New Bengali Story 2023 | কুত্তা | শওকত নূর

Sharing Is Caring:
BENGALI STORY

শওকত নূর – সূচিপত্র [Bengali Story]

কুত্তা – শওকত নূর [Bengali Story]

মাংসের পুটলি পাশে নিয়ে বসেছিল নফর মিয়া। ধনুক বাঁকা শরীরে মাথাটা নিচু করে বিড়িতে কষে টানের ফাঁকে খুকখুক করে কাশছিল, আর হাঁপ ধরা কণ্ঠে কথা বলছিল বস্তিবাসী তেজারত মিয়ার সাথে। দুজনের বয়সের পার্থক্য দশের কাছাকাছি হবে। নফর মিয়ার উনষাট হলে তেজারত মিয়ার উনসত্তর। তেজারত মিয়া বস্তির অদূরের সীসার তৈজস তৈরির কারখানায় শ্রমিকের কাজ করে। নফর মিয়া পার্শ্ববর্তী বাড়ির দারোয়ান। থাকে বাড়ির চৌহদ্দির এক গোডাউন ঘরে। বদলি দারোয়ান থাকায় সময়ের ফাঁক ফোঁকরে সে এসে সীসা কারখানার নিকটস্থ এক পরিত্যক্ত পথে পড়ে থাকা ভাঙ্গা বেঞ্চির ওপর বসে। দুজন মিলে সময় নিয়ে গল্প গুজব করে, পান বিড়িতে মত্ত হয়ে ওঠে।

আজ তেজারত মিয়ার কারখানায় ছুটি। অতএব, নিশ্চিন্তে আয়াস করে বসে নফর মিয়ার কথায় কান ধরে রাখছে সে। হিজিবিজি কথার ফাঁকে বিড়িতে সুখ টান দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ উবু হয়ে কাশল নফর মিয়া। প্রায় বেহুশ অবস্থা। তেজারত মিয়া তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে আছে তার কাশি-বিধ্বস্ত মুখমণ্ডলের দিকে। সে ঘন ঘন বলতে লাগল, ফাল্গুন মাসতো, কাশিমাশির সিজন এইডা। একবার এই মাসে আমারও মারোত্মক কাশি হইছিল। কাশতে কাশতে গলার ভিতরদেশ ফাইটা রক্ত বাইর হইয়া পড়ছিল। তহন আবার কলকি খাইতাম। এই সিজনে এমনতর হয়। এইবার নাহি আবার কোন ভাইরস পোকার উপদ্রব বাড়ছে।

হঠাৎই নিস্তেজ হয়ে গেল নফর মিয়া। কাশি খানিকটা দম নিলেও মাথা নিচু করে রইল সে। কিন্তু পাশেই উচ্চারিত এক মেয়েলি কণ্ঠ নাড়িয়ে দিল তাকে, বাইজান, আপনের মাংসর পোটলা কিন্তুক কুত্তায় খাবো। জরুলি সামলাইন। এইভাবে মাংস লইয়া বহন লাগে না। কুত্তায় খাবলা মারছিল বইলা। ওই মরার কুত্তা, যা, যা কইতাছি!

নফর মিয়া কোনমতে প্রথমে ঘাড় ও পরে শরীর ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল অচেনা এক মহিলা তার পাশে দাঁড়ানো। বেশভুশায় ধরা যায় আশপাশের কোনও বাড়ির গৃহকর্মী হবে সে। এখনও সে কুকুর সামলাতে ব্যস্ত। কুকুরও একটা! যেমন নাদুসনুদুস, তেমনই নাছোড়। যেন মাংসের পুটলি খাবলে নিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে সে। মহিলা চেঁচাল, ভাইজান, জলদি পোটলা সামলাইন। বেঞ্চিত্থোন হাতে লইন। নইলি এইহান থিকা উইঠা যান গিয়া। একবার আমার হাতেত্থোন মাংসর পলিথিন লইয়া দৌড় ফালাইছিল এক কুত্তায়। যেই বাড়িত কাম করতাম, হেই দোষে হেই বাড়ির কামডা আমার চইলা গেছিল। গরিবের কথা, কেউ কি আর বিশ্বাস করে?

