Bengali Story 2023 | মন্টুর মা | গল্পগুচ্ছ ২০২৩

Sharing Is Caring:

মন্টুর মা [Bengali Story]

জয়নালের খেয়া পার হয়ে লোকজন সব হন হন করে এগিয়ে চলেছে সামনের পিচ-রাস্তায় গিয়ে ভ্যান ধরবে বলে। আজ শনিবার।বারো নম্বরের হাটের বার। হাটের দূরত্ব এখান থেকে তিন কিলোমিটারের ও বেশি।আটের দশকে এ রাস্তায় হাঁটা ছাড়া উপায় ছিল না।ভ্যান চলাচল শুরুর পর থেকে কেউ আর হেঁটে যায় না। পিছিয়ে পড়েছে মন্টুর মা। বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। শরীরটা বেশ ভারী। হাটের বারে হাটে তাকে যেতেই হয়। হাটে হাটে ভিক্ষে করে তার সংসার চলে।

‘ও বাপেরা, আমার ফেলে যাসনে তোরা।’
এগিয়ে চলা লোকেদের থেকে কে যেন বলে উঠল,
‘ তুমি এসো, আমরা তোমার জন্য জায়গা রাখছি।’

আশে পাশের পথ চলতি মানুষ জন সবাই মন্টুর মাকে চেনে। দরদভরা আন্তরিক কথাবার্তা আর কথার মিষ্টতার কারণে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। ভিক্ষে-ভক্ষণ করে বেঁচে থাকলেও জীবন সম্পর্কে আশাবাদী চিন্তা ভাবনার জন্য বেতো শরীরেও প্রাণবন্ত ভাবটা চোখে মুখে ফুটে ওঠে। শুধু বারো নম্বরের হাটে নয়। রথতলার হাট আর বাহাদুর মোল্লার হাটে ভিক্ষে করতে যায় মন্টুর মা। ভ্যান চালকদের অধিকাংশ‌ই মুসলমান। তারা মন্টুর মায়ের কাছে ভাড়া দাবি করে না। কিন্তু দু’চার জন হিন্দু ভ্যান চালক যারা আছে তাদের কেউ কেউ পয়সা না দিলে গাড়িতে তুলতে চায় না। তবে খেয়া নৌকোর ভাড়াটা মন্টুর মা দিয়ে দেয়। পারের কড়ি‌ ফাঁকি দিতে নেই। স্বামী মারা গেছে অনেক বছর আগে। একাই শুধু গতরের উপর নির্ভর করে ছেলে-মেয়ে দুটোকে বড়ো করেছে।মেয়ের বিয়ে হয়েছে গরীব ঘরে। দুজনে গ্ৰাম ছেড়ে কলকাতায় থাকে। জামাই সেখানে যখন যে কাজ পায় করে। মেয়ে পাঁচ-ছটা বাড়িতে ধোয়া মোছার কাজ করে। একটা বাচ্চা। শাশুড়ির কাছে থাকে।

বছর খানেক হলো মন্টু বিয়ে করেছে। ঘরে বৌ এসে কী মন্ত্র যে কানে দিল সেই থেকে ছেলে মায়ের উপর খড়্গহস্ত। মাকে ভাত দেয় না, পৃথক করে দিয়েছে। ব‌উটা ভীষণ মুখরা, ছেলে হালে নেশা করা ধরেছে, তাই নিয়ে দু-বেলা ঝগড়া-ঝাঁটি, চেঁচামেচি। এ গ্ৰামে মুসলমানের বাস বেশি। অধিকাংশ‌ই গরীব। চাষবাস আর জনমজুরি করে তল্লাটের লোকেদের জীবন চলে। তবে এলাকায় হিন্দু -মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতির অভাব নেই। উভয় সম্প্রদায় পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে বাস করে। পূর্ব পুরুষরা ও এভাবেই কাটিয়ে গিয়েছে। সেই ঐতিহ্যটি এখনও পর্যন্ত বজায় আছে। হাটে হাটে ভিক্ষে করে দু’তিন-খানা ছোট বড়ো ঝোলাঝুলি ভর্তি করে বিকেলে ঘরে ফিরে রান্না খাওয়া করে মন্টুর মা। শাক-সবজি, চাল-ডাল, থেকে শুরু করে মশলা পাতি,মিষ্টি-মিঠাই কাটা রুটি, ছেঁড়া পরোটা,ভাঙা বিস্কুট, আধপচা ফল,খুচরো পয়সা,হরেক সামগ্ৰী থাকে তার মধ্যে।


