New Bengali Story 2023 | করিমের একদিন | তালাল উদ্দিন

Sharing Is Caring:
BENGALI STORY

করিমের একদিন – তালাল উদ্দিন [Bengali Story]

( বিখ্যাত ফরাসি গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, কবি আলফাঁস দুদের দি লাস্ট ক্লাস বা লাস্ট লেসন এর থিম অবলম্বনে)

— করিম, বাবা, তুমি কী স্কুলে যাবে না? স্কুলের সময় যে হয়ে এল।
করিমের মা প্রতিদিনই করিমকে এভাবে স্কুলে যাওয়ার জন্য তাগিদ দেন। করিম ও বাধ্য ছেলের মতো স্কুলে যায়। কোন ওজর আপত্তি পেশ করে না। কিন্তু আজ সে একটু ভারি গলায় বলে ওঠল, এত তাড়া দিচ্ছেন কেন? আমি তো প্রতিদিনই স্কুলে যাই। আপনি কী দেখেন না? হুঁ, আমি সবকিছুই দেখি। তোমার তো স্কুলে যাওয়া আর আসাই হল বড় কাজ। কোনদিন তো পড়াশোনা করতে দেখলাম না। দেখো মা, এত দেখাদেখির সময় নেই আমার। স্যার এক বললে আমি ও বলি এক। আমি চললাম কিন্তু মা। করিমের মা পেছন থেকে বলতে থাকেন– “গরম ভাত রানছি। চারটা ভাত খেয়ে যা বাপ।শরীরে বল পাবি। করিম মায়ের কোন কথাই কানে তুলে না। হনহন করে স্কুলের পথ ধরে হেঁটে যেতে থাকে।”

আজকের আকাশটা বেশ মেঘাচ্ছন্ন। কিন্তু বৃষ্টি ও হচ্ছে না আবার মেঘ সরে রোদ ও আসছে না। অবস্থাটা ধরুন আরাফী ধরনের-বেহেশত ও দোযখের মধ্যবর্তী স্থান। তাই বৃক্ষরাজি থেকে মানবকুল পর্যন্ত বৃষ্টির প্রার্থনা করছে চাতকের মতো। পাখির কিচির মিচির, ছেলেমেয়েদের কোলাহল আজ আর লক্ষ করা যাচ্ছে না। চারদিকে কেমন যেন এক গুমোট পরিবেশ আর গ্রীষ্মের মধ্য দুপুরের মতো ঝিমুনি ভাব বিরাজ করছে। গাছের পাতাগুলো দখিনা বাতাসে একটু ও নড়ছে না। করিমের মতো ছোট বাচ্চাদের মনে আজকের এ সভ্যতার মানুষদের পাপের তসবির কোন কালে ফুটে ওঠবে না। আশেপাশের মানুষেরা তাই তাদের নিরীহ, গোবেচারা, নাদান বলে অভিহিত করে। অবশ্য করিমের মতো কিছু মানুষ এ স্বার্থান্ধ জগতে থাকাটা ভালো। এটা এমন এক সময় যেখানে স্বয়ং বিধাতা এসব মানুষদের মন থেকে পাপিষ্ঠ আত্মার লালসালুদের কুঞ্চিত করে মেরে দেন।

করিমের পা দুটি আজ কোনমতেই করিমের হুকুম তামিল করছে না। যতই সে দ্রুত হাঁটতে চায় ততই সে থমকে দাঁড়ায়। স্কুলটাকে আজ তার আলোকবর্ষ দূরের কোন গ্রহ বলে মনে হচ্ছে। তার খেয়ালে এমনটি ও আসছে যে যদি আজ স্কুলটা কামাই করা যেত। এভাবে নানা চিন্তার জাল বুনতে বুনতে করিম পথ চলতে লাগল। হঠাৎ সে দেখতে পেল কতগুলো পাকিস্তানি সৈন্যরা শারীরিক কসরত করছে বেশ উদ্যমে আর পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত “কওমী তারানা” গাচ্ছে। করিমের কাছে এসব অনেক দুর্বোধ্য ঠেকে। তবুও তার মনে এক নব আশা উদয় হল। সে ভাবে বড় হয়ে সে সৈনিক হবে। দেশের জন্য যুদ্ধ করবে। জীবন ত্যাগ করবে। লতিফ স্যারের প্যানপ্যানানি থেকে ওসব ঢের ভালো। করিমের যত সৃষ্টিছাড়া ভাবনা। করিম পথ চলতে লাগল। রাস্তার ধারে এক আনকোরা রেন্ট্রি গাছকে নুয়ে পড়তে দেখা গেল। কে যেন তার দেহে অদৃশ্য তুরপুনের ফলা গেঁথে দিয়েছে। সে যেন বলতে চাইছে, তোমরা কেন তন্দ্রাতলে বিলীন হয়ে আছো? জলদি ওঠ। শোকগীতি আর ভালো লাগেনা। বজ্রমুষ্টি ধরে সামনে এগিয়ে চল আর রাক্ষসদের হাত থেকে এ দেশকে বাঁচাও।