আইচ্ছা বুঝছি, তুমি অহন যাও গিয়া। আমি দেখতাছি।

নফর মিয়া গিট দেয়া মাংসের পলিথিন ব্যাগটা দু’হাতে বুকে জড়িয়ে নিয়ে হুংকার দেয়, হালার হারামজাদা বদ কুত্তা, ভাইগা যা কইতাছি। টাহা দিয়া মাংস লইছি কি তরে খাওয়াবার লাই? এক কেজি মাংসর দাম আটশ টাহা। লোভ ছাইড়া যা কইতাছি, চাইয়া থাহিস না। ওই যাহঃ! ছ্যাবলামি করলি তর চোফার মইধ্যে কয়ডা উষ্ঠা ফালামু। ওই, যা! যা! যা!

নফর মিয়া কনুই বাগাতে থাকলে কুকুরটা নিরাশ হয়ে দৌড়ে চলে যায়। নফর মিয়া হাঁপ ছেড়ে বলে, বুঝলাইন মিয়াভাই, কুত্তার পরিমাণডা এই এলাকায় খুবোই বেশি। এই পরিমাণের কুত্তা দ্যাশের আর কুনুহানে আমি এই জীবনে দেহিনাই। রাস্তায় বাইর হইলিই খালি কুত্তা আর কুত্তা, দলে দলে কু্ত্তা। হুনলাম হইটালে বলে ইদানীং কুত্তার মাংস দিয়া বিরানি পাকায়। হ্যাতেরা কী করে? এই হালাগো কয়ডারে ধইরা ছালাত ভইরা নিয়া গেলিই তো পারে।

কুত্তার সমখা এই এলাকাত বেশি হেইডা ঠিক আছে।কিন্তু এইডা কী কইতাছেন? এইডা ভালো কতা না। হইটালে মাইনষ খাসির মাংস জাইনা কুত্তা খাইলে ক্যামতে হইব? খুবোই খারাপ হইব ব্যাপার।

খাউকগা হালার বড়লোকেরা। আমরা তো আর খামু না। এক প্যাক বিরানির দাম হুনি পাঁচ ছয়শ টাহা। হইব না ক্যান? এক কেজি খাসির মাংসর দাম এগার বারোশ টাহা। চাইড্ডিখানি কতা!

আমরা খাই না খাই, মাইনষর পক্ষে কুত্তার মাংস খাওন ভালো ব্যাপার হয় না। আপনে ভুল ভাবতাছেন। অহন বাসায় চইলা যাইন গিয়া। অতিরোক্ত কাশতি কাশতি মাথাত গণ্ডোগোল হইতাছে বোধ করি।

হইবার ফারেহ! ঝা-হা-ই, আউ-ঝ-ঘা! যাইয়া আবার খানা ফাকান লাখব! খাউচ্চু খক ফুখ! ফা-ই-ছা-ন, ঝা-ই! অফ্ ফুক! ফুউক!

নফর মিয়া চাপা কাশতে কাশতে বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল। তেজারত মিয়া তাকিয়ে আছে তার পেছন দিক থেকে। শহরের এদিকটা অতি প্রাচীন। দালানকোঠার অধিকাংশই রঙ ও ইট পলেস্ত খসা, জরাজীর্ণ। চিপাচাপা প্রতিটি অলিগলি। এখানে ওখানে রঙ- প্লাস্টিক- সীসা কারখানা, গোডাউন, সবজি- চাল ডালের আড়ত, মুদি দোকান, মুরগির আড়ত, মাংস পট্টি – সবে মিলে রীতিমত ঘিঞ্জি।

নফর মিয়া কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর পেছন ফিরে তাকাল তেজারত মিয়ার উদ্দেশ্যে। বেঞ্চির আশপাশটা তখন কারখানা থেকে আসা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। তেজারত মিয়াকে দেখতে পেল না সে। তার সামনেই খোলা দুর্গন্ধময় নর্দমা। যে বাড়িতে সে চাকরি করে সেটা নর্দমার এপারেই। কিন্তু নর্দমার পাশ দিয়ে হাঁটার সময় তার পানের কথা মনে পড়ল। ঘরে পান ফুরিয়ে গেছে তার। আজ অনেক দিন পর মাংস রান্না করে খাবে সে। খাওয়ার পর একটা সুদৃশ্য বাড়ৈ পান মিষ্টি জর্দায় আয়াস করে চিবিয়ে খাওয়া চাই। কিন্তু সুদৃশ্য বাড়ৈ পানের জন্য তাকে যেতে হবে নর্দমা পেরিয়ে ওপারে। ওপাশে ছোট্ট মাঠের পর পান বিক্রির পাইকারি বাজার আছে। সস্তায় কদিনের পান একযোগে কিনে আনবে সে।