মাঝে মাঝে ছেলে এসে হানা দিয়ে হাতের কাছে যা পায় নিয়ে চলে যায়। মা চেয়ে চেয়ে দেখে, বকাবকি করে বটে, সে নিছক না করলে নয় তাই। হাজার হোক পেটের শত্তুর, ফেলবে কোথায়! ভিক্ষে করা জিনিসপত্র টুকটাক ঘরে থাকে সব সময়। তবে টাকা পয়সা ঘরে রাখে না। রাস্তার উত্তর পারে করিম গাজীর কাছে গচ্ছিত রেখে দেয়, প্রয়োজনে নিয়ে আসে। ছেলেকে বিশ্বাস নেই, বন্ধু বান্ধব জুটেছে ক’টা এক‌ই রকম। করিম সাহেব খুব ভালো মানুষ, মধ্য বয়সী বুঝদার অর্থবান ব্যক্তি। এ গ্ৰামের মুসলিম সম্প্রদায়ের সবাই মন্টুর মাকে সমাদর করে। পাল-পার্বণ দিনে তাকে ডেকে খেতে দেয়। তাছাড়া দায় দরকারে সব সময় সবাই এগিয়ে আসে।যখন শরীর সচল ছিল তখন অরন্ধনের দিন চেয়ে-চিন্তে আয়োজন করা মা মনসার পুজোর পান্তা খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে পাড়ার হিন্দু মুসলমান সবাইকে যত্ন করে খেতে দিত মন্টুর মা। এখন পারে না, শরীর দিন দিন অশক্ত হয়ে পড়ছে। নিজের ব্যবস্থা নিজে সব দিন করে উঠতে পারে না। ছেলের বৌ পাড়ায় বলে বেড়ায়, বুড়ি অনেক পয়সা জমিয়েছে। আমরা চাইলে হাতে জল গলে না। এই কথা শুনে বরুণের নতুন বৌ সেদিন কথা ধরেছিল,
‘লোকে এতো খাটাখাটুনি করে হাতে পয়সা জমাতে পারে না, আর ভিক্ষে করে পয়সা জমছে, তাহলে তো সবাই কাজকর্ম ছেড়ে ভিক্ষেই করত।’
বৌ আর কোন কথা বলেনি।

একদিন নেশা করে মন্টু টলতে টলতে মায়ের সঙ্গে ঝামেলা করতে এসেছিল কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গী করে। খবর পেয়ে গাজী পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে এসে ক’টাকে দু-চার ঘা দিয়ে আচ্ছা করে শাসিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে ছেলেগুলো আর এ পাড়ায় ঢোকে না। মন্টুও অনেকটা সামলে গিয়েছে। আর দুটো মাস পরে বর্ষা আসবে। বৃষ্টি -বাদলায় সব হাটের বারে যাওয়া হয়ে ওঠে না। জল কাদায় গ্ৰামের রাস্তা-ঘাটে চলাচল করা মন্টুর মা’র পক্ষে সম্ভব হয় না। শুখ-খরার দিনে যতটা পারা যায় সঞ্চয় করে নিতে হয়। সব দিক থেকে বর্ষার মরশুমে তার খুব দুর্দিন যায়। মাস খানেক হলো বৌ গিয়েছে বাপের বাড়ি।বাচ্চা-কাচ্চা হবে, এখানে দেখবে কে? মন্টুও সেখানে ছিল, দশ-বারো দিন হলো ঘরে ফিরেছে। কাজে গেলে ঝামেলা থাকে না।যেদিন কাজ না থাকে , খাওয়া দাওয়া সব মায়ের কাছে। অথচ কোন দিন একটা পয়সা মায়ের হাতে দেয় না। পারলে হাতে পায়ে ধরে দু-এক টাকা নিয়ে নেশা করতে যায়। মন্টুর মা মনে মনে খুব খুশি।বংশে নতুন বংশধর আসছে।আনন্দে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে দে-দেবতার উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে কী সব বলে যায়।