করিম গাছটির পাশে গিয়ে দাঁড়াল আর আশেপাশে এমন কোন অবলম্বনও খুঁজে পেলনা যেটা দ্বারা গাছটিকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। গাছ তোমার কী হয়েছে? কে মেরেছে তোমাকে? আমার কাছে বিচার দাও৷ আমি তাকে প্রচুর শাস্তি দেব– বলতে লাগল করিম। কিন্তু কোন সুপার জাদুবিদ্যা বা মিরাকল ছাড়া গাছের দ্বারা কথা বলা মোটেই সম্ভব নয়। যার ফলে কোন উত্তর মিলল না।

করিম আবার রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। তার পরনে আজ খয়েরী রঙের আচকান। মাথায় সাহেবী টুপি। আর তার পায়ের শোভা বর্ধন করে আছে আধুনিক ফ্যাশনধারী কোন কোম্পানির দামি চপ্পল। মোট কথা ছিমছাম পোশাক পরেছে করিম। কোন দিকে না তাকিয়ে হাতে একতাড়া বইপত্র নিয়ে অনবরত সে হেঁটে চলছে। তখন রাস্তা ধরে এক পাকসেনা হেঁটে যাচ্ছিল। হাতে তাঁর অত্যাধুনিক রাইফেল।।

ঐ দূরে এক যুবককে মান্ধাতা আমলের একটা রেডিও নিয়ে হেঁটে আসতে দেখা গেল। সে রেডিওতে কী যেন শুনছে আর ভয়ানকভাবে মাথা দুলাচ্ছে। মনে হচ্ছে আধুনিকতার ভাইরাস ঢুকেছে তার মনে। তবে ঠাহর হচ্ছে সে হয়তোবা সকালের খবর শুনছে। আর দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর শুনার জন্য এ রকম একটা রেডিওর বেশ প্রয়োজন ও আছে। একসময় করিম লোকটির মুখোমুখি হলো আর রেডিওতে সংবাদ প্রচার ও শুরু হয়ে গেল। করিম লোকটিকে সংবাদটি শোনানোর জন্য অনুরোধ জানালো। লোকটি তাকে জানাল যে, তোমার স্কুলের সময় তো চলে যেতে পারে। তা হউক। আপনি এ নিয়ে চিন্তা করবেন না। অন্তত দুবার বলতে বাদ রাখেনি করিম। তারপর রেডিও থেকে নারী কন্ঠের এক মিহি আওয়াজ ভেসে আসল এবং যতটুকু শুনতে পারা গেল: “আসসালামু আলাইকুম। সবাইকে সকাল ৯টার খবরে স্বাগতম। ইসলামী প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তানের গভর্নর কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় এক নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা পেশ করেন। রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তিনি তাঁর বক্তব্য বলেন, ‘সরকারি কাজের জন্য এই প্রদেশের লোকেরা নিজেদের ইচ্ছামতো যে কোনো ভাষা ব্যবহার করতে পারে। যথাসময়ে এবং এই প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সুচিন্তিত মতামতের মাধ্যমে তাদের ইচ্ছানুসারেই এই প্রশ্নের মীমাংসা হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশের যোগাযোগের ভাষা হিসেবে একটি ভাষা থাকবে এবং সে ভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়৷’ (তথ্যসূত্রঃ songramernotebook. com )

বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের ছাত্র শিক্ষকদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহর এই ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে, ছাত্রদের মধ্য থেকে নো, নো, ধ্বনি উঠতে থাকে। ছাত্রনেতা আবুদল যতিন এবং আহসানের কণ্ঠের নো, নো, ধ্বনি উপস্থিত ছাত্রদের কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে।”
করিম আবার রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল। তারপর সামনে গিয়ে সে এক জটলা দেখতে পেল। এক লোক আসরের মধ্যমণি হয়ে লোকদের কি যেন শুনাচ্ছে। আরো খানিকটা অগ্রসর হওয়ার পর করিম লোকটির মধুর কন্ঠ স্পষ্ট শুনতে পেল। বড় দরদ কন্ঠে তিনি একেকটি গান তুলছেন। আর লোকদের চোখ অশ্রুসজল হচ্ছে। কারো কারো চোখ দিয়ে অশ্রুর ধারা ঝরছেই তো ঝরছে। তার কোন বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। করিম দেখল, এ তো বাউল মামা।সেদিন ও তাকে এমন একটি সুন্দর গান শুনিয়েছিলেন। করিম বেশ মুগ্ধ হয়েছিল তার গান শুনে। সেদিন ও তিনি করিমকে বেশ তেজি কন্ঠে বলেছিলেন, ভাগ্নে করিম নিকট ভবিষ্যতে আমাদের সব চাট্টিবাট্টি গুটিয়ে ভিন দেশে চলে যেতে হবে। সামনের দিনকাল খুব খারাপ যাবে। করিম খুব অবাক হয়ে যায় তার যত সৃষ্টিছাড়া কথা শুনে। আর বোকার মতো তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আমরা কেন ভিন দেশে যাব?- এ প্রশ্নটি করার ও সে আর সাহস করতে পারে না। বাউল মামা খুব দরদের সাথে একটা গান ধরলেনঃ

রাক্ষস আইলো এই দেশেতে
লুইট্যা নিয়া যাইতে
লুইট্যা নিছে আরো নিবো
থাকলে রে তুই কোথারে,
এ দেশের মানুষ আজ এত বোকা নি রে
গোলা ভরা ধান দিয়ে দেয়
বুঝে না তো ক্ষতি রে
বুঝে না তো ক্ষতি।।

করিম খুব মনোযোগ দিয়ে গানটি শুনল। দ্রোহ ও দুঃখের সম্মিলন হয়েছে তাতে। এক লোক গুনগুন করে গানটি গাচ্ছে। আরেক লোক ভরাট কন্ঠে বলে ওঠল, সক্কলে শুইনা রাইখো ভাইয়েরা। অগরে আমরা অনেক দিছি। আর দিতে পারুম না। আমরা কি এমনি এমনিই দেশটা স্বাধীন করলাম। পাকিস্তান বানাইলাম। আমাদের ন্যায্য হিস্যা আমরা আদায় করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। লোকেরা তারপরে আসরের মধ্যখানে বাউল মামার রাখা কাপড়ে টাকা ফেলে দিয়ে চলে গেল। তাই জটলা ভঙ্গ হল। বাউল মামা কাপড় থেকে টাকা তুলছেন আর পেছন থেকে বলছেন, আমার গান শুনলা তো মিয়ারা। এবার মাঠে কাজ করা শুরু কর। এতে করিম ও তাকে সঙ্গ দিল। তিনি আজ বেজায় খুশি।

স্কুলের এক পাশে সালাম মিয়ার একটা টঙের দোকান আছে। আজ তার দোকানে অনেক পত্রিকা বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতাদের ভিড় সামলাতে তাকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাকে সাহায্য করতে এসেছেন তার ছোট ভাই কাশেম। ছেলেটা বেশ ধূর্ত। ডাহা মিথ্যা বলতে ও কসুর করেনা। এভাবে সে ঠকায় ক্রেতাদের। আর এদিকে সালাম মিয়া তার পত্রিকার এমন কাটতি দেখে যারপরনাই খুশি হয়েছেন। লতিফ স্যারের ছোট ভাইকে ঐ দোকান থেকে একটা পত্রিকা কিনতে দেখা গেল। আজকের তাজা খবর তিনি মিস করতে চান না। যদি ও পত্রিকাটা আগের দিনের।এর জন্য দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা দায়ী।

