New Bengali Story 2023 | জন্মযোগ | বৃষ্টি রায়

Sharing Is Caring:
BENGALI STORY

জন্মযোগ – বৃষ্টি রায় [Bengali Story]

দক্ষিণভারতের ইতিহাস থেকে জানা দ্বাদশ শতকে পান্ড্য রাজবংশ ছিল তিনটি প্রাচীন তামিল রাজ্যের অন্যতম। সঙ্গম সাহিত্যে (১০০-২০০ খ্রিঃ) এবং সমসাময়িক কালে রচিত গ্রিক ও রোমান রচনায় পান্ড্যরাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। কলভ্র আক্রমণের সময় প্রাচীন পান্ড্য রাজবংশ ধ্বংস হলেও । ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কদুঙগনের নেতৃত্বে এই রাজবংশ পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়। নবম শতাব্দীতে চোলদের উত্থানের আগে পর্যন্ত এই রাজবংশের শাসন কায়েম ছিল। এই গল্পে ইতিহাস বলতে এটুকুই। বাকিটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।

১.

“ না মাতা, আমি প্রভাকে না নিয়ে যাব না। ছেড়ে দিন আমায়, এ বিপদে ওকে একলা রেখে যাব না, না…” ঘুম ভেঙে গেল রানী ক্ষণপ্রভার। বাতায়ন দিয়ে আসা আবছা ভোরের আলোয় প্রায়ান্ধকার কক্ষের বিশাল পালঙ্ক থেকে নেমে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন তিনি। নিষ্প্রদীপ সারারাত জ্বলে এখন ধূসর ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে শ্রান্ত। কুড়ি বৎসর কেটে গেল, কিন্তু এখনও তিনি সেই দিনটার কথা, সেই শব্দগুলো ভুলতে পারেননি। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা, ছাতিমগাছের মাথায় আটকে থাকা শুকতারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, হঠাৎ ‘মা’ ডাকে চমকে পেছনে ফিরে দেখলেন পুত্র রুদ্র দেব বর্মা জেগে উঠেছে।

২.

প্রভাতে মজ্ঞিরার তিরতিরে জলের বুকে সামান্য হিল্লোল উঠল। তারপরেই দেখা গেল একটা নৌকা । মাঝি ছাড়া তাতে দুজন মানুষ আছেন । একজন রাণী ক্ষণপ্রভা অপরজন বর্ণকুল রাজ্যের মহামন্ত্রী তথা হিতাকাঙখী পণ্ডিত চন্দ্রসেন। বর্ণকুল রাজ্যের প্রস্তরদ্বারে তখন সূর্যের কাঁচাসোনা রঙের স্পর্শ লেগেছে । একে একে জেগে উঠেছে রাজ্যের প্রজাগণ। নদীতীরে সবুজ গাছগুলো আরোও ঘন হয়ে এসেছে। মঞ্জিরার দক্ষিণ পাড় থেকে সুবর্ণরেখা পর্যন্ত ঘন জঙ্গল আর তার মধ্যে বাস করা নীলগাই, বাঘ, মোষ, বুনো শূকর, হাতি এই বর্ণকুল রাজ্যকে অতন্দ্র প্রহরীর মত আগলে রেখেছে। নৌকায় যেতে যেতে মহামন্ত্রী চারপাশের চর, গ্রাম, রাজ্যের সীমানা চিনিয়ে দিচ্ছিলেন। শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে গেলেন ক্ষণপ্রভা। আজ একপক্ষ কাল হতে চলল মহারাজ রাজেন্দ্র দেব বর্মা গত হয়েছেন । তাঁর ইচ্ছানুসারেই এই রাজ্যের ভার গ্রহণ করেছেন মহারানী। যতদিন না রুদ্র সাবালক হয়ে উঠছে, ততদিন ক্ষণপ্রভা এ রাজ্যের প্রজাপালক। মহারাজের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো একসাথে ভিড় করে আসে তাঁর মনে। ধীরস্থির শান্ত জ্ঞানী মানুষটা যে এমন হঠাৎ করেই চলে যাবেন, তা ভাবতে পারেনি কেঊই । ভাবতে ভাবতে তিনি অতীতের দিনে চলে গিয়েছিলেন, সম্বিত ফিরল ‘আভীর মাতার মন্দির” কথাটা শুনে। ভালো করে চেষ্টা করলেন দেখার প্রায়বিন্দু হয়ে আসা জায়গাটাকে। অজান্তেই এক দীর্ঘশ্বাস উঠে এল তাঁর।

৩.