গত দিন ছিল একাদশী। শরীরটা ভালো নেই। সকালে এক টিপ চাল আর জল খেয়ে বাহাদুর মোল্লার হাটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল মন্টুর মা। ইচ্ছা, সকাল সকাল ফিরে আসবে।বেলা একটা নাগাদ সেলিমের ভ্যানে ঘরে ফিরছিল। হঠাৎ ভ্যানের উপরে মাথা গুঁজে পড়ে গেল।ভ্যান ভর্তি লোক। সবাই মিলে ধরাধরি করে রাস্তার পাশের এক বাড়িতে নিয়ে মাথায় মুখে জলের ছিটে আর পাখার বাতাস দিতে থাকলে একটু পরে চোখ চাইল মন্টুর মা। সেলিম সহ ‌‌কয়েকজন মিলে কোন প্রকারে বাড়িতে পৌঁছে দিল তারা। মন্টু বাড়িতে ছিল না। জ্ঞাতিদের কয়েক জন এসে অর্ধচেতন মন্টুর মাকে ঘরে তুলে নিল। ইতিমধ্যে খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে। হালদার পাড়া, গাজীপাড়া, শেখ পাড়া থেকে লোকজন দেখতে আসছে।যদি খেতে পারে দুটো খাইয়ে নিয়ে ডাক্তার খানায় নিয়ে যাওয়া ঠিক হলো। ততক্ষণে মন্টু ফিরে এসেছে। তার তেমন কোন মাথা ব্যথা নেই।বরুণের বৌদিরা কয়েক জন মিলে কিছু খাওয়াবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো।

ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়ার সময় দিল না। বেলা চারটে নাগাদ মারা গেল মন্টুর মা। অনেকেই চোখের জল ফেলল কিন্তু সবাই মৃত্যুটাকে সুখের মরণ বলে বর্ণনা করল। একটা বেলা ও পড়ে র‌ইলো না, পড়ে থাকলে দুর্ভোগের শেষ ছিল না।! সব পাড়া থেকে অনেকে মিলে সাহায্য তুলে উৎসবের মেজাজে মন্টুর মাকে শ্মশানে নিয়ে গেল।পুরো কাজটার তত্ত্বাবধানে থাকলেন করিম সাহেব। শুধু মাত্র মুখাগ্নির জন্য সঙ্গে ছিল মন্টু। শ্মশান সৎকার থেকে তখনও সবাই ফিরে আসেনি। মন্টুর শ্বশুর বাড়ি থেকে খবর এল, মন্টুর একটা মেয়ে হয়েছে।

তবু প্রাণ নিত্য ধারা [Bengali Story]

শীতকাল। নিস্তব্ধ গভীর রাত। বাদার পুকুর পাড়ের জঙ্গল থেকে, থেকে থেকে একদল শিয়ালের ডাক ভেসে আসছিল। মায়ের চোখে ঘুম নেই, দুরারোগ্য মারণ ব্যাধিতে যন্ত্রণাকাতর নাবালক সন্তানটি মড়ার মতো বিছানা সাপটা হয়ে পড়ে আছে। শিয়রে একটা ক্ষীণ দীপ নিষ্কম্প শিখায় জ্বলে যাচ্ছে।অজানা আশঙ্কায় নানা চিন্তা ‌ মাথায় জট পাকায় নিদ্রাহীন জননীর। রাত্রি নামলে কীসের একটা ভয় এসে গ্ৰাস করে তাকে।

মানুষটা আজ মাস দুয়েক হতে চলল, বাড়ি ছাড়া, কাজের খোঁজে পুব পাড়ার ভাশুরদের সঙ্গে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। উপায় নেই, এ পোড়া মুলুকে বারোমাস কাজের বড়ো আকাল। সে অপেক্ষায় বসে থাকা যায় না, সংসার অচল হয়ে পড়বে। মুমূর্ষু সন্তানের মায়ায় ঘরে পড়ে পড়ে মার খাওয়া পুরুষ মানুষের শোভা পায় না।