করিম জলদি স্কুলের পথ ধরে হাঁটতে থাকল। চেনাজানা স্কুলটাকে আজ কেমন যেন অপরিচিত মনে হচ্ছে। ছাত্রদের কিচিরমিচির ও বেঞ্চ নড়াচড়ার শব্দ, লতিফ স্যারের মৃদু ভৎর্সনা ও বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা, ইমরান স্যারের হাঁকডাক কিছুই শোনা যাচ্ছে না আজ। তবে কী আজ শুক্রবার? তবে কী স্কুলে জানাজার নামাজ হচ্ছে? এসব নানা হাবিজাবি জিনিস ভাবতে থাকলো করিম। বাইরে থেকে সে দেখতে পেল তার সব সহপাঠীরা নিজ নিজ আসনে বসে আছে। আর লতিফ স্যার ক্লাসে পায়চারি করছেন। অনুমতি নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করল করিম। লতিফ স্যার বললেন, তুমি আজ একটু দেরি করে ফেলেছ করিম।তাই তোমাকে ছাড়াই আমরা ক্লাস শুরু করে দিয়েছি। স্যার মাফ করবেন একটু দেরি হয়ে গিয়েছে, বলল করিম। তারপর নিজের আসনে গিয়ে বসে পড়ল। লতিফ স্যারের পোশাক দেখে করিমের মনে বেশ খটকা লাগলো। জেলার বড় পরিদর্শক সাহেব আসলে যেমন পোশাক পরতেন আজ ও তেমনটি করেছেন লতিফ স্যার। সাদা ধবধবে শার্ট, তার ওপরে একটা ধূসর কোর্ট সাথে নীল টাই, পায়ে কোন দামি কোম্পানির জুতো। মোদ্দা কথা বিলেতি পোশাক পরেছেন লতিফ স্যার। তাই স্যারকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো স্যারের চেয়ারের পাশে কতগুলো দামি চেয়ার রাখা আছে যা সাধারণত নবীনবরণ বা ফেয়ারওয়েলের সময় রাখা হয়। এক তোড়া রজনীগন্ধা হাতে নিয়ে এগুলোতে বসে আছেন বৃদ্ধ হাবিবুল্লাহ থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান মেম্বার সহ অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। সবাইকে খুব বিষাদগ্রস্ত মনে হচ্ছে। লতিফ স্যার সে একই ভঙ্গিমায় চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “বাচ্চারা আজই তোমাদের শেষ বাংলা ক্লাস। কাল নতুন উর্দু স্যার স্কুলে যোগদান করবেন। তিনি তোমাদের উর্দু শিখাবেন। আশা করি তোমরা মনোযোগ দিয়ে উর্দু ভাষা শিখবে। তোমাদের ওপর জোর করে এটি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।” কথাগুলো ছিল করিমের কাছে বজ্রপাতের মতন। ওহ! তাহলে পত্রিকায়ও একই খবর পড়ছিলেন লতিফ স্যারের ভাই। মনে মনে ভাবল করিম। করিমের শেষ বাংলা ক্লাস। অথচ করিম এখনো বাংলা বর্ণমালা শিখতে পারেনি। বোধহয় আর পারবেও না কোনদিন। করিম পড়া না শেখে যে ভুল করেছিল তার জন্য অনুতপ্ত হল। কিছুক্ষণ পূর্বে যে বাংলা বইগুলোকে স্রেফ জঞ্জাল, বিরক্তিকর বলে মনে হয়েছিল। এখন সেগুলোকে মনে হচ্ছে যেন অনেক পুরনো বন্ধু, যেন হীরের টুকরো। কিন্তু হায়! আজই শেষ এ পাঠচক্র আর লতিফ স্যারের শেষ বাংলা ক্লাস। এসব কথা ভেবে ভেবে মনে মনে সে খুব কষ্ট পেল আর দু’নয়ন ভিজে গেল অশ্রুজলে। সে ভুলে গেল স্যারের বেতের লাঠির কথা। করিম এখন বুঝতে পারল কেন গ্রামের লোকেরা স্যারের পাশে বসে আছে। এবং তাদের চোখেমুখে কষ্টের রেখা দেখতে পাওয়া গেল। তারা জীবনে কোনদিন স্কুলে যাননি। শেখেননি বাংলা ভাষা। স্যারের ক্লাসে উপস্থিত হয়ে তারা স্যারের দীর্ঘ ৩০ বছরের শিক্ষকতা জীবনের সম্মান জানাতে এসেছেন। সম্মান জানাতে এসেছেন তাদের ভাষা ও দেশের প্রতি। লতিফ স্যার সে একই ভঙ্গিমায় বলতে থাকলেন, শোন বাচ্চারা, জেলার পরিদর্শক সাহেব আজ তোমাদের স্কুল পরিদর্শন করতে আসবেন। তোমরা তার সাথে কোন বেয়াদবি করবে না। তাকে মান্য করা আমাদের সমাজী দায়িত্ব। যে অন্যকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে না সে নিজে ও কোনদিন শ্রদ্ধা ও সম্মান আশা করতে পারেনা। তবে করিম স্যারের সাথে একমত হতে পারল না। সে মনে করে, যারা অন্যের অধিকার কেড়ে নিতে চায় তাদের সম্মান দিতে নেই। এসব পাষন্ড জেবুদের এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু করিম হল ইন্ট্রোভার্ট টাইপের ছেলে। তাই কথাগুলো তার মনেই থেকে গেল।