মনের স্ফূর্তিতে এক লাফে নর্দমা পেরোল নফর মিয়া । ছোট্ট মাঠ ধরে দ্রুত হাঁটতে লাগল। সে মাঠের শেষ সীমায় যেতেই পেছনের পুরনো শিরিশ গাছের ওদিক থেকে কেউ চিৎকারে ডেকে উঠল, বাইজান, ওইধারে যাইয়েন না! ওইধারে কুত্তার আড়ত, কুত্তার দ্যাশ। মাঠের ওইধারের দাগে পা দিলি কিন্তুক আপনেও লগে লগে কুত্তা হয়া যাবেন। সাবধান, ফিরা আয়েন। বর্ডারে যায়েন না।

নফর মিয়া বিস্মিত হয়ে ফিরে তাকাল। দেখল পেছনে কেউ নেই। গাছের নিচ নাগাদ ধূ ধূ ফাঁকা। অতএব, কেউ ফাজলামো করে সটকে পড়েছে ভেবে সে দ্বিগুন বেগে পা চালাল। কিন্তু আবারও পেছনে সে চিৎকার শুনতে পেল, বাইজান, ভুল করলেন আপনে, ভুল।দেহেন, অহনি কুত্তা হয়া যাবেন। নফর মিয়া অবিশ্বাস বশত মুচকি হেসে একবার হাতের মাংস- পুটলির দিকে, আরেকবার পানের আড়তের দিকে তাকাল। তারপর হেলেদুলে হাঁটতে লাগল।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর রীতিমত বিস্মিত হলো নফর মিয়া। কই, এদিকে সেই পানের আড়তটি কই? একটা বড় মাঠ ; চারদিকে বস্তি শ্রেণির পাকা, আধা পাকা যত খুপরি। প্রতি খুপরির সামনে জোড়ায় জোড়ায় নানা আকৃতি ও রঙের কুকুর শুয়ে বসে ও দাঁড়ানো আছে। এবারে মুখ ঘুরিয়ে বরাবর মাঠের দিকে তাকাল নফর মিয়া । দেখল মাঠের মাঝামাঝি থেকে দৃষ্টির শেষ সীমা নাগাদ শুধু কুকুর আর কুকুর। কেউ শুয়ে বসে, কেউ দাঁড়িয়ে, অনেকে দৌড়াদৌড়ি, জড়াজড়ি ঘাউঘাউ খাউখাউ করছে।

অনেকটা তাল হারানোর মতো অবস্থা হলো নফর মিয়ার। এ কোথায় এসে পড়ল সে? এখন কোন দিকে যাবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। যেদিকে তাকায়, রীতিমত অচেনা লাগে। কোন পথও তার চোখে পড়ে না যে তা ধরে পা চালাবে। শুধু একটি দৃশ্যই চোখে বেঁধে যায়, তা হচ্ছে কুকুর আর কুকুর। ভীষণ বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। ভয় ঢুকতে শুরু করেছে ভেতরে। ভাবছে, একটা উদ্ভট কথায় কান না দিয়ে তবে কি সত্যিই সে ভুল করে বসেছে। পেছন থেকে যারা তাকে সতর্ক করেছিল, তারা কি ভালো চেয়েছিল তার, সে না বুঝে ত্যাড়ামো করেছে? সে মানুষের পৃথিবী ছেড়ে কুকুর জগত নামের আলাদা কোন জগতে চলে এসেছে! বিষয়বস্তু যাই হোক, এখন উপায়? কী করবে সে এখন? দুর্ভাবনায় কাঁদোকাঁদো হয়ে উঠল সে।

হঠাৎ সে মুখ তুলে দেখল বেশ নাদুসনুদুস উঁচু লম্বা এক কুকুর লেজ তুলে এগিয়ে আসছে তার দিকে। ভয়ে দু’পা পিছিয়ে এলো সে। কুকুরটা দ্রুত তার সামনে এসে গলা উঁচিয়ে বিশেষ ভঙ্গিমায় বলল, ভাইজান, কুত্তার দেশে আইলেন তালি? তা কুনহান থোন আয়লেন? ভুকভুক!

ওই যে সীসারিপাড়া, ওইহান থিকা।

ডরাইতেছেন? ডরের কিছু নাই, আয়েন আমার লগে। ভুকভুক।

আপনের লগে–?

আরে ভায়া, পাইছাইয়েন না, আয়েন আমার লগে, আয়েন।

কোথাই?

আমার বাড়িত, ডরায়েন না। ডরের কিছু নাই, আয়েন জলদি ।

আপনের বাড়িত যামু?

