Bibarna 2023 | New Bengali Story | বিবর্ণ | শওকত নূর

Sharing Is Caring:
Bibarna 2023

শওকত নূর – সূচিপত্র [Bengali Story]

বিবর্ণ – শওকত নূর [Bibarna 2023]

দৌড়ে ভেজা বাংলোর পেছনে অদৃশ্য হলো লোকটা। দু’পাশে অনুচ্চ গাছের সারির লন ধরে যেভাবে দৌঁড়াচ্ছিল সে তাতে আদিবের মনে হয়েছিল বৃষ্টির তাড়া খেয়ে বন্ধ বাংলোর দরজায় নিজেকে সঁপে দেয়াই বুঝি হবে তার একমাত্র অভীষ্ট। কিন্তু বাংলোর দিকে সে ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ করেছে বলে মনে হয় না। দৌড়ালেও তার মাথা ছিল রীতিমত মাটির দিকে। বাংলোর নিশানাটা যেন তার চোখের তারায় গাঁথা। আদিব পা বাড়াতে গিয়ে থামল। বৃষ্টির বেগ কমার পর্যায়ে এসে এখন এমন বেড়েছে যে এ পাহারা ছাউনি ত্যাগ করার প্রশ্ন জাগে না। পাহারাদারের ক্লান্ত, ক্লীষ্ট, জীর্ণ-আধো ঘুমন্ত মুখমণ্ডলে দৃষ্টি নামছে তার থেকে থেকে। আবার মুহূমূর্হু বজ্রের বিকট শব্দে উঠে যাচ্ছে আকাশে। আকাশ তো নয় যেন পাগলাটে রাজবন্দীর ফ্যাকাশে দীর্ঘ এলো-জটা চুল।

সূর্য পশ্চিমাকাশ ধরেছে খুব বেশি সময় হয়নি, তবু কোনও জ্যোতির্লৌকিক মারপ্যাচে মেঘগুলো কালো রঙ-বিবর্তন থেকে এমন উন্মত্ত হতশ্রী ভাব নিয়েছে। আদিব কাঁধের ব্যাগ হাতড়ে পানির বোতল বের করে ছিপি খুলে গলা ভেজালো। তীব্র ক্ষুধায়, আহারহীনতায় এই অগত্যা ও একমাত্র দাওয়াই। পানির বোতল ব্যাগে পুরতে গিয়ে রীতিমত লাফিয়ে উঠলো সে। ভয়াল শব্দে আগুন খণ্ড ছিটকে যেতে দেখল সে বাংলোর পেছনের বনভূমির সবচে’ লম্বা গাছটার মাথায়। খানিকটা চিন্তিত হল আদিব। বাংলোর পেছনে কিছুটা জায়গা জুড়ে অচেনা ফসলের খেত, কোন ঘরবাড়ি নেই। তারপরই বন। লোকটা ওদিকে গেল কোথায়? গত চারদিনে এ পথে তিনবার মুখোমুখি দেখেছে সে লোকটাকে। বেটেখাটো গড়ন, নাক বোচা, রং তামাটে, নাকের নিচের গোঁফ জোড়া আটখানা। মুখোমুখি হলে হঠাৎ মুখ তুলে প্রতিবার বিবর্ণ রহস্য চোখে তাকিয়েছে সে। এই প্রবল দুর্যোগে ওদিকে গেল কোথায় সে, তার স্থায়ী নিবাসই বা কোথায়? এ মুহূর্তে সে কী অবস্থায় আছে?

