doob De Re Mon Kali Bole | Doob De Re Mon Kali Bole Swaralipi | Doob De Re Mon Kali Bole – Gaan | Bangla Gaan – Doob De Re Mon Kali Bole | Doob De Re Mon Kali Bole – Avijit Pal | Shabdodweep – Doob De Re Mon Kali Bole

Leave a Comment