হ, আয়েন। এইহানে খাড়ায়া থাকলি জাত ভায়েরা শত্রু ভাইবা আপনেক ধাওয়া করবার পারে, আয়েন, আয়েন।

আচ্ছা চলো।

আমি কিন্তুক আপনের চায়া বয়সে বড়। সম্মান কইরা কতা কন, ভুকভুক!

আইচ্ছা, চলেন।

ককুরটার পেছনে হেঁটে একটা একচালা আধাপাকা ঘরে এসে উঠল নফর মিয়া। ঘরের মেঝেতে চোখ যেতেই দেখল সেখানে আট দশটা ছোট বড় কুকুর। ওই কুকুরটা সেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার পরিবার।

পরিবার!

হ, পরিবার। আমার বাপ, মাও, ইস্তিরি ও পোলা মাইয়া।

বলেন কী? কুকুরগো আবার পরিবার! বিড়বিড় করল নফর মিয়া।

সে খুব মনোযোগ সহকারে প্রতিটি কুকুরের দিকে তাকাতে লাগল। পরিবার কথাটি শুনে তার কী হলো- কেন যেন মনে হতে লাগল কোথায় কোথায় যেন কীসব মিল রয়েছে কুকুরগুলোর চেহারা-হাবভাবের সাথে মনুষ্য সমাজের নানা সদস্যের । মনশ্চক্ষে সে তার আশপাশের ও গাঁয়ের পাড়া-মহল্লায় চলে গেল। এখানকার সেখানকার নানাজনের চেহারা ছবি, হাবভাব, ব্যক্তিত্ব তার মনে ভাসতে লাগল। সে ভাবল, হতেই পারে। এটা কুকুর জগত। তাই এখানে এসে ধরা যাচ্ছে, কুকুরদের মধ্যেও নানা ব্যক্তিত্বের, চেহারা বৈশিষ্ট্যের বিশেষত্ব রয়েছে – যেমন থাকে নানা বয়সী মানুষের মধ্যে। কেউ দেখতে নিরীহ, কেউ রাগী- রাশভারী , কেউ হাবাগোবা, কেউ চঞ্চল, কেউবা ধীরস্থির, কেউ দুর্বল-দর্শন, কেউবা শক্তিশালী। হঠাৎ ওই কুকুরটা বলে উঠল, এতসব কী ভাবতাছেন আপনে?

ভাবতাছি, আপনেগো মধ্যেও আমগর লাহান নানাবেধ রকমফের বিদ্যমান আছে দেখবার পারতাছি।

ভুকভুক! আপনে কি নিজেরে আমগ চাইয়া ভিন্নতর ভাবতাছেন নাকি? আপনে মিয়া — আপনে–

মাইনে?

মাইনে আবার কী? আপনে নিজে কুত্তা হয়া আমগ লগে আপনের পার্থক্য খুঁজতাছেন! এইডা কি ঠিক? ভুকভুক!

আ- মি কুত্তা- আ-? কী কইতাছেন আপনে? আ-মি কু-উ-ত্তা?৷ আ-মি-ই- ই—।

আপনে কুত্তা না তয় কী?

মানুষ! আ-মি মা- নু- উ -ষ! কুত্তা হমু ক্যান?

ধূর মিয়া! আপনে আর মানুষ আছেন নাহি? আগে থাকলেও এইধারে পাও দেওন মাত্রক কুত্তা হয়া গেছেন। ওই মাঠের বর্ডার ক্রস করন মাত্রক। নিজের গাওগতরের দিক চায়া দেহেন নাই বোধ করি। এই যে লন আয়না দিতাছি। নিজের ধারে খেয়াল কইরা দেহেন ভালামতন। আপনে নিজেরে—-, ধূর!

কুকুরটা লাফিয়ে তার ঘরের দেয়ালে ঝোলানো আয়নাটা এক টানে নিচে নামিয়ে নফর মিয়ার সামনে খাড়া করে ধরে কেউ কেউ শব্দ করতে লাগল। আয়নায় নিজের কুকুর প্রতিকৃতি দেখে ভয়াল চিৎকার করে উঠল নফর মিয়া। এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল সে। প্রবল দৌড় শুরু করল মাঠ বরাবর। দৌড়াতে দৌড়াতে সেই শিরিশ গাছটার নিচে এসে থামল সে। জিহ্বাটা রীতিমত বেরিয়ে গেছে প্রচণ্ড ভীতি-হাঁপে। শ্রান্ত অবসন্ন শুতে গিয়ে থামল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে একবার তাকিয়ে দেখল কেউ তাকে অনুসরণ করছে কি না। নাহ, কেউ নেই ওদিকে।

হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচল সে। শ্রান্তিতে খানিকটা ভাটা নেমেছে। কী মনে করে চোখ দুটো ভীষণ করুণ হয়ে উঠল তার। শশব্যস্ত নিজের গায়ের পায়ের দিকে লক্ষ্য করতে লাগল সে। নিমিষে চোখ দুটো আরো বেশি করুণ হয়ে উঠল তার। এ কী দেখছে সে? সত্যিই তো সে কুকুর হয়ে গেছে। এতক্ষণ পোড়া চোখে অবিশ্বাস ভর করে ছিল বলেই হয়তো সে নিজের এ পরিবর্তন লক্ষ্য করেনি। এ কি কোন কথা হলো? গেল সে পানের আড়তে পান আনতে, কী দিয়ে কী ভুয়া কারসাজি হলো, আর তাতে করে তাকে কিনা কুকুর হতে হলো। পরম দুঃখে ভীষণ ঘেউ ঘেউ করতে লাগল সে। ভাবল, ভুল দেখছে না তো? এ কী করে সম্ভব? মানুষের কুকুরান্তর!

দীর্ঘশ্বাস ঝরাল সে। আহা, সবই যদি মিথ্যে হত, দুঃস্বপ্ন হতো! আবারও মুখমণ্ডল পরখ করতে ইচ্ছে হলো তার। হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে গেল সে পাশের নর্দমার দিকে। পানির স্রোত বইছে নর্দমায়। যদি ওই পানিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, মনুষ্য-প্রতিবিম্ব? নর্দমার পারে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে চোখ নামাতেই পেছন থেকে তার কানে ভেসে এলো, এইতো পাইছি একটারে। জলদি জাল দিয়া আটকায়া ফালাও এ্যাক। কুইক! অনেক সাধনায় পাইছি। বাকি হারামজাদারা শহর ছাইড়া কই যে ভাগছে! হারামজাদা কুত্তার দল! এ্যাক ছাড়া যাইব না, কুইক!

নফর মিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুজন লোক তড়াক করে তার ওপর বিশেষ জাল ছুঁড়ে দিয়ে আটকে ফেলল তাকে। দুজনে মিলে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো শিরিশ গাছটার নিচে। ওখানে একটি কাঠের বেঞ্চি ফেলা আছে। দুজনে তাকে বেঞ্চির নিচে ফেলে আলোচনা শুরু করল: ধরলাম তো! মালও খাসা। হইটালের জন্য পারফেক্ট। দেখছ, হাড্ডিগুলান হইব একদম নিখুঁত। পাবলিক টেরই পাইব না যে এই হাড্ডি খাসির না, কুত্তার।

কিন্তু সমেস্যা হইল–

কী? অন্যজন জিজ্ঞাসা করল।

এ্যাক নিয়া যাব কেমনে? জ্যাতা নিয়া যাওয়া তো রিস্কি। ধরা খাওয়ার আশংকা আছে। চাইরদিক খবর রইটা গেছে।

এক কাজ করি তালিপর।

কী?

জবো কইরা ফালাই। রক্ত ড্রেনে ফালাইয়া পলিথিনে প্যাঁচাইয়া ছালাত ভইরা সি এন জিত তুলমু, কী কও?

ঠিক, ঠিক কতা কইছো। তুমি শক্ত কইরা পাছার দিক ধরো , আমি মাথাত পাড়া দিয়া গলাত ছুরি চালাই। রেডি!

কাঁধের ব্যাগ থেকে ধারালো ছুরি বের করল লোকটা। নফর মিয়ার মাথাটা জোরছে পায়ে চেপে ছুরিটা তার গলার দিকে নিয়ে গেল সে। প্রাণভয়ে প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠল নফর মিয়া।

ঘুম ভেঙেছে নফর মিয়ার। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। কাঁপছে সে আপাদমস্তক। ধীরে ধীরে চোখ খুলল সে। ঘরের মধ্যে আবছা অন্ধকার। বাইরে ফজরের আযান বাজছে চারদিকে। আযানের সাথে এদিকসেদিক কুকুর চেঁচাচ্ছে। গায়েপায়ে হাত বুলাল নফর মিয়া। সে উপলব্ধি করল, এতক্ষণ সে যা দেখছিল, তা বাস্তব নয়, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন মাত্র। ভয় কাটতে থাকে তার। ভাবনাচ্ছন্ন হলো সে।