হঠাৎ নাসারন্ধ্রে তরকারীর গন্ধ ঢোকায় চমকে নিচে তাকালো আদিব। দেখলো ঝিমভাব কাটিয়ে দিব্যি মুখে খাবার তুলছে পাহারাদার। কী খাচ্ছে সে ? মোটা ভাত, এক লকমা ভর্তা, খানিকটা শাক ও অচেনা কোনও মাছের তরকারী। তরকারীর গন্ধটা যেন চিরচেনা। একই দেশে এমনই হয় বুঝি। জিভে জল এসে গেল তার। পেটুকতায় নয়, একান্তই ক্ষুধায়। খাওয়ার ফাঁকে পাহারাদার ঢি’ ঢি’ করে তাকাতে লাগল তার দিকে। ভেতরের বিরক্তির কিছুটা যেন মিশে বেরোচ্ছিল তার দৃষ্টির সাথে। আদিব এবার ভাবনায় ডুবে গেল। আজ নগরের যে অচেনা পথ ধরে সে ঘণ্টা দুই আগে ঘণ্টা খানেক ধরে হেঁটেছে, তা ছিল এক বিবর্ণ পথ। বিবর্ণ এই অর্থে যে প্রায় এক কিলোমিটারের সরল পথটির কোথাও সে ন্যূনতম প্রাণোচ্ছলতা দেখতে পায়নি। পিচ খসা, ইট বের হওয়া তামাম পথটি ধুলি-ধূসর। দুপাশে সারি সারি ঠেলা ভ্যান দাঁড়ানো। কোনটি খালি, কোনটিতে আছে আখের ছোবড়া, কিংবা ইট খোয়া অথবা সিমেন্টের বস্তা। পথের দুধারে বসে থাকা প্রতিটি মুখ বিবর্ণ, ক্লান্ত- অবসন্ন। কেউ ঝিমাচ্ছে, কেউ ঘুমঘোরে, দলবদ্ধ অনেকে খাবার গিলছে। একই দৃশ্য দীর্ঘপথ জুড়ে। দুপাশে কৌতূহলী নজর রেখে চলছিল আদিব। নিজে ক্ষুধার্ত বলেই হয়তো বেশি বেশি দৃষ্টি আটকাচ্ছিল খাবার দৃশ্যে। প্রতি প্রেক্ষিত অতিক্রমে একই তরকারীর গন্ধ তার নাসারন্ধ্রে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছিল। প্রতিক্ষেত্রে পরিবেশক বয়োঃবৃদ্ধা জীর্ণবেশ কোনও নারী।

একটি জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালো আদিব। এখানকার জটলায় খাদ্য পরিবেশকের মুখমণ্ডল তাকে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করল। পরিবেশকের মুখমণ্ডল এত বেশি ভাজ খাওয়া আর এতটা জীর্ণ ক্লিষ্ট ও বয়সের ছাপের সাথে দুর্বলতার চিহ্নধারী যে ভীষণ মায়া হল তার। খানিকটা নস্টালজিক হয়ে উঠল সে। নিজের দাদীকে সে শৈশবে হারিয়েছে। ক্লাস টু থ্রিতে পড়ে এমন বয়সে। বয়স শ এর কাছাকাছি গেছিল। পা বিছিয়ে বসে পায়ের ওপর নিয়ে থাকত সে তাকে। নানা গল্প করত। নাওয়া খাওয়া ভুলে যেত সে। তার দাদী যেই বলত, এত যে মায়া করস, আমি মরলে কেমন করবি? আর হয়েছে, এ কথার প্রভাব মুহূর্তে তাকে এমন নাড়া দিত যে হাউমাউ শব্দে তার ঘণ্টা কয়েক চলে যেত অপ্রতিরোধ্য। অশ্রুসিক্ত অবাধ্য টানা এক প্রশ্ন ঝরত -দাদী মরবে কেন?

