New Bengali Novel 2022 | খুঁজে ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ৫) | উপন্যাস

Sharing Is Caring:

খুঁজে ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ৫) [Bengali Novel]

সকালের গাড়িতে ব্যাগটা বাংকারে রেখে চেপে বসলো শঙ্খ। একটা ফয়সালা তাকে করতেই হবে। সারাটা রাত প্রায় চোখের পাতা জোড়েনি। লাল গোলা প্যাসেঞ্জার সকালে একটু ফাঁকাই ছিলো আজ। গাড়ি চলতে শুরু করতে শঙ্খ পা মুড়ে সিটে আয়েশ করে বসলো, মাথাটা পেছনে হেলান দিয়ে চোখ বুজে একটু ঘুম ভাব আনার চেষ্টা করলো। চিন্তার জটিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে শঙ্খ। অনিষ্ঠ আশঙ্কা মানুষের মনে ধিক্কার যোগায়। মানুষকে অবসাদ এনে দেয়, বিচ্ছিন্নতাবাদের আঁতুড় ঘর তৈরি হয়ে যায় তার ভিতরে ভিতরে। নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাসমান। শেষ শ্রাবণের বৃষ্টি ধোঁয়া গাছপালার সবুজ পাতায় সূর্যের কিরণ লেগে ঠিকরে পড়ছে চারিদিকে। প্রকৃতির এমন রূপ, সৌন্দর্যে ভরপুর অনেকেই দেখি না। দেখবার সময় ঠিকভাবে আসে না। মনটা তেমন ভাবে তৈরি করা হয়ে ওঠে না। চিন্তার জাল ছিঁড়ে চলন্ত ট্রেনের জানালায় চোখ আটকে যায় শঙ্খের। বাহ ! বিস্ময়সূচক শব্দ মনে মনে আউড়ে ফেললো সে। সকালের প্রকৃতি তো কোনদিন এমন চোখে দেখেনি সে। সাধারণত ট্রেনে এ সময় শুয়ে বসেই, ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে। ‌ অথচ আজ এতো মানসিক চাপের মাঝে থেকেও প্রকৃতির এমন অনন্য রূপ, দু চোখ মেলে দেখতে দেখতে মনটা কেমন হালকা হতে থাকলো। দূরের গাছপালা ছুটে চলেছে। সবুজ ধান গাছে সারা ক্ষেত ভরে উঠেছে। সারি সারি ঘর বাড়ি। মানুষজন। রাস্তায় চলমান গাড়ি সটাসট পেছনে চলে যাচ্ছে।

 — চা- এ, গরম, গরম চা- এ। আওয়াজটা কানে আসতেই স্বচকিত হলো শঙ্খ। চলন্ত গাড়িতে আজকাল সবই পাওয়া যায়। বিশেষত দূরপাল্লার হলে তো কথাই নেই। গরম সিঙ্গারা সহযোগে চা খেলো শঙ্খ। শরীর- মন বেশ চাঙ্গা লাগলো একটু। সহযাত্রীদের মধ্যেও চা খেলো কজন। অন্য এক জনকে সিগারেট ধরাতে দেখে নিজেও জানালার ধারে বসে একটা সিগারেট ধরালো। এ সময় চায়ের পরে একটা সিগারেট অত্যন্ত সুখদায়ক। এক মুখ ধোঁয়া জানালার গরাদ পেরিয়ে বাতাসে মিশে গেলো। উদাস ভাবে ধোঁয়ার নেশায় এগিয়ে চলে শঙ্খ। মাঝে বার দুয়েক ট্রেন থেমেছিলো কোন স্টেশনে। অপ্রয়োজনীয় জেনেই গুরুত্ব দেয়নি শঙ্খ। যেটা চাহিদা ছিলো কম্পার্টমেন্টে বসেই যখন পেয়ে গেলো। বাইরে আসার দরকার কি। সকালের উদ্বিগ্নতা কিছুটা কেটেছে এই মুহূর্তে। ট্রেনে ভিড় একটু বেড়েছে এ সময়। বর্ধমান পর্যন্ত এ ভিড় থাকে বরাবরই, কিছু লোকাল প্যাসেঞ্জার চাকরি সূত্রে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে এ গাড়ী ধরে। উটকো উৎপাত ও সহ্য করতে হয় রিজার্ভ টিকিট ধারীদের। প্রতিবাদ করা যাবে না। প্রতিবাদ করা যায় না। প্রতিবাদ করে নিজের টুকু ও হারাতে হয়েছে অনেককে। পূর্ব অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত যাত্রীগন সহযোগিতার নামে ঝঞ্ঝাট এড়িয়ে চলে।