দিনের বেলাকার নানা দৃশ্য তার মনে ভাসতে লাগল। দুপুরে এক পোয়া গরুর মাংস কিনে রাস্তায় হেঁটে এসেছে সে। হাঁটার সময় একটা কুকুর হাঁটছিল তার পাশাপাশি। একজন মহিলাকে সে দেখেছে তার হাতের মাংসের পুটলি ও কুকুরের দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকাতে। কিছুক্ষণ কথিত, অর্থাৎ স্বপ্নে দেখা বেঞ্চিতে বসে কথিত তেজারত মিয়ার সাথে কথাও বলেছে সে। একসময় উঠে গোডাউনে ফিরে মাংস রান্না করে আচ্ছামত খেয়েছে। একপেট – এক পোয়া তথা আড়াই শ গ্রাম মাংস, রাতেও ভালোমত খেয়েছে সে। গরুর মাংস গুরুপাক খাবার। গুরুপাক খাবারে রাতে ঘুমের ঘোরে নানা দুঃস্বপ্ন হয়- বহুবার শুনেছে সে। প্রত্যক্ষও করেছে। এটাও দুঃস্বপ্ন , তবে খুব অদ্ভুত এবং ভয়াবহতম। এতটা বিভীষিকাময় স্বপ্ন আগে সে দেখেনি। কেন দেখল সে এমন ভয়াবহ স্বপ্ন?

তার মনে পড়ল, কদিন ধরে মহল্লায় কুকুর নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। হোটেলে কুকুরের মাংসের কাচ্চির সমালোচনা। তাছাড়া এ এলাকায় ইদানিং কুকুরের সংখ্যাও মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে। এ দুঃস্বপ্ন হয়তো সেসবেরই গড়ফল। তবু তার খুব মন খারাপ হলো। ঘুম হলো না আর। ঘাপটি মেরে শুয়ে রইল সে।

দিনের আলো ফুটতেই সীসা কারখানার অদূরের সেই বেঞ্চিটার ওপরে গিয়ে বসল নফর মিয়া। অপেক্ষা করতে লাগল তেজারত মিয়ার জন্য। তেজারত মিয়া প্রতিদিন সাতসকালেই কারখানায় আসে। সে এলে তাকে সে বিস্তারিত খুলে বলবে স্বপ্নের যত কথা। বলে হালকা হয়ে নেবে। কিছুক্ষণের মধ্যে তেজারত মিয়া এলো। তাকে দেখেেই বলে উঠল, কী ব্যাপার? এই সাতসকালেই আইসা বইসা আছেন আইজ! মন খুব খারাপ মনে হইতাছে! কী ব্যাপার? কী হইছে? কুনু ঘটনা?

ব্যাপার কিছু না। রাইতে খারাপ হপোন দেখছি, এই যা। চাইরোধারে এত কুত্তা, তার উফারে আবার কুত্তা লইয়া হইটাল আলাগো কুকামের খবর-বাতরা -হেইসবোই কারণ।

কিন্তু খারাপ হপোন, কেমন কী হপোন?

ওই দেহি, আমি হইল গিয়া, আমি হইল- ইয়া হইয়া গেছি আর কি।

কী? হফোনে কী হইছেন?

ওই হইল গিয়া ইয়া আর কি, ইয়া?

কী হেইডা? কী হইছেন হফোনে?

ওই হইল গিয়া, কুত্তা!

শওকত নূর | Shawkat Noor

New Bengali Story 2023 | করিমের একদিন | তালাল উদ্দিন

New Bengali Story 2023 | তুতানের পৃথিবী | গল্পগুচ্ছ

New Bengali Story 2023 | আশার আলো | সুভাষ নারায়ন বসু

New Bengali Article 2023 | কবিতার অন্তরাত্মা

bengali story | short bengali story analysis | short bengali story characteristics | short bengali story competition | short bengali story definition | Best Bengali Story | Top Bengali Story | World Bengali Story | International Bengali Story | short bengali story english | writing competitions ireland | bengali story writing practice | bengali story writing topics | trending topics for article writing 2022 | bengali story trends 2022 | content writing topics 2022 | Bangla Prabandha | Probondho | Definite Article | Article Writer | Shabdodweep bengali story | Galpoguccha | Galpo | Bangla Galpo | Bengali Story | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder | bengali story pdf download | bengali story audio book | bengali story audio download

Leave a Comment