অতিক্রমান্তে হাত দুই এগিয়েও থমকে দাঁড়াল আদিব। দৃষ্টি তার স্বতঃস্ফূর্ত ঘুরে গেল খাদ্য পরিবেশন দৃশ্যে। খাদ্য গ্রহণকারীগণও যে সতেজ-সবল তা আদৌ নয়। প্রত্যেকে শ্রমিক, নির্জীব নির্লিপ্ত খাদ্য গিলছে- সম্ভবত প্রায় বিনা বিশ্রামে। শীঘ্র কাজে হাত লাগাতে হবে বিষয়ক দুশ্চিন্তা ঠাঁই করে আছে মাথায়। পাশের খালি ঠেলা ও ভ্যানের ওপর দু একজনার সটান চোখবন্ধ শুয়ে থাকার দৃশ্যপটও তার নজর কাড়ল। কিন্তু মুহূর্তে তা ফিরে এসে স্থায়ী হল বৃদ্ধার আপদমস্তকে। এই ছাত্রজীবনে এ নগরীর নানা পথে সময় সময় সে অতিক্রম করেছে। কিন্তু আজকের মতো এভাবে একই অচেনা পথে দীর্ঘক্ষণ হাঁটেনি। এমন দৃশ্যপটও এভাবে আগে নজরে আটকায়নি। ব্যথাতুর বিস্ময়বোধ আচ্ছন্ন করতে লাগল তাকে। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো অসুস্থতা আক্রমণ করে তাকে। শরীর স্বাভাবিকের চেয়ে দুর্বল করে দেয়। তা দিয়ে সে বৃদ্ধার অসহায় অবস্থাটার প্রকৃত স্বরূপ স্বতঃস্ফুর্ত জাগা বোধের সাথে অনুভব করল। যার কিনা নিজেকে সচল রাখার সক্ষমতাই লুপ্তপ্রায়, তাকে পেটের দায়ে জীবিকায় নামতে হয়েছে। তাও আবার নগরের রাজপথে, অচেনা সব মানুষদের খাদ্য পরিবেশনে।

পরিবেশনের কাজটি যেহেতু তাকে করতে হচ্ছে, রান্না, কেনাকাটার কাজ তথা বাসস্থান, যা কিনা ধারেকাছে হবার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই, তা থেকে নিজেকে বের করে হেঁটে কিংবা কোনও সরল যানে করে এ পর্যন্ত পৌঁছার কাজটি তার স্বনির্ভরতায়ই করে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কোনও সহযোগী কি আদৌ থেকে থাকবে ? আশেপাশে দেখা তো যাচ্ছে না তেমন কাউকেই। যদি তার তেমন কেউ থেকেই থাকে তবে তাকে কেন জীবিকায় নামতে হয়েছে? কম্পমান হাতে থালায় থালায় ভাত তরকারী তুলনা দেয়ার দৃশ্যটি এমন সব প্রশ্নপাতের উদ্রেক ঘটায় যা থেকে সক্ষম সমাজ কোনমতে কোনও যৌক্তিকতায় নিজেদেরকে দায়মুক্ত ভাবতে পারেন না। এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন আদিবের মনে ঘন ঘন আঘাত করে চলেছে- কেন তাকে এ বয়সে এ হেন ন্যূনতম অর্থে বেঁচে থাকার দশায় জীবিকায় নামতে হয়েছে, রান্নার কাজটি তার নিজেকেই সারতে হয় কিনা, কেনাকাটা কে করে, এ কাজে তার দৈনন্দিন কত উপার্জন, কোথায় নিবাস, জগৎ-সংসারে নৈতিক অর্থে দেখভালের কেউ সত্যিকারে আছে কি নেই প্রভৃতি।

সে ভাবল তার হাতে একটা মাউথ পিস ধরণের কিছু কিংবা কাগজ-কলম কিছু থাকলে কিছুটা ভালো হত। ফুটপাতে এ ধরণের দৃশ্যপটে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে নগরীতে কিছু নেতিবাচক জন-ধারণা থাকে। কারণ, চাঁদাবাজদের চাঁদাহরণ তালিকায় নিরীহ সবল বলতে কোনও কথা আদৌ থাকে না। এ প্রেক্ষিতে নিরীহরাই সম্ভবত বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। সাতপাঁচ ভেবেও নিজেকে সংবরণে সমর্থ্য হল না সে। মনে উত্থিত প্রশ্ন ঝড়ের নিবারণটা আবশ্যক গণ্যে এগিয়ে গেল চেহারা বেশে নিজেকে ভালোমানুষের মতো দেখাবার আত্মবিশ্বাস নিয়ে। কাঁধের ঝোলা ব্যাগটি তাতে সমর্থন যোগালো। দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকল সে, এখানে কাজ করছেন?