সেনাপতি মানবদেব যখন আভীরনগর দুর্গে প্রবেশ করলেন তখন মহারানী বীরশ্রী তাঁর দুই ছেলে-মেয়ে আর তাঁর ছায়াসঙ্গিনী প্রৌঢ়া রত্নার সাথে সান্ধ্যপূজায় বসেছেন ।
“রানীমা, যুদ্ধে মহারাজ নিহত হয়েছেন ।“
পূজার উপকরণ হাত থেকে পড়ে গেল বীরশ্রীর ।
হয়তো পান্ড্য রাজবংশও আর থাকবে না ।
“কি বলছেন আপনি ? কোথায় মহারাজ ? আমায় নিয়ে চলুন রণক্ষেত্রে ।“
“ না ,মা না , আপনি যাবেন না, আমরা যুদ্ধে পরাজিত কলভ্ররা দুর্গ অধিকার করে আপনাদের বন্দী করতে এগিয়ে আসছে । আপনি রাজকুমার ও রাজকন্যাকে নিয়ে আমার সাথে আসুন। রত্না, তুমিও এসো ।“
সেনাপতি দুর্গের মধ্যকক্ষে এলেন । পাথরের দেওয়ালের একপ্রান্তে চাপ দিতেই অন্যপ্রান্তে সুড়ঙ্গের দরজা খুলে গেল ।
একটা মশাল হাতে সেনাপতি তাদের এগিয়ে দিলেন সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত, যেখানে কৃষ্ণার জল দুর্গে ধাক্কা মারছে।
এক শীতল নিশ্ছিদ্র অন্ধরাতে একটা নৌকা মৃদু ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে এগিয়ে চলল চারজন সওয়ারী নিয়ে। ভোররাতে নৌকা যখন ঘাটের কাছে, পিছনে দেখা যায় অনেকগুলো রণতরী, তাদেরই পিছু নিয়েছে।
মাঝি চিৎকার করে বলে উঠল, “রানিমা আপনারা তাড়াতাড়ি ঘাটে উঠুন, আর দুভাগে ভাগ হয়ে যান, সোজা যাবেন না, ডাইনে বাঁয়ে বেঁকে যান।”

বীরশ্রী পুত্র আর রত্না কন্যাকে নিয়ে উঠে এলেন। তারপর মেয়েকে কপালে চুম্বন করে অশ্রুসিক্ত স্বরে বললেন, “ যা মা যা, রত্নামা-র সাথে যা, যদি বেঁচে থাকি, আবার দেখা হবে।“
কিছু বলল না, ছোট মেয়েটা, কাজল কালো চোখ দুটোয় দেখা গেল শুধু বেদনায় মুচড়ে ওঠা হৃদয়টা । রত্নামার সাথে ছুটতে ছুটতে শুনতে পেল দাদাভাই-এর গলা- “আমি প্রভাকে ছাড়া যাব না ….।“
এরপর কৃষ্ণার বুক দিয়ে অনেক স্রোত বয়ে গেছে, কলভ্র গোষ্ঠীর আক্রমণে অধিকৃত রাজ্য গুলি পুনরায় উদ্ধার করেছে কদুঙগনের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী। পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাণ্ড্য রাজ্য।
আর সেই ছোট্ট মেয়েটি, যে তার আর দাদাকে হারিয়ে ছিল, কিছু কালের মধ্যে রত্না মাকেও হারায়। কলভ্ররা তাদের বন্দী করে। পালিয়ে বাঁচে মেয়েটি, তারপর সে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছায় বর্ণকুলে, রাজার প্রধান বল্লমযোদ্ধা ভবনাথ এর কাছে বেড়ে উঠে সে, শিকার, যুদ্ধ, অঙ্কন ও শাস্ত্র বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে। তারপর একদিন, মহারাজ রাজেন্দ্র দেব বর্মা, রাজগুরু, দেবদত্ত সহযোগে তার পাণিপ্রার্থী হয়ে আসেন। রাজকুলভ্রষ্ট প্রভা শ্বশুরালয়ে গিয়ে হয়ে ওঠে মহারানী ক্ষণপ্রভা ।

৪.

কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর রাত। আকাশে চাঁদ নেই। বর্ণকূল প্রাসাদের নৈশবাতি ধিকি ধিকি জ্বলছে, চারিদিক নিস্তব্ধ। প্রাসাদের চিলেকোঠায় ছোট গুপ্ত কক্ষে কেবল চারজনের চোখে ঘুম নেই। মধ্যমণি রানি ক্ষণপ্রভা, দীপের আলোয় তাঁর হরিদ্বর্ণপট্টবস্ত্র, কর্ণের স্বর্ণকুন্ডল, তার বৈধব্যের মলিনতা মুছিয়ে এক সাধিকার কান্তি এনে দিয়েছে সর্বাঙ্গে । আর আছেন মহামন্ত্রী চন্দ্রসেন, রাজগুরু দেবদও, গুপ্তচর চিত্বন। সকলের চোখে মুখো দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। ক্ষণিকের নীরবতা ভেঙে মহামন্ত্রী বললেন –
“খবর পেয়েছি, প্রতিবেশী রাজ্য কপোতকূট আমাদের রাজ্য আক্রমণ করতে সৈন্যসমাবেশ ঘটিয়েছে ।“

রাণী বললেন, “সেকথা জানি, রাজগুরু বলেছেন। কিন্তু হঠাৎ এমন অতর্কিত যুদ্ধের কারণ জানা গেছে ?”
রাজগুরু গম্ভীর কন্ঠে বললেন, “কারণ একটাই। মহারাজ গত হয়েছেন । তাঁর স্থানে একজন নারী সিংহাসনে বসেছেন । এই সুবর্ণ সুযোগ রাজ্য দখলের ।“
মন্ত্রী তাঁকে বাধা দিলেন “না গুরুদেব শুধু এই কারণ নয়, বিগত বেশ কিছু কাল ধরে বাণিজ্যিক দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কপোতকূট । তাই অর্থনীতির উন্নতির জন্য দরকার কৃষিজপণ্য, যা আমাদের রাজ্যে উৎকৃষ্ট।“
“বেশ বুঝলাম, কিন্তু দূতকে যে ওই রাজ্যের সমস্ত ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলেছিলেন, তার কী বার্তা ?“
মন্ত্রী হাঁক দিলেন “ চিত্বন এদিকে এসো । যা যা জেনেছো রাণীমার সম্মুখে নিবেদন কর।“
চিত্বন এগিয়ে এল, “যথা আজ্ঞা । রাণীমা, কপোতকূট রাজ্যের পূর্বরাজা ইন্দ্রবল্লভ দেবের একমাত্র কন্যা তারার বিবাহ হয়েছে এক বীর যোদ্ধা সেনবর্মার সাথে। উত্তরাধিকার সূত্রে এখন তিনি রাজা। প্রজাপালক, সুশাসক হলেও সাম্রাজ্যবিস্তারে তাঁর তীব্র আকাঙ্খা । এ রাজ্যের সাথে প্রথমে সম্পর্ক ভালো থাকলেও, ধীরে ধীরে বাণিজ্যিক অসফলতার কারণে তার অবনতি ঘটে। পর্বাত্রে ওরা জল বাহিনী দখল করবে তারপর, জঙ্গলপথে রাজ্যে প্রবেশ করবে বলে সমাচার।
ক্ষণিক চিন্তা করে বললেন রাণীমা “এখন কি করণীয় ? আপনারা বলুন ।“
রাজগুরু প্রস্তাব দিলেন, “আপনি এক কাজ করুন, প্রথমে মিত্রতাপত্র প্রেরণ করুন । “
রাণী মন্ত্রীর দিকে তাকালেন । তাঁর সমর্থন পেতে বললেন – “ঠিক আছে, কালকেই দূত প্রেরণ করুন । দ্রুত বার্তা আনার ব্যবস্থা করুন ।“
গুপ্তসভা ভঙ্গ হল ।

৫.