হঠাৎই শঙ্খর মনের আঙিনা কেমন মেঘাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। ভাবতে থাকে কিভাবে পরিস্থিতির মোকাবেলা করবে। আগে ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে হবে। কীর্তিমান রিক্সাওয়ালার ফুর্তির শাস্তি দিতে হবে। যারা পরের মেয়ে মানুষ নিয়ে রাতে ফুর্তি করে, তারা দেবতা তুল্য ? একজন মুসলমান লম্পট রিক্সাওয়ালা।মাতাল। চরিত্রহীন মানুষ।সে আবার স্বাতীর কাছে দেবতা তুল্য। এক রাতে অনেক সুখ বিলিয়েছো দেবতা। আমিও তোমায় কয়েক দিন সুখ ভোগ করাবো। একটা সোরগোল হওয়াতে নিমেষে চিন্তার জালখানা ছিঁড়ে গেলো। বর্ধমান স্টেশনে গাড়ি ঢুকলো। সময়সীমা দ্বিপ্রহর প্রায়। যাত্রী ওঠা নামায় গাড়ি কিছুটা ফাঁকা। পার্সেল খাবার কিনে নিলো একটা। জলের বোতল। নিরামিষ খাবার মন্দ থাকে না পার্সেলে। একজন চলমান মানুষের জন্য বেশ ভালো।ভাত,ভাল,আলু পটলের তরকারি, কাঁচ কলার কোপ্তা। একটা মিষ্টি, একটু চাটনি।আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিলো গাড়িটা। ইজ্ঞিন পরিবর্তন হয় এখান থেকে। বিদেশ ইঞ্জিন বাকি রাস্তা টেনে নিয়ে যায়। ইলেকট্রিক লাইন বর্ধমানের পর আর নেই।তাই উত্তর বঙ্গের সমস্ত ট্রেন ডিজেল ইঞ্জিন টেনে নিয়ে যায়। জলের ট্যাঙ্কও ভর্তি হয় এই স্টেশন থেকে। ট্রেন তখন চলতে শুরু করলো মন্থরগতিতে, খাবার শেষ করে সিগারেট টা হাতে নিয়ে বসেছিলো শঙ্খ। গাড়ির গতি বেগ বাড়লো যখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এগিয়ে চলেছে, সিগারেটের সুখ টানে চোখটা ঝিমিয়ে আসছিলো।শেষ সুখটানে তৃপ্ত মনে, হাতের সিগারেটের নটটা জানলা দিয়ে আঙুলের ট্রিগারে দুরে ছুড়ে দিলো।পা দুটো সিটে তুলে একটু কাত হয়ে বসলো শঙ্খ। মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে একটু ঝিমুনির স্বাদ নিতে চেষ্টা করলো। গাড়ির দুলুনিতে শরীরটা বেশ জুড়িয়ে আসছিলো।