হ বাবা! ভাত খাবা ?

না, আমার ক্ষুধা নেই।

কিছু জিগাবা ?

হ্যাঁ, আগে কেউ কি কিছু জিগিয়েছে ?

হ বাবা। একজন জিগাইছে একদিন।

কী?

এই বয়সে কাজ কইরা খাই কেন ? কষ্ট হয় নাকি?

কী বললেন ?

কী কমু, বাবা ? কাজ না করলে খামু কী ? খোদায় মরণ তো দেয় না।

তা আর কেউ নেই আয় রোজগারের ?

না বাবা, থাকলে কি আর আধা যাওয়া দশায় কাজ করতাম ?

কতদিন হল এখানে খাবার পরিবেশন করেন?

দুই বৎসর।

তার আগে কী করতেন ?

ঘরের কাজকর্ম করতাম।

তখন কে উপার্জন করতেন ?

আমার স্বোয়ামী।

উনি বেঁচে আছেন ?

না থাকার মতোন।

কী হয়েছে ? অসুস্থ ?

হ বাবা, মরার মতন বাঁইচা আছে।

কোনো অসুখ ?

হ বাবা, ঠ্যালাগাড়ি চালাইত। এই পথেই ইস্টোক হইছিল দুই বৎসর আগে। জবান বন্ধ। হাতপাও অবোশ। খালি কান্দে আর কবার চায়, মরণ নাই ক্যান ?

আপনার কোন ছেলেমেয়ে ?

এক মাইয়া, এক ছাওয়াল।

তারা কী করেন ? দেখেন না আপনাকে ?

মাইয়ার জামাই জামা কাপড় ফেরি করে। তাগোর নিজেগোই চলে না।

ছেলে ?

বস্তিত থাকে। ইস্টিশনের মাল টানে। একদিন কাম করলে তিনদিন বইয়া কাটায়। খালি গানবাজনা হুনে। আজেবাজে জিনিস খায়। দুইবার পুলিশে ধরছে।

এখানে আসেন কীভাবে ? বাজারঘাট কে করে?

এক খালাত ভাইয়ের ছাওয়াল আছে। ওই যে ওই মাথাত দারোয়ানের চাকরি করে। হেই আনা নেওয়া করে। বাজারঘাট বেশির ভাগ নিজেই করি।

থাকেন কোথায় ?

শহরের ওই মাথাত।

এখানে ক’টা পর্যন্ত থাকতে হয়?

বেইল ডুবার আগে ভাইয়ের ছাওয়াল ডিউটি শেষে ভ্যানে তুইলা নিয়া যায়। আইজ আছর ওক্তে যাওয়ার কথা কইছে।

তা দিনে যা উপার্জন হয়, তাতে ভালোমত চলে?

কোনোমতে দিন যায়। ওষুধে ম্যালা ট্যাকা যায়। মাঝেমধ্যে ট্যাকার অভাবে ওষুধে ঠ্যাক পড়ে।

আচ্ছা, আপনার কাজের ক্ষতি করলাম। কিছু মনে করবেন না।

না বাবা, কী মনে করমু?

ভালো থাকবেন, চলি। এ পথে যদি আবার আসি, কথা বলব।

আইসেন, বাবা।

ভাবনাঘোর কেটে আকাশে মুখ তুলল আদিব। বৃষ্টি নেই, মেঘ সরে রোদের ভাব ফুটে উঠেছে। সামনের গাছ সমেত বাংলোটাকে জল রঙে আঁকা ছবির মতো মনে হচ্ছিল তার চোখে। দ্রুত পা বাড়াল সে। লন পেরিয়ে চলে এলো বাংলোর সামনে।