এক অজানা আশঙ্কা করিমের মনের ওপর ভর করল। স্যারের ড্রেস দেখে করিম যা ভেবেছিল তাই হয়েছে। আর এ জন্যই বুঝি রাস্তার ধারে প্রায় ডজনখানেক পাক সেনা সেনা ‘কওমী তারানা’র সুর ধরেছিল। আর শারীরিক কসরত করছিল। ফের স্কুলটাকে এক জনশূন্য নগরী বলে মনে হল। যেন সূক্ষ্ম এক সূচ পড়লে ও বুঝি তার শব্দ শোনা যাবে। লতিফ স্যার তার ক্লাসকে সাবধান করলেন। করিম দেখল একটা সরকারি জিপ গাড়ি এসে স্কুলের সামনে এসে থামল। করিমদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক গেছেন পরিদর্শক সাহেবকে অভ্যর্থনা জানাতে। কিছু তোষামোদি লোককে দেখা গেল তাকে পাহাড়া দিয়ে নিয়ে আসতে। তখন কিছু পাকসেনারা ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন পাকসেনারা সমস্ত স্কুলটাকে তাদের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। সবাই তাদের দায়িত্ব তাই ঠিকমতো পালন করছে। কোন অবহেলার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরিদর্শক সাহেব হেডস্যারের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিলেন। ভালোমতো আপ্যায়নের ও ব্যবস্থা করা হয়েছে তার জন্য।

প্রায় বারোটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। তখন পরিদর্শক সাহেব করিমদের ক্লাসরুমে প্রবেশ করলেন। ক্লাসের সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানালো। তিনি তখন মোলায়েম কন্ঠে বললেন, ছোট্ট সোনামণিরা, তোমাদের নিজ নিজ আসনে তোমরা বসে পড়। আগামীকাল থেকে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু শিক্ষা দেওয়া হবে। তোমাদের নতুন উর্দু স্যার কাল থেকে স্কুলে যোগদান করবেন এবং যথারীতি পাঠদান করবেন। আশা করি তোমরা ভালোভাবে উর্দু শিখে পাকিস্তানের একতা ও সংহতি বজায় রাখবে এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। সরকারের স্কুল ভিত্তিক পরিদর্শনের অংশ হিসেবে আমার এখানে আসা। তোমাদের কারো কিছু বলার থাকলে নির্দ্বিধায় বলতে পারো। করিম হাত তুলল এবং তাকে কথা বলার অনুমতি দেওয়া হল। সে বেশ তেজি কন্ঠে বলতে লাগল, স্যার, উর্দু হল ভিনদেশী ভাষা আর বাংলা হল আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের মানিক, আমাদের রতন। ওটাকে ছেড়ে কিভাবে আমরা উর্দু ভাষা শিখতে পারি? আর মাতৃভাষা ছাড়া কোন শিক্ষার পূর্ণতাপ্রাপ্তি হয়না। পরিদর্শক সাহেব এতটুকুন ছেলের এত বাছ বাছ-বিচার দেখে তাজ্জব বনে গেলেন এবং বেশ তারিফ ও করলেন। তার সাথে এসব বলতে ও কসুর করলেন না যে, “শোন ছোট্ট সোনামণিরা, তোমাদেরকে নিশ্চয়ই এসব বুঝিয়েছেন ঐসব পচা বুদ্ধিজীবীরা আর কিছু বখে যাওয়া শিক্ষকেরা। তারা কানাডা সুইজারল্যান্ডের উদাহরণ টানেন। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সবাই ভালো থাকবে।” এ বলে তিনি ক্লাস থেকে বের হয়ে হনহন করে স্কুল গেইটের দিকে যেতে থাকেন।তার পেছনে যাচ্ছে মোসাহেবের দল।