কখন যে দু’চোখ জুড়ে গিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি। নিশ্চিন্ত সময়ের ফাঁকে সূর্য ক্রমশঃ পশ্চিমে হেলেছে। হু-হু শব্দে ছুটে চলা ট্রেন প্রয়োজন মতো স্টেশনে দাঁড়িয়েছে। আবারো ছুটেছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার কাজের নিয়মনীতি মেনে চলতেই থেকেছে। কতো মানুষ উঠেছে-নেমেছে। কতো সুখ- দুঃখের বার্তা বয়ে নিয়ে চলেছে। ছোট্ট একটা স্টেশনে গাড়ীটা থামলে সামান্য কোলাহলে শঙ্খর তন্দ্রা ভাবটা কেটে গেলো। তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসলো, হাত ঘড়িতে সময় টা দেখলো। সাড়ে তিনটে বেজেছে, মাথাটা সামান্য হেলিয়ে স্টেশনটা দেখলো- আর কয়েকটা স্টেশন পরেই তার গন্তব্য স্থল। নামতে হবে। নাজিরপুর। সহসা একটা চঞ্চলতা,একটা চাপা অস্থিরতার ছায়া খেলে গেলো শঙ্খর শরীরে, মনে। সহযাত্রীরা কেউ বুঝতে পারলে না।পাবার কথা ও নয়। মানুষের পোশাক-আশাকের অভ্যন্তরে যে দেহ, তার ভেতর যে অন্তরাত্মা যেখানে লক্ষ্যভেদ হয় না। চলে না। উপর থেকে তাই কিছু উপলব্ধি করা সাধারণ মানুষের কাম্য নয়। পোশাক- আবরণ ।আবরণের অন্তরালে আসল অন্দরমহল। যার ঠিকানা সে নিজেই। সেখানকার সমস্ত খবর মনটাই দিতে পারে। সে মনের অস্তিত্ব পেতে অনেক কাছে পৌঁছাতে হবে, আবার অনেক মনের কাছে পৌঁছেও তার অস্তিত্বের হদিস পাওয়া যায় না। মন বড় বিষম এক বস্তু। এর সঠিক সংজ্ঞা কি হবে, বলা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। মনের দুটো জিনিস রয়েছে ।একটা ভালো। অপরটা মন্দ। শুদ্ধ-অশুদ্ধ। বড়- ছোট। সাদা- কালো। কোন একটা কাজ শুরু করার মুহূর্তে পবিত্র এবং ভালো মনে শুদ্ধচিত্তে দরাজ এবং শুভ্র চেতনায় যদি করা যায়। তা শেষ পর্যন্ত নিটোল- নির্ভুল হওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না। পরিপূর্ণ হতে বাধ্য থাকবে সে কাজ। বিপরীতে একটা ভুল থেকে কত ভুলের অস্তিত্ব তৈরি হবে। একটা শেষ করার পরে প্রয়াসে শতগহ্বর হাঁ হয়ে থাকবে। কোনটাই শেষ হবে না। উত্তরোত্তর বেড়েই চলবে। অথচ আমরা জেনেও সেই ভুলের ফাঁদে পা রাখি। সেই ভুল না করা পর্যন্ত নিজের ভিতর ছটফট করি।