হসপিটালের ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছিল, বাড়িতে নিয়ে গিয়ে যেক’টা দিন বাঁচে‌ একটু যত্ন কোরো, যা খেতে চায় সাধ্যমতো খাওয়াতে চেষ্টা কোরো। উপায় নেই, কিছু করার ও নেই। গরীব মানুষের পক্ষে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে বাড়তি ক’টা দিন বাঁচিয়ে রাখার শখ দেখানো বাতুলতা।
দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের দম্পতির তিন সন্তান। বড়ো দুই ছেলে, মেয়েটা ছোট, বছর চারেকের হবে। ছোট ছেলেটাই ক্যানসারে আক্রান্ত। মাস সাতেক আগে ধরা পড়েছে। সরকারি হসপিটালে কিছুদিন চিকিৎসা হয়েছিল, তারপর থেকে বাড়িতে পড়ে পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। তবু ও সংসার তার আপন গতিতে বয়ে চলেছে। যথা নিয়মে দিনের শুরু হচ্ছে, আবার রাত্রি নেমে আসছে। তারি মাঝে কতো আনন্দ, কতো বেদনার তরঙ্গ উঠছে জাগতিক জীবন ধারায়। কোন কিছুর জন্য সময় থেমে থাকে না, কান্না-হাসির মালা পরে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় এগিয়ে চলে ‌ অনন্তের পানে।
গত বছর এই সময়ে ইটভাটার কাজটা ছিল, ছেলের জন্য এ বছর কাজটা ধরে রাখা গেল না; আর ভাটা ও উঠে যাওয়ার পথে। হুটহাট বৃষ্টি-বাদলার কারণে ভাটার কারবার মার খাচ্ছে দারুণ ভাবে।

সরকারি ফ্রি রেশনটাই এখন বাঁচিয়ে রেখেছে ক’টা প্রাণীকে। বড়ো ছেলেটা প্রাইমারীতে যাচ্ছিল, স্কুল থেকে খাওয়াটা তবু জুটত।এখন তাও ও বন্ধ ।অনেক দিন অন্তর অন্তর দুপুরের খোরাকি বাবদ কিছু চাল ডাল পাওয়া যায়, এগাঁয়ের‌ই ছেলে বাদল মাস্টার, না বলব না, সময় মতো সব দিয়ে দেয়। ভাটার ম্যানেজার বাবুকে সমস্ত খুলে বলায় ,বাবু দয়া করে ছেলেটাকে কাঁচা ইট বহন করার কাজে জুটিয়ে দিয়েছে। ছেলে মানুষ, দুপুর পর্যন্ত যা পারে বয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।

স্বামী স্ত্রী হাড়ভাঙা খাটা খাটুনি করে যে কোন রকমে সংসারটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল! ছেলেটার পিছনে বেশ কিছু টাকা পয়সা ব্যয় হয়ে গেল, তার বেশির ভাগটাই ধার ।তবু যদি বাঁচানো যেত ‌তো সব শ্রম‌ সার্থক হতো। ভগবান কেন যে এমন বিড়ম্বনায় ফেলল, দিন রাত মায়ের চোখের জল শুকায় না।বেঁচে থাকার সমস্ত আকর্ষণ‌ই হারিয়ে যাচ্ছে। মা হয়ে এভাবে নাড়ি ছেঁড়া সন্তানের তিলে তিলে মৃত্যু দেখতে দেখতে মায়ের হৃদয় পাষাণ হয়ে গিয়েছে।কী হাসি খুশি মিশুকে মেয়েটা এখন কেমন যেন পাগলি পাগলি চেহারা নিয়েছে।

পাড়া প্রতিবেশীরা আগে প্রায়‌ই আসত, এখন আর তেমন কেউ আসে না। একদা ফুটফুটে প্রাণবন্ত বাচ্চাটার ধুঁকতে থাকা করুণ দৃশ্য দেখতে কার ও ভালো লাগে না। মনে মনে সবাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে যে, এভাবে যন্ত্রণা না দিয়ে ‌ তাড়াতাড়ি যেন তুলে নেয়।