শুকনো খাবারে আজ মুখ ফিরে আসছিল আদিবের। দুদিন ধরে এমনই সে খাচ্ছে। পড়াশোনার একটা পর্যায় তার এ শহরেরই অন্য এক প্রান্তে থেকে কেটেছে। এখনও পড়াশোনাই চলছে অন্য শহরে। এখানে সে এসেছে চাকরির খোঁজে। পড়াশোনার ফাঁকে সময় সময় চাকরির খোঁজ। এ বাংলোর অধিবাসী তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। সপরিবারে বেড়াতে গেছেন তিনি সে এখানে এসে ওঠার দিন রাতেই। কাল তাদের ফিরে আসার কথা। তারা ফিরবেন, আদিব ছেড়ে যাবে। রান্নাভাবে এখন শুকনো খাবারেই সে ভরসা করছে। খেতে গিয়ে বার বার মনে পড়ছে রান্না করা তরকারীর সে ঘ্রাণের কথা। এখান থেকে চলে গেলেই যেন এ অবস্থা থেকে পরিত্রান।

হোটেলের খাবারে সে অভ্যস্ত নয়, তবু দিন দুই দুপুরের খাবার হোটেলে সেরেছে। এখন চলছে শুধু পাউরুটি, কলা বিস্কুট চিড়া মুড়িতে। চিড়া চিবানোর ফাঁকে জানালা থেকে হঠাৎ রোদ বিদায় নেবার দৃশ্যে দৃষ্টি গেল তার। আবারো বুঝি আকাশে মেঘ জমছে। ভাবতে ভাবতেই ঝমঝম করে শুরু হল বৃষ্টি। আবারো সেই বজ্রপাত। খাওয়া সেরে দ্রুত হাত ধুয়ে দৃষ্টি দিল সে পুবের জানালায়। ফসল মাঠটি মুরগী ভেজার মতো মৌন হয়ে গেছে। ভেজা বন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে গা খালি পিশাচের মতো। তার মনে পড়ল সেই লোকটির কথা। এ চত্বরের দারোয়ানের সাথে যোগসাজশে সে লন পেরিয়ে ওপাশের কেচি গেইট দিয়ে বেরিয়ে যায়। ডুপ্লিকেট চাবিও তার আছে। কিন্তু ওদিকে থাকে সে কোথায়? বনের মধ্যে কোনও নিবাস? ভাবতে ভাবতে তদ্রাচ্ছন্নতা বোধ করে সে। জানালা চাপিয়ে বিছানায় শুয়ে চোখ বোজে সে।

ঘুম ভাঙার পর বারান্দায় মৃদু কথোপকথনের শব্দ পেল সে। ঘরের লাইট বন্ধ থাকায় টের পেল, হয় বেলা ডুবেছে, নয়তো আকাশ খুব বেশি মেঘাচ্ছন্ন হয়েছে। বাইরে সূর্যালোক থাকলে ভেতরে এতটা অন্ধকার হয় না- এ ক’দিনে সে তা লক্ষ্য করেছে। কারা চাপা কথোপকথন চালাচ্ছে, খানিকটা ফিসফিসানোর মতো? উঠে পুবের জানালা খুলল সে। সূর্যাস্ত যায়নি- আকাশের ওপাশটা ফ্যাকাশে ও বাষ্পাকারে গুড়িগুড়ি অতি মিহি বৃষ্টি হচ্ছে। বনাংশ কুয়াশাবৎ। সে একবার ভাবলো আবারো বিছানায় গা এলিয়ে দেবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত পাল্টে দরজা খুলে দিল। হকচকিয়ে যাবার অবস্থা তৈরি হলেও নিজেকে সামলাল সে। নাটক সিনেমায় প্রায়শ এমন কাকতালীয় ঘটনা নির্মাতাদের দ্বারা ঘটানো হয়, যার বাস্তবতায় সর্বদাই তার নিজস্ব অবস্থান দোটানা থাকে। সেই বৃদ্ধা বারান্দা-কোনার প্লাস্টিক চেয়ারে বসা। কাছেই বেটেখাটো ওই লোকটা, যাকে দিয়ে এ গল্প শুরু, সে দাঁড়ানো। বৃদ্ধা বোধ করি ভুলে গেছে তার চেহারাছবি। এখন তো তার বেশভূষা একেবারে ভিন্ন। গায়ে শার্টের পরিবর্তে স্যান্ড্রো গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি।

আজ কি আপনার সাথে দুপুরে কথা হলো? বলল সে।

আপনে ক্যাঠায় ? বৃদ্ধা জবাব করল।

ওই যে দুপুরে যে পথের ধারে নানা কথা জিজ্ঞাসা করলাম, আজ দুপুরেই!