ট্রেন যখন নাজিরপুর স্টেশনে থামলো চারটে বেজে কুড়ি। শঙ্খ ব্যাগটা নিয়ে নেমে এলো গাড়ি থেকে। চারিদিক তাকিয়ে নিলো। এমনিতেই অল্প কিছু যাত্রী নেমেছে, তাদের বাক্স- প্যাটরা দেখে বোঝা যায়। যে যার গন্তব্যে পৌঁছতে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। প্লাটফর্মের ছাউনির তলায় বেঞ্চে ব্যাগটা রেখে কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবল শঙ্খ। গাড়ি ইত্যবসরে ছেড়ে চলে গেছে। ফাঁকা প্রায় প্লাটফর্ম। শঙ্খ ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে স্টেশন মাস্টারের অফিসের দিকে হাটা দিলো। প্রৌঢ় স্টেশন মাস্টার লম্বা খাতায় চশমার ভেতর দিয়ে দৃষ্টি ফেলে রেখে, কলমের আঁচড় কাটছিলো। হঠাৎ এই কানে এলো,
 — ভেতরে আসতে পারি ?

মাথা না তুলেই স্টেশন মাস্টার বললেন, আসুন। যথারীতি মানুষটা ভেতরে এলো। মাথা না তুলে হাতের ইশারায় সামনের চেয়ারে বসতেও বললেন। কাজটা আপাত শেষ করে স্টেশন মাস্টার মাথাটা তুলে আগন্তুক কে দেখলেন। জানতে চাইলেন, বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি ?
শঙ্খ নিজের সরকারি সীলমোহর করা বিএসএফের আইডেন্টিটি কার্ডখানা মাস্টারের সামনে দিয়ে বললেন, -আপনার কাছে একটা সত্যতা যাচাই করতে এসেছি। আশা করি আপনি সাহায্য করবেন ?

 — অব কোর্স। তার জন্য এই পরিচিতির ও প্রয়োজন হবে না। বলুন কি করতে হবে আমাকে? স্টেশন মাস্টার বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন।

শঙ্খ বললো, গত পরশু রাত্রে, নটা পঞ্চাশের কলকাতার গাড়ি ধরতে না পেরে আপনার দ্বারস্থ হয়েছিলো কোন মেয়ে ?
স্টেশন মাস্টার একটু সময় যেন ভাবলেন। বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার কাছে এসেছিলো। সঙ্গে একটা বাচ্চা মেয়েও ছিলো। রাত্রে স্টেশনে থাকতে চেয়েছিলো। আমার এখানে রেস্টরুম বা গেস্টরুম যাই বলুন না কেন, কোনটাই নিরাপদ নয়। কাছেপিঠে হোটেল ও কিছু নেই। অতএব আমার এখানে থাকার কোন ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে একজন মেয়ে লোকের।
শঙ্খ বললো, শেষ পর্যন্ত কি ব্যবস্থা করলেন তাহলে ?

 — কিছু একটা ব্যবস্থা তো হয়েছিলো। বলেই মাস্টার মশাই শঙ্খকে প্রশ্ন করলেন, — আগে আপনি বলুন আপনার পরিচয় ? কেনই বা এভাবে জানতে চাইছেন ?
শঙ্খ বললে, উনি আমার স্ত্রী, সঙ্গে আমার মেয়ে।
স্টেশন মাস্টার বললেন, আপনার স্ত্রী কি কোন অভিযোগ করেছেন ? সেটার জন্য আপনি সুদূর কলকাতা থেকে ছুটে এসেছেন । আর তাকেই বা সঙ্গে আনলেন না কেন ? তাহলেই তো ভালো হতো। সামনা-সামনি ফয়সালা পেয়ে যেতেন।

শঙ্খ বললো, তার প্রয়োজন নেই । কিন্তু কিসের উপর ভরসা করে একজন সম্ভ্রান্ত বাড়ির মেয়েকে, একটা বাজে জায়গায় লম্পটের হাতে তুলে দিলেন ? কতো টাকা পেয়েছিলেন বিনিময়ে ?
প্রৌঢ় স্টেশন মাস্টার কিছুটা আহত হলেন । বললেন, কি সব বাজে কথা বলছেন ? সংযমী ভাষা বলুন। সেদিন যদি আশ্রয় না দিতাম, তাহলে হয়তো নিজে থেকেই ওই অবস্থায় পড়তে হতো। আজাদ কলোনিতে যান ।

গিয়ে সকলের কাছে পরিচয় নিন। আরশাদ শেখ কেমন মানুষ। গরিব মুসলমান রিকশাচালক তার বিবি রিজিয়া আনপড় অশিক্ষিত মেয়ে। কিন্তু অনেক শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত ধনী মানুষের থেকে অনেক অনেক বড়। এর দীল আছে। মনুষ্যত্ব আছে। নম্রতা- ভদ্রতা আছে। আর আছে পাহাড় প্রমাণ উদারতা । তথাকথিত আমাদের মতো ভদ্র সমাজের ভদ্রজনেদের নেই।
শঙ্খ বললো, রাতের অন্ধকারে পরের মেয়ে মানুষ পেলে ভদ্রতা আর থাকে না। বস্তির নোংরা পরিবেশে মদ আর মেয়ে নিয়ে উদারতা আমার জানা আছে।