আজ ক’দিন হলো অবস্থা ভীষণ খারাপ। বাড়িতে রান্না-খাওয়া বন্ধ‌ হবার উপক্রম।পলাশের বাপের কাছে খবর গিয়েছে।খবর গেলে কী হবে?ফেরা বললে তো আর ফেরা যায় না, দূরপাল্লার গাড়ি ঘোড়ার ব্যাপার। গত পরশু বিকেলে পলাশের দিদিমা এসেছে, বেচারি একা কী করবে, মেয়েকে সামলাবে না বাচ্চা দুটোকে সামলাবে!

পলাশের ‌বাবা বিশ্বনাথ সেদিন ফিরল দুপুর গড়িয়ে। বাড়ির বাইরে থেকে কান্নার শব্দ কানে আসছিল,ভিতরে ঢুকে দেখল ঘরের দাবাতে বেশ কিছু লোকজন জড়ো হয়েছে। ছেলেটার শেষ অবস্থা। বিশ্বনাথ অপরাধীর মতো মৃত্যুপথযাত্রী সন্তানের পাশে গিয়ে বসে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। সবাই বলাবলি করতে লাগল, বাপের অপেক্ষায় মায়ায় ভরা প্রাণটা বার হচ্ছিল না।

গণেশ চৌকিদার [Bengali Story]

হাল প্রজন্ম ‘চৌকিদার’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়; অথচ এক সময় চৌকিদার‌ই ছিল গ্ৰামের একমাত্র সরকারি‌ প্রতিনিধি। তখন প্রাইমারীতে পড়ি। বেশ মনে আছে। আমাদের গ্ৰামের চৌকিদার ছিল গণেশ সরদার।সবাই এক বাক্যে গণেশ চৌকিদার বলেই ডাকত। শিক্ষা দীক্ষা তথৈবচ, নাম স‌ইটা ভালোমতো করতে পারত।মানুষ হিসেবে অমায়িক। বড়োর কাছে যেমন, ছোটর কাছে তেমন।

এমনিতে সাধারণ ড্রেসে থাকলে ও যখন ডিউটি করত তখন তাকে সরকারি পোশাকে দেখা যেত।খাকি রঙের প্যান্ট-শার্ট,ফুল এবং হাফ দু-সেট‌ই ছিল। কোমরে পিতলের বক্‌লেস যুক্ত চামড়ার বেল্ট এবং হাতে একটা পিতলের পাত জড়ানো হ্যান্ডেল ওয়ালা লম্বা চকচকে লাঠি। বর্ষার মরশুম ছাড়া অন্য যে-সব মরশুমে গ্ৰামে ঘরে চুরি -ডাকাতির উপদ্রব বেড়ে যেত, সেই সব সময়ে গভীর রাতে পাড়ায় পাড়ায় হেঁকে যাওয়া অর্থাৎ চৌকি দেওয়াটাই ছিল চৌকিদারের রাতের প্রধান কাজ। মাঝ নিশিতে পাড়ার পথে পথে ঢুকে ‘হালদারের পো-ও-ও-ও, মোড়লের(মন্ডলের) পো-ও-ও-ও,’ আওয়াজ তুলে টেনে টেনে হাঁক দিত। দস্তুর ছিল, চৌকিদার যখন যে পাড়ায় ওমুকের পো তমুকের পো বলে হাঁক দেবে তখন সেই সমস্ত বাড়ি থেকে বিশেষ করে বয়স্ক মানুষদের গলার আওয়াজ করে বা কাশির মাধ্যমে জানান দিতে হবে যে, বাড়ির লোকজন জেগে আছে। চৌকিদার কিন্তু কারো বাড়িতে ঢুকবে না, পথ দিয়ে হেঁকে যাওয়াই ছিল প্রথা এবং তার প্রত্যুত্তরে সাড়া পেয়ে যাওয়া।