ও বাবা, আপনে সে-ই ছাওয়াল।

হ্যাঁ, আপনি এখানে কোত্থেকে এলেন ?

এনার বাসা, বাসা ওই ধারে। সাথের লোকটা বলল।

ওদিকে কোথায়?

ওই যে পুবে কেচিগেট। পরের ফসলের খেত। তারপরে বন ঘেইষা আরেক কেচিগেট। তার বাইরের ফুটপাতের পর টিনের বস্তিঘর আছে, চিনেন ?

না, ওদিকটায় যাওয়া হয়নি।

এনার লগে বুঝি কথা হইছে?

হ্যাঁ, আজ দুপুরেই, রাজপথে।

বৃষ্টি খুব না। কিন্তুক হাঁফাইয়া উঠছে। ম্যালা বয়স হইছে তো। ভাবলাম একটু জিরাইয়া লই। অহন দেহি মোক্ষম জায়গাত আশ্রয় লইছি। মনে মনে ভয় করতাছিলাম। আপনেরে দেখছি দুইদিন, তারপরেও।

সমস্যা নেই, বসুন। জিরিয়ে বৃষ্টি থামলে যান।

কথা সেইটাই। তা এ বাংলার মালিকে আপনার কী লাগে?

আমার বাবার ফুঁপাতো ভাই।

হ্যায় কবে আসতাছে বেড়াইয়া?

কালই, দুপুরে।

আপনে ওনাদের সাথে…।

না, থাকব না আমি , কালই চলে যাবো। ওনারা দুপুরে আসবেন, আমি বিকালে চলে যাবো।

বাড়ি কই?

পঞ্চগড়।

ও…। ফুবু কি ঘুম গেলা নাকি? ও ফুবু।

না। শরীল দুর্বল। চোখ বুনছি।

উনি কাইল চইলা যাইতাছে, দূরে।

বাবা, কাইলই যাবা ? আরেক দিন না কথা কবা কইছিলা।

হ্যাঁ, আবার এ শহরে আসলে বলব।

মাফ কইরো বাবা, আমি তোমারে তখন বুঝবার পারি নাই। কত রকম মানুষ পথে ঘুরে ফিরে।

কেন, কী হয়েছে ?

তোমারে ভাত খাবার কইছি।

ও হো…। তাতে কী হয়েছে ? আপনি মুরুব্বী মানুষ। আমার যে ক্ষুধা তখন লেগেছিল! মনে হচ্ছিল আপনার খাবারগুলো খুব স্বাদের হবে।

আর বাবা স্বাদ, গরিবের খাবার! যাও বাবা, ঘরে যাও। আযান পড়ব বুঝি।

হু ফুবু, লও যাই অহন। ফুবায় বোধ করি কান্নাকাটি করতাছে।

লও যাই।

তারা হাঁটা ধরলে আদিব দরজা চাপিয়ে দিল। কেচি গেটটা শব্দ করে বন্ধ হল। আযান আর পাখির শব্দে কান বন্ধ হবার উপক্রম হল। পুবের জানালায় সে তাকিয়ে দেখল লোকটা বৃদ্ধাকে নিয়ে অতি ধীরে সন্তর্পণে আবছায়ায় ফসল মাঠের পার্শ্বপথ ধরে অতিক্রম করে যাচ্ছে। তীর ধনুকের মতো অবয়বে ধীরে ধীরে ওদিকে অদৃশ্য হল তারা।