পরের দিন কপোতকূটে রাজসভাগৃহে রাণী প্রেরিত মিত্রতাপত্র এল। রাজা সেনবর্মা পত্রপাঠ করলেন। দূতকে ক্ষণিক বিশ্রাম নিতে বলে সেনাপতির কাছে গেলেন । বলা বাহুল্য, তিনি যোদ্ধা হওয়ার সুবাদে জানতেন, রাণী ক্ষণপ্রভা সাধারণ নারী নন, ইতোমধ্যে গুপ্তচর লাগিয়ে তিনি সকল খবর সংগ্রহ করেছেন । মধ্যাহ্নের কিছু সময় পর যখন তিনি সেনাপতির কাছ থেকে এলেন, তখন তার মুখ দৃঢ়। দূত রাজসভাতেই অপেক্ষা করছিল । তাঁকে পএ ফেরত দিয়ে রূঢ় কণ্ঠে বললেন – “মহারাণীকে বলো, এই মিত্রতাপত্র আমি গ্রহণে অপ্রবৃত্ত ।
আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত । এরপর ওনার কাছে দুটি পথ খোলা আছে । হয় ঊনি আত্নসমর্পণ করুন নয়তো সম্মুখ সমরে উপনীত হন । যুদ্ধের তিথি পরের জ্যোতিষের কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশী তিথি।” দূত প্রণাম করে বেরিয়ে গেল ।
বাইরের ঘোড়ার পদশব্দ শুনে ওপরে এলেন সেনবর্মা ওরফে তীলকবর্মা । জানালা দিয়ে অপরাহ্নের টুকরো মেঘে ঢাকা আকাশে দেখতে দেখতে ফুটে ঊঠল মায়ের মুখটা । এত যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু এই যুদ্ধে কেন তার মনপ্রাণ বারবার তাঁকে বাঁধা দিচ্ছে ? ভেবে পান না । সপ্রশ্ন ঊদাসীন ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন । এরপর গোধূলি নামলে সভাগৃহে ফিরে এলেন। যুদ্ধের প্রস্তুতির আলোচনা প্রয়োজন ।

৬.

অপরাহ্নে রুদ্র ভবনাথের কাছে বল্লম যুদ্ধ শিখছিল । প্রৌঢ় ভবনাথ মন দিয়ে দেখছিলেন রুদ্রকে পিতার ও মাতার সমস্ত গুহ গ্রহণ করেও যেন স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে সে । এ বয়সে এমন শৌর্য, বীরত্ব, সাহস, ঊদারতা, মানুষের প্রতি এমন ভালোবাসা, ধৈর্য কজন রাজপুত্রের থাকে , মনে মনে তার গর্ব হয় – “এই নাহলে আমার পৌত্র ।”
হঠাৎ চমক ভেঙে যায় । জঙ্গলের ওপারে যেখানে প্রহরীরা আছে, সেখানে কিছু গোলমালের আওয়াজ পাওয়া যাছে । ভবনাথ দেখেন, রুদ্র ও দাঁড়িয়ে পড়েছে ।
রুদ্র বলল, “ চল দাদামশাই, দেখে আসি। “
তোরণের কাছে পৌঁছতে দুজনেই দেখল, একজন বৃদ্ধা, কঙ্কালসার চেহারা, পরনের বস্ত্রের অধিকাংশই ছিন্ন, গায়ের চামড়া পীতবর্ণ ধারণ করেছে । শুকনো সাদা কয়েকগাছি চুল চোখে মুখে পড়েছে, চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, ঠোঁট শুকনো, পাগলের প্রলাপের মতো বলে চলেছে, “আমি প্রভার কাছে যাব, ছাড়ো আমায়।“
ভবনাথ কাছে গেলেন রক্ষীদের জিজ্ঞাসা করে জানলেন বৃদ্ধা রাণীকে খুঁজছেন ।
তিনি কিছু বলার আগেই রুদ্র বলল – “তোমার বুড়িমাকে ছাড়ো, বুড়িমা তুমি আমার সাথে এসো, আমি তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। কোনো ভয় নেই তোমার, এসো ।”
রাণী রাজসভায় দৃঢ় আলোচনা ব্যস্ত মহারাজ তাঁকে রাজ্যরক্ষার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন । তিনি আত্মসমর্পণ করবেন না কিছুতেই। যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। কপালে চিন্তার ভাঁজ। সেনাপতিকে সেনানী প্রস্তুতের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। নেতৃত্বে তিনি স্বয়ং থাকবেন, অশ্বারোহী আর পদাতিক বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন, সেই মুহূর্তে রুদ্র প্রবেশ করল ।
“মা ! তোমার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে ?”
“কে এসেছে, রুদ্র ?”
“এসো না বুড়িমা – এসো । মা এই যে এই দেখো ইনি । “
রাণী মুখ তুলে দেখলেন । আর দেখে এতটাই বিস্ময়াভূত হয়ে গেলেন যে স্বয়ং কূলদেবী মা অম্বা সম্মুখে এলেও এতখানি হতেন না ।
কিয়ৎকাল পর তাঁর অবাক হওয়া মুখ খেকে কেবল একটা কথাই বেরিয়ে এল – “রত্না মা, তুমি …. “

৭.