আমাদের গণেশ চৌকিদার তার সরকারি পোশাক খুলে রাখত খুব কম। দিনের ভাগে প্রায় সময় দেখতাম খাকি পোশাকে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতে।গ্ৰামের সবাই তাকে খুব ভালোবাসত। কারও সঙ্গে কোনোদিন ঝগড়া-ঝাঁটি বা সামান্য কথা কাটা কাটি পর্যন্ত করতে দেখিনি। যে যেমন বলত, হাসি মুখে বাবা মা, ভাইবোন‌ সম্বোধনে তার উত্তর দিত। কিশোর বা যুবক বয়সের ছেলে মেয়েদের সম্বো‌ধন করত,’ হালদার ভাই, মোড়ল ভাই, সরদার ভাই’ ইত্যাদি বলে; কম বয়সি মেয়েদের বোন বা দিদি‌ বলে পরিচয় করত। এমনিতেই কথা বলত খুব নিচু স্বরে।

গৃহস্থ বাড়িতে যে মরশুমে যে সবজি ফলত, সব বাড়ি থেকে দু-একটা গণেশ চৌকিদারকে উপহার দিত, সেই উপহারগুলি গ্ৰহণ করার আগ্ৰহ এবং যত্ন দেখলে তার উপর দাতা গৃহস্থের দ্বিতীয় বার দেওয়ার একটা ইচ্ছা থেকেই যেত। তখনকার দিনে চাষ-বাস‌ই ছিল গ্ৰামের লোকের প্রধান জীবিকা; আর এই চাষ ও পোষ মরশুমে বিষয় সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া , মারামারি প্রায়‌ই লেগে থাকত, তার প্রমাণ মিলত সদর আলিপুর কোর্ট কাছারিতে গ্ৰামের মামলাকারী জনগণের উপস্থিতির হার দেখলে । ধান কাটার মরশুমে এই মারামারি খুনোখুনির মাত্রাটা অনেক বেড়ে যেত ।ফলে ওই মরশুমে গ্ৰামে প্রায়‌ই পুলিশ ঢুকত। এছাড়া চুরি-ডাকাতি বা গ্ৰাম্য বিবাদ-বিসংবাদে অনেক সময় গ্ৰামে পুলিশ ঢুকত।

পুলিশ এসে প্রথমেই খুঁজত চৌকিদারকে; কারণ ঘটে যাওয়া ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ পাওয়ার একমাত্র সরকারি সোর্স হলো চৌকিদার। সেকারণে প্রতি গ্ৰামেই থাকত চৌকিদার। পুলিশ এলে আমাদের গণেশ চৌকিদারের হাবভাব যেত বদলে।তখন প্রায়‌ই দেখেছি সেই হাফ-সেট পোশাকটি পরতে।মুখে কথা কম, একটু বেশি মাত্রায় ফিটফাট, ভঙ্গি ঋজু, পুলিশ অফিসারদের পিছনে পিছনে একেবারে অনুগত ভক্তের মতো সারাক্ষণটা লেগেই থাকত। বেচারির নাওয়া-খাওয়া তখন গড়বের হয়ে যেত।

কোন সরকারি ঘোষণা বা গ্ৰাম্য বিচার-সালিশির কোন বিষয় থাকলে,ঢেঁড়ি পিটিয়ে অর্থাৎ একটা পুরোনো ভাঙা ড্রাম (পরিত্যক্ত তেলের জার) বাজিয়ে সারা গ্ৰামে গণেশ চৌকিদার খবরটা প্রচার করে দিত। সে এক মজার ব্যাপার ছিল।বড়োরা চৌকিদারের কথা শুনে সহজে বুঝে নিত কিন্তু কৌতূহলী ছেলেমেয়ের দল তাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরে প্রশ্নে প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে ছাড়ত। গণেশ কিন্তু একটু ও বিরক্তি প্রকাশ ‌করত না। দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আট-দশ ঘন্টা তার গ্ৰামে ঘুরেই কেটে যেত। আশে পাশের গ্ৰামের চৌকিদারদের দেখেছি, সরল মনের হলে ও সবাই গণেশ চৌকিদারের মতো ছিল না।গরীব এবং মূর্খ ছিল বটে তবে মনুষ্যত্ব এবং মানবিকতায় তার মতো মানুষরা ছিল সমাজের সম্পদ, গ্ৰামের অহংকার।চৌকিদার শব্দটির আধুনিক প্রতিশব্দ হয়েছে গ্ৰাম -সহায়ক। গ্ৰামের কেউই তাকে কোনদিন কাছাকাছি পায় না ; তার কর্মক্ষেত্র হলো গ্ৰাম পঞ্চায়েতের অফিস।যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটে গেছে, অনেক কিছু লুপ্ত হয়ে গেছে। গণেশ চৌকিদার ও পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছে। সে আজ কতো বছর হয়ে গেল!