সন্ধ্যাকাশে স্থানে স্থানে ধোয়াটে মেঘ, স্থানে স্থানে নীল ঘেরে তারা জাগছিল। রেলস্টেশনে গিয়ে টিকেট কেটে আনে আদিব। পরদিন বিকালে সোয়া পাঁচটায় তার ট্রেন। দূরাত্মীয়দের আসার কথা আছে দুপুরে। কিন্তু স্টেশন থেকে বাংলোয় ফিরতেই ফোনে সে জানলো তারা আসছেন পরদিন বিকাল পাঁচটায়। পথে বিলম্ব না হলে ঠিক বিকাল পাঁচটাতেই ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াবে। অতএব, আলোচনা হল আদিব বাংলোয় তালা দিয়ে চাবি নিয়ে পাঁচটার খানিকটা আগে স্টেশনে পৌঁছবে। তারা স্টেশনে নামার পর চাবি হস্তান্তর করে সে যথারীতি চলে যাবে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। স্টেশন রেস্তোরায় রাতের খাবার খেয়ে সে চলে এলো বাংলোয়।

ভোরে ঘুম ভাঙলেও আবশ্যক না হওয়ায় খানিকটা দেরিতে বিছানা থেকে উঠলো আদিব। চোখ খুলে টের পেল বৃষ্টি কেটে বাইরে রোদ উঠেছে। খাট থেকে নেমে সদর দরজা খুলে কিছুটা বিস্মিত হল সে। প্লাস্টিকের যে চেয়ারটি বারান্দার দূর কোণায় ছিল সেটি ঠিক দরজা বরাবর দাঁড়ানো। একটা সীসার টিফিন ক্যারিয়ার তার ওপর বসানো। বিবর্ণ! এখানে কে রাখল এটা? কী উদ্দেশ্য? বুঝে উঠতে পারল না সে। দরজা চাপাতে যাবে এরই মধ্যে দেখল, এ চত্বরের ছাউনি পাহারাদার দৌড়ে আসছে। একটু দূর থেকে সে হাঁপিয়ে বলল, ভাইসাব, বাটি নাদেল মিয়ায় রাইখা গেছে।

কেন ?

কইছে ভিতরে নাকি আপনের খাইদ্য আছে।

আমার খাদ্য!

জি। নাদেল মিয়ার ফুবু নাকি আপনের লাইগা দিছে। ভিতরে নিয়া রাখেন। বড় মুখ কইরা দিছে।

পাহারাদার দৌড়ে চলে যায়। ক সেকেণ্ডের মাথায় ছাউনিতে পৌঁছে এদিকে তাকিয়ে রইল সে। আদিব ইতঃস্তত বাটিটা ভেতের নিয়ে আসে। ডাইনিংএ রেখে দেয়।

সকালের নাস্তা সে পাউরুটি কলায় সেরেছে। দুপুরের জন্য চিড়াগুড় ঠিক করে রেখেছে। বার কয়েক বাটিতে হাত দিতে গিয়ে সে ইতঃস্তত করেছে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদে সে বিশ্বাসী নয়। কিন্তু পারিবারিক ভাবেই খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে খুঁতখুঁতে ভাবটা আছে, যা দূর করার প্রয়াস যেমন এতকাল চলেনি, দূরও হয়নি। অনুমানে সে বুঝে নিয়েছে বাটিতে কী আছে খাবার। গত সন্ধ্যায় নেহায়েত সৌজন্য বশে বৃদ্ধার খাবারের সম্ভাব্য স্বাদের প্রসঙ্গ টেনেছে সে। এ যে তারই ফলশ্রুতি সন্দেহ নেই। কিন্তু খাবে সে ? তৃপ্তির ব্যাপারটা, যা কি না স্বতঃস্ফূর্ত বাসা বেধে আছে তার অস্তিত্বে, তা? ইতঃস্তত বাটি খুলে দেখল সে। তার অনুমান শতভাগই ঠিক। সেই ভাত, মাছের তরকারি, একটু শাক, ডাল।