রাতের আকাশে চাঁদ উঠেছে, তার আলো রুপোর মত গলে এসে পড়েছে রত্নামার মুখে। ঘুমোচ্ছে এখন। মাথার দিকে রাজগুরু আর ক্ষণপ্রভা বসে আছেন । রাজবৈদ্য ওষধি দিয়ে গেছেন, একটু পরেই জ্ঞান ফিরবে । ক্ষণিক বাদে জ্ঞান ফিরল রত্না মা’র । ক্ষণপ্রভার হাতটা শীর্ণ দু–হাতে জড়িয়ে ধরল সে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল – “এ যুদ্ধ করিস না মা । তুই যার বিরুদ্ধে সমরে নামবি, সে যে তোর মায়ের পেটের ভাই। তোর নিজের দাদা । এ যুদ্ধ করিস না, করিস না, করিস না । “উত্তেজনায় সে হাঁপিয়ে উঠল। বন্ধ হয়ে এল চোখ দুটো । আর ক্ষণপ্রভা যিনি এতক্ষণ বজ্রাহতের ন্যায় প্রস্তরবৎ বসেছিলেন রত্নার বাহুদুটো ধরে জোরে ঝাঁকিয়ে, চিৎকার করে উঠলেন, “এ কি শোনালে তুমি আমায়! এ সংবাদ কোথায় পেলে তুমি ! তুমি কোথায় ছিলে এতদিন? উত্তর দাও, চুপ থেকো না, বলো।“
সহসা রত্নার হাত দুটো শিথিল হয়ে খসে পড়ল। সেদিনই মধ্যরাতে রত্নার প্রাণবায়ু শেষ হয়ে গেল। ক্ষণপ্রভার মনে হল , বুঝি এই ক’ টা মর্মভেদী কথা বলতেই রত্না মা বেঁচেছিল এতক্ষণ । দীর্ঘ কুড়ি বৎসর ধরে চেপে রাখা কষ্ট, দুঃখ এবার বাঁধভাঙা অশ্রু হয়ে নেমে এল ক্ষণপ্রভার চোখ দিয়ে। হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি। শত সান্ত্বনা, শত আশ্বাসও তাঁকে শান্ত করতে পারল না। ভোররাতে হঠাৎ কি মনে হতে উঠে দাঁড়ালেন, ধীর পায়ে হেঁটে কক্ষের দক্ষিণ কুলুঙ্গি থেকে একটা বাক্স বের করলেন। বাক্স খুলে হাত তুলে নিলেন সেই বিচ্ছেদের আগে মায়ের দেওয়া সোনার হারখানি, তারপর কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। দুদিন পরেই যুদ্ধ ।

৮.

কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশী তিথির দিবা দ্বিতীয় প্রহর। দু–পক্ষ এগিয়ে এসেছে, জঙ্গলাকীর্ণ প্রাকার বেষ্টনী পেরিয়ে বিশাল প্রান্তর, সেখানেই যুদ্ধের আরম্ভ। দু’দিকের রণদুদুম্ভি বেজে উঠেছে। সেনবর্মা রথে সর্বাগ্রে চলেছেন, হাতে খোলা তরোয়াল । হঠাৎ দেখা গেল একটা রথ অপরদিকের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে তাঁর দিকেই আসছে। রথের রথী রাণী ক্ষণপ্রভা। এ দৃশ্য প্রত্যাশিত। কিন্তু যা অপ্রত্যাশিত, তা হল তাঁর যুদ্ধবেশ নেই। হাতে অস্ত্র নেই। নিরস্ত্র অবস্থায় সেনবর্মার দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন ক্ষণপ্রভা । মুখোমুখি এসে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। দু’পক্ষের সৈন্যবাহিনীও নিশ্চল হয়ে রইল । তারা যুদ্ধারম্ভে এরকম অচিন্তনীয় ঘটনা আশা করেনি। গগনভেদী রণবাদ্য এখন স্তম্ভিত । মহারাজ সেনবর্মার উন্মুক্ত তরোয়াল হাতে ধরা। ক্ষণপ্রভা ধীরে ধীরে রথ থেকে অবতরণ করলেন। কোনো নিরস্ত্র ক্ষত্রিয়ের সম্মুখে অস্ত্র ধরা ক্ষত্রিয় ধর্মের বিরুদ্ধাচার। সেনবর্মাও রথ থেকে অবতরণ করে দাঁড়ালেন। তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই, ক্ষণপ্রভা তাঁর পাদমূলে বসে পড়লেন, প্রণাম করে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন – “আমার আত্মসমর্পণ আপনি গ্রহণ করুন মহারাজ সেনবর্মা। আর যাই হোক, আপন জ্যেষ্ঠভ্রাতার সামনে অস্ত্র ধরার মত চরম ধৃষ্টতা আমার দ্বারা সম্ভব নয় কোনোমতেই।“