করোনা কালে [Bengali Story]

লকডাউনের জেরে কাজটা ছেড়ে গেল।বাড়ি শুদ্ধ মাথায় হাত, কী করে চলবে সংসার! পাঁচ পাঁচটা পেট, বাড়িতে বৃদ্ধা মা, দুই ছেলে প্রাইমারিতে পড়ে; সরকারি ফ্রি রেশনে কিছুটা সামলানো যায় বটে কিন্তু সে আর কতটুকু! অসুস্থ মায়ের সারা বছরের ওষুধ, আর ক’টা মাস পরে বড়ো ছেলেটা হাইস্কুলে যাবে; তার উপর সারা বছরের ডাক্তার-বদ্যি খরচ, নিজেদের পোশাক পরিচ্ছদ, লোক-লৌকিকতা, কোথা থেকে হবে?

দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ, ছেলে দুটি ঘর-বারান্দা করে খেলে বেড়াচ্ছিল; মায়ের কাছে কিছুক্ষণ বসে থেকে ধীরে ধীরে উঠে এলো সুধাময়।শরীরটা ভালো নেই, আজ নিয়ে দুদিন হলো জ্বর জ্বর ভাব, টিপ্ টিপ্ করে মাথার যন্ত্রণাটা হয়েই চলেছে। হৈমন্তীর খোঁজে রান্নাঘরে গিয়ে বসল।স্বামীর দিকে তাকিয়ে হৈমন্তী একটু থমকে গেল, জিজ্ঞেস করল,’তোমার কি শরীর খারাপ?’ খানিক চুপ থেকে সুধাময় বলে,’ভালো লাগছে না, মাথার যন্ত্রণাটা সরছে না।’

তিন দিনের মাথায় আর চেপে রাখা গেল না, কাশি শুরু হলো। হৈমন্তী বুদ্ধি করে আশপাশের কাউকে কিছু জানাল না; করণ এই করোনা আবহে সবাই অহেতুক সন্দেহ করবে আর দূরত্ব বাড়াবে।দক্ষিণ পাড়ায় তাদের পারিবারিক বন্ধু অনন্তের কাছে গিয়ে ব্যাপারটি খুলে বলল।দায়-দরকারে বিপদে-আপদে অনন্ত‌ই এ-বাড়ির ভরসা।অনন্তের ছোট ভাই জয়ন্ত ফোন করে কোথায় কী জানাল হৈমন্তী কিছুই বুঝল না, চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে জনা দু’য়েক লোক এলো, সঙ্গে অনন্তেরা দুই ভাই। সুধাময়কে তারা একটা গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গেল। ব্যাপারটি পাড়ার লোকের কাছে আর গোপন থাকল না।কিন্তু কেউই বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষল না; বাইরে থেকে কানা-ঘুষো চলতেই থাকল।

আরো তিনদিন পর রিপোর্ট এলো, সুধাময়ের করোনা পজেটিভ। পাড়ায় হৈমন্তীরা একঘরে হয়ে পড়ল। ব্যতিক্রম একমাত্র অন্তত। মাকে কিছু জানাল হলো না, অভ্যাস বশত মা কিন্তু বৌমার কাছে ছেলের কথা বার বার জানতে চাইল,কাজে গেছে বলে হৈমন্তী ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল।ঘরে বাইরের চিন্তায় চিন্তায় হৈমন্তীর দিশেহারা অবস্থা। বাড়ির বাইরে যাওয়া একেবারেই বন্ধ।দূর থেকে পাড়া প্রতিবেশীদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টির সামনে নিজেকে মেলে ধরতে ইচ্ছা করে না তার। এত দুঃসহ দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যে মানুষ যে বেঁচে থাকে তা নতুন করে উপলব্ধি করতে পারল হৈমন্তী।