তবে স্কুলের শিক্ষকেরা করিমের এ আকস্মিক দৃঢ়তাকে সমর্থন করতে পারলেন না। স্বয়ং লতিফ স্যার ও এ থেকে বাদ গেলেন না। নেহায়েত গ্রামের এক প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলো বলে কোন ঝড়, টর্নেডো, স্লাইকোন কিছুই ঘটল না। এবার করিমের পড়া বলার পালা। করিম একেবারে মূক হয়ে গেল। কেননা সে যে পড়া শিখে আসেনি।কিছুই জানেনা সে।তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। বুকে তার ধুকধুকানির স্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পেল। লতিফ স্যার বললেন, আমি তোমাকে বকব না করিম। তুমি অবশ্যই অনুশোচনা করবে। আজ নয়, আগামীকাল শেখব বলে অযথা সময় কাটাতে। এখন দেখো আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। পুরো বাঙালি জাতির জন্য এ কথাটি সত্যি। যখন একজন বিদেশি তোমায় প্রশ্ন করবে, তুমি নিজেকে কিভাবে বাঙালি বলে মনে কর? তোমার বাঙ্গালিত্বের কী প্রমাণ আছে? তখন তুমি কী উত্তর দিবে? বরং একেবারে ‘থ’ বনে যাবে আর জুতসই কোন উত্তরই তোমার মনে আসবে না। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন তুমি জ্বলন্ত আগুনের নিচে ও লুকিয়ে থাকতে ভয় করবে না। বাচ্চাদের পড়ালেখার ব্যাপারে তাদের অভিভাবকদেরও কোন সদিচ্ছা ছিলো না। তারা চাইত তাদের ছেলেমেয়েরা যেন ঢাউস সাইজের কারখানায় কাজ করে যাতে কিছু বাড়তি অর্থ- কড়ি আসে। তাদের যদি প্রশ্ন করা হয় পড়ালেখা মানে কী? তারা কোন রাখঢাক না করেই উত্তর দিবে পড়ালেখা এমন চিজ যা দিয়ে অর্থ উপার্জন করা যায়, গাড়ি -বাড়ি করা যায় এবং আরো নানা হাবিজাবি।।

টীকা

কওমী তারানা – কওমী তারানা (পাক সর জমীন হিসেবে ও পরিচিত) হল ইসলামি প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত। ১৯৫২ সালে হাফিজ জলন্ধরী এটি রচনা করেন। তার ও পূর্বে অর্থাৎ ১৯৪৯ সালে আহমদ গোলাম আলী ছাগলা এর সুর প্রদান করেন। ধ্রুপদী উর্দু ভাষায় রচিত হলে ও এটি অত্যধিক ফার্সি প্রভাবিত।

তালাল উদ্দিন – Talal Uddin

New Bengali Story 2023| লোকের কথা | মনসুর আলি

Bengali Story 2022 | নকুল পাগলা | প্রবোধ কুমার মৃধা

Bengali Story 2023 | পরিচারিকা পাপিয়া | প্রবোধ কুমার মৃধা

Bengali Story | কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা | গল্পগুচ্ছ | 2022

bengali story | short bengali story analysis | short bengali story characteristics | short bengali story competition | short bengali story definition | Best Bengali Story | Top Bengali Story | World Bengali Story | International Bengali Story | short bengali story english | writing competitions ireland | bengali story writing practice | bengali story writing topics | trending topics for article writing 2022 | bengali story trends 2022 | content writing topics 2022 | Bangla Prabandha | Probondho | Definite Article | Article Writer | Shabdodweep bengali story | Galpoguccha | Galpo | Bangla Galpo | Bengali Story | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder | bengali story pdf download | bengali story audio book | bengali story audio download

Leave a Comment