চোখের জল প্রাণপণে রুদ্ধ করে, উঠে দাঁড়ালেন তিনি, কম্পিত হস্তখানি বাড়িয়ে ধরলেন। বিস্ময়াবিষ্ট সেনবর্মা বিস্ফারিত চোখে দেখলেন সেই হারখানি, যা তঁদের মাতা বাল্যকালে তাঁদের দু-ভাই বোনকে দিয়েছিলেন, অজান্তেই তার হাত চলে গেল পাগড়িতে, যেখানে মাতার শেষ স্মৃতি হিসেবে হারখানি সর্বদা জড়িয়ে রাখেন তিনি, দুজনই নিশ্চুপ। দীর্ঘ বিংশ বৎসরের এই বিচ্ছেদের এমন অকস্মাৎ অবসানের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউই। কয়েকটা মুহূর্ত যেন কয়েকটা যুগ। এরপরই দুই পক্ষের সেনাদল দেখল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সেনবর্মা তরোয়াল ছুঁড়ে ফেলে ক্ষণপ্রভাকে বুকে টেনে নিলেন । “প্রভা বোন আমার।“ রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠলেন সেনবর্মা । দুজনের চোখেই আনন্দাশ্রু। যুদ্ধ হল না, রক্তপাত হল না, রণক্ষেত্রে যেন পলকের জাদুতে মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হল। হানাহানিতে উদ্যত সৈন্যদল আনন্দে আত্মহারা হয়ে আলিঙ্গন করল। মন্ত্রী, সেনাপতিগণ পরস্পরকে অভিবাদন করলেন ।
দীর্ঘ সময়ের আনন্দ, হাসি, উদ্বেগ, উত্তেজনা, শান্ত হলে, ক্ষণপ্রভা বললেন, “চল দাদা, আমার প্রাসাদে চল, সেখানে তোমার বোনপো আছে, বৌদিদিকেও নিয়ে এস, আজ আমার প্রাসাদে ভোজের আয়োজন করব, সেখানেই থাকবে তোমরা আজ।“ চোখের জল মুছে সেনবর্মা মৃদু হেসে বললেন – “তাই চলরে বোন ।“

৯.

সেদিনের দাক্ষিণাত্যের সেই ক্ষুদ্র দুই রাজ্যে যে আনন্দময় অধ্যায় লিখিত হয়েছিল তা কৃষ্ণা নদীর প্রবাহীতে বিলীন হয়ে গেছে । অবিনশ্বর ভারতের ইতিহাসে এই মিলন ঘটনার সমাধি হয়েছে চরিত্রের নশ্বর দেহগুলি মাটিতে মিশে যাওয়ার সাথে সাথে। কালের কৃষ্ণবর্ণ পর্দা সেই ঘটনা স্থানে অবগুণ্ঠন হয়ে নেমে এসেছিল।
তারপর সহস্রাধিক বছর কেটে গেছে। অসংখ্য প্রতিকূলতা কাটিয়ে অমানিশার জাল ধীরে ধীরে বিদীর্ণ হচ্ছে । ঘটনাস্থল সজ্জিত হচ্ছে নররূপে, নবসাজে, হয়তো নতুন কোনো মহামিলনের আখ্যানে স্বাক্ষর দিতে।।

বৃষ্টি রায় | Brishti Roy

New Bengali Story 2023 | করিমের একদিন | তালাল উদ্দিন

New Bengali Story 2023 | সন্দেহের কাঁটা | কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা

New Bengali Story | গল্পগুচ্ছ | বিপাশা চক্রবর্তী

New Bengali Story 2023 | ভালো লাগে | শওকত নূর

bengali story | short bengali story analysis | short bengali story characteristics | short bengali story competition | short bengali story definition | Best Bengali Story | Top Bengali Story | World Bengali Story | International Bengali Story | short bengali story english | writing competitions ireland | bengali story writing practice | bengali story writing topics | trending topics for article writing 2022 | bengali story trends 2022 | content writing topics 2022 | Bangla Prabandha | Probondho | Definite Article | Article Writer | Shabdodweep bengali story | Galpoguccha | Galpo | Bangla Galpo | Bengali Story | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder | bengali story pdf download | bengali story audio book | bengali story audio download | bengali story series

Leave a Comment