মানুষটা কোথায় কেমন রইলো নিজের চোখে একবার দেখতে ও পেল না, দুচোখ বার বার জলে ভরে যায়; ভাবলে হাত-পা গুটিয়ে আসে। তার উপর গত কাল থেকে শাশুড়ির জ্বর। হৈমন্তী আর ভাবতে পারে না। সন্তান দুটিকে আঁকড়ে ধরে স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় আশা-আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটতে লাগল তার।

প্রবোধ কুমার মৃধা | Probodh Kumar Mridha

তিন্নির ফড়িং আর মানুর কারসাজি | গল্পগুচ্ছ ২০২৩ | Bengali Story 2023

মোঃ ওয়াসিউর রহমান | কবিতাগুচ্ছ ২০২৩ | Bengali Poetry 2023

মহা রফিক শেখ | কবিতাগুচ্ছ ২০২৩ | Bengali Poetry 2023

বিকাশ চন্দ | কবিতাগুচ্ছ ২০২৩ | Bengali Poetry 2023

মন্টুর মা | তবু প্রাণ নিত্য ধারা | আছে দুঃখ আছে মৃত্যু | গণেশ চৌকিদার | চৌকিদার এর কাজ কি | চৌকিদার বেতন | চৌকিদার ট্যাক্স | গ্রাম চৌকিদারি আইন ১৮৭০ | চৌকি শব্দের অর্থ কি | চৌকিদার কি সরকারি | চৌকিদার অর্থ কি | শব্দদ্বীপের লেখক | শব্দদ্বীপ | সেরা বাংলা গল্প | গল্প ও গল্পকার | সেরা সাহিত্যিক | সেরা গল্পকার ২০২২ | বাংলা বিশ্ব গল্প | বাংলা গল্প ২০২২

Ganesh Chowkidar | chowkidar 1974 | chowkidar salary | chowkidar wikipedia | chowkidar job | top latest bengali story | poetry collection online | poetry collection in urdu | poetry collection submissions | poetry collection clothing | new poetry | new poetry 2022 | new poetry in hindi | new poetry in english | new poetry books | new poetry sad | new poems | new poems in english | world bengali story | new poems in hindi | new poems rilke | new poems in urdu | bangla poets | indian poetry | indian poetry in english | indian poetry in urdu | indian poems | indian poems about life | indian poems about love | bengali story new | indian poems about death | bengali story | bengali story books for child pdf | bengali story books for adults | bengali story books | bengali story books for child | bengali story books pdf | bengali story for kids | bengali story reading | short story | short story analysis | short story characteristics | short story competition | short bengali story definition | short story english | short story for kids | short bengali story generator | bengali story 2023 | short story ideas | short story length | long story short | long story short meaning | long bengali story | long story | long story instagram | story writing competition | story writing competition topics | story writing competition for students | story writing competition malayalam | story writing competition india | story competition | poetry competition | poetry competitions australia 2022 | poetry competitions uk | poetry competitions for students | poetry competitions ireland | poetry competition crossword | writing competition | writing competition malaysia | writing competition london | bengali story writing | bengali story dictation | writing competitions nz | writing competitions ireland | writing competitions in africa 2022 | writing competitions for high school students | writing competitions for teens | writing competitions australia 2022 | writing competitions 2022 | writing competitions uk | bengali article writing | bangla news article | bengali story news| article writing on global warming | article writing pdf | article writing practice | article writing topics | trending topics for article writing 2022 | what is article writing | content writing trends 2022 | content writing topics 2022 | Bangla Prabandha | Probondho | Definite Article | Article Writer | Short Article | Long Article | Bangla kobita | Kabitaguccha 2022 | Galpoguccha | Galpo | Bangla Galpo | Bengali Story | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder

Leave a Comment