বিকাল তিনটা নাগাদ না খাওয়া রইল আদিব। সিদ্ধান্তহীনতা, কী খাবে- ভাত, নাকি চিড়াগুড়? তিনটায় সে অগ্রিম গোছগাছ ধরল। আধঘণ্টা পেরিয়ে গেল। বারবার খাটে উঠবোস ও মেঝেতে পায়চারি করতে লাগল সে। ভাবতে লাগল খাবারটি খাওয়া না খাওয়ার নৈতিক দায় নিয়ে। না খেলে কী হবে ? যিনি দিয়েছেন তিনি তো আর জানবেন না সে খায়নি। অতএব,–। পরক্ষণে আবার বিবেকের দায় মাথায় চাপে। ওপরওয়ালা তো জানবে গরিব বলে এক মাতৃস্থানীয়া বয়োঃবৃদ্ধার সম্মান সে গোপনে ভূলুণ্ঠিত করেছে। এরই মধ্যে ভেতরে ক্ষুধার অনুভূতিটা প্রবল হয়ে উঠেছে। সে টের পেল তৃপ্তি-অতৃপ্তি বিষয়গুলো তার অন্তরতম সত্ত্বায় এরই মধ্যে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। চাঙা হয়ে উঠেছে ক্ষুধার ধূসর রঙ। আচমকা বাটি টেনে আরম্ভ করে দিল সে। দ্রুত শেষ করে দিল যা কিছু ছিল তামাম টিফিন ক্যারিয়ারে। খাওয়া শেষে বাটিটা বারান্দার প্লাস্টিক চেয়ারে স্থাপন করল সে।

যথাসময়ে বাংলো থেকে বেরিয়ে পড়ল আদিব। দরজায় তালা দেয়ার পর প্রথমেই দৃষ্টি পড়ল তার ওই বাটিটির ওপর। বিবর্ণ! তার মনে ভেসে উঠল বৃদ্ধার খাবার পরিবেশন করা সে রাজপথটি, পথের সে তামাম দৃশ্যপট। বিবর্ণ! চেষ্টা করে বৃদ্ধার মুখটি ভালোমত চোখে ভাসাতে পারল না সে। ঝাপসা দেখাল। সে দৃষ্টি ছুঁড়ল সামনের গাছে, লনে। বিবর্ণ! লনে বেরিয়ে আকাশে তাকাল সে। আবারো ধোঁয়াটে মেঘের উপস্থিতিতে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে তামাম আকাশ। সে বিস্ময়ে লক্ষ্য করল, সে আকাশের এখানে ওখানে নগরের ফুটপাত আর খাদ্য গ্রহণে ঠায় বসা জীর্ণ -বেশ, শ্রমক্লিষ্ট যত মনুষ্য মূর্তি এঁকে দিয়েছে কোন্ অদৃশ্য চিত্রকর। ওসব দৃশ্য আঁকতে গিয়ে তুলির রঙ নিঃশেষিত হয়ে এসেছিল বুঝি তাঁর। তাই ওসব চিত্রপট অমন রঙ-বিবর্জিত, বিবর্ণ!

শওকত নূর | Shawkat Noor

History of Bengali Poetry | কবিতা কি ও কেন এবং তার ইতিহাস

Bengali Article 2023 | কবিগুরুর মানবতার ভাবরূপ

New Bengali Story | কুহেলী দাশগুপ্ত | Kuheli Dasgupta

Traditional Seth Family Durga Puja | চন্দননগরের ঐতিহ্যবাহী হরিহর শেঠ পরিবারের দুর্গাপূজা

Shabdodweep Web Magazine | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder | Bibarna 2023 | Bibarna 2023 new story | New story Bibarna 2023 | Bibarna 2023 – new movie | Bengali Story – Bibarna 2023 | Bibarna 2023 pdf download | Trending topic -Bibarna 2023 | Viral Video – Bibarna 2023 | Video download – Bibarna 2023 | New Journal – Bibarna 2023 | Bibarna 2023 – Bengali Story | Reading book – Bibarna 2023 | Full story – Bibarna 2023 | New presentation – Bibarna 2023 | Bibarna 2023 – New song | Bibarna 2023 song download | Bibarna 2023 – story book | Top story Bibarna 2023 | Best seller – Bibarna 2023 | Best story – Bibarna 2023 | Long Story – Bibarna 2023 | Short story – Bibarna 2023 | Story winner – Bibarna 2023 | Best story book – Bibarna 2023

Leave a Comment