এবার একটু ক্ষিপ্ত হলেন স্টেশন মাস্টার। বললেন বাজে কথা আমার সামনে বলবেন না। সেদিন যা করেছিলাম আমার মেয়ে হলেও তাই করতাম। যদি অন্যায় কিছু প্রমাণ করতে চান, তাহলে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আসুন। না হলে আপনি আসতে পারেন। কিছু করার থাকলে করতেও পারেন।
শঙ্খ বললো, কিছু করার জন্যই এসেছি ।
উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের উত্তাপে পাশের ঘর থেকে লোকজন ছুটে এলো। স্টেশন মাস্টারকে বললে, একজন — কি হয়েছে স্যার ?

শঙ্খ ব্যাগটা হাতে নিয়ে, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে আসতে চাইছিলো।
একজন বললো, কি হয়েছে দাদা? চেঁচামেচি কেন ? কি হয়েছে আপনার ?
শঙ্খ কিছুটা ঘাবড়ে গেলো, বললো — না তেমন কিছু নয়।
একজন দরজা আগলে দাঁড়ালো। বললো, — কিছু নয় মানে ?

স্টেশন মাস্টার হঠাৎই কেমন বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। হাতের ইশারায় ওকে ছেড়ে দিতে বললেন।
শঙ্খ ফাঁকা দরজা পেয়ে স্টেশন মাস্টারের ঘর ছেড়ে, প্লাটফর্ম টপকে বাইরের রাস্তায় নামলো।
সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই পরিবেশ। রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। রিক্সা স্ট্যান্ডের অশ্বত্থ গাছটায়
রাতের আশ্রয় পাখিদের। কিচিরমিচির শব্দে সান্ধ্য বরণে ব্যস্ত এরা। ছোট্ট দোকানটায় এক কাপ চা নিলো শঙ্খ। চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে রিক্সা স্ট্যান্ডে গেলো।
শঙ্খ বললো, লোকাল থানা এখান থেকে কতো দূর ?
মাঝ বয়সী খয়াটে চেহারার রিক্সাওয়ালা। যাত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, –তা আধঘন্টা লাগবে, কাশপুর যেতে হবে।

শঙ্খ বললো, কতো ভাড়াটে লাগবে ?
রিক্সাওয়ালা বললো, চল্লিশ টাকা দিতে হবে বাবু।
শঙ্খ বললো, চল্লিশ বলো কি ভাই ! বেশি বলে ফেললে না ?
রিক্সাওয়ালা বললো, বেশি কেন বলবো। যা দাম তাই বলেছি বাবু।
রিকশায় চেপে বসলো শঙ্খ। চলতে শুরু করলো রিক্সা। আলো-আঁধারের পিচ ঢালা রাস্তা, বাস রাস্তা সোজা গেছে তেঁতুল বাগান। সেখান থেকে জাতীয় সড়ক। রিক্সা বাস রাস্তা থেকে ডান দিকে ঢুকে গেলো। বেশ পুরনো বাধাই রাস্তা।অনেক জায়গায় এবড়োখেবড়ো। রাস্তায় টিম টিমে আলো বাড়তি স্তম্ভের। ওঠানামায় এগিয়ে চলে রিকশা। সোজা হয়ে বসে থাকা বেশ কষ্টকর। ব্যাগ টাকে কোলে তুলে নিয়ে, একটু চেপে বসার চেষ্টা করলো শঙ্খ। তারপর বললো, একটু দেখে চালাও ভাই, রাস্তা বড্ড খারাপ। সিটে বসা যাচ্ছে না।

রিক্সাওয়ালা বললো, কি করবো বাবু, রাস্তার হালত এমনটাই। আমাদের যা কষ্ট হয়- কাকে বলবো। লোকে পয়সা দেওয়াটা দেখে। কষ্টটা কেউ দেখে না বাবু- বুঝলেন। হাঁপ ধরা গলা।
শঙ্খ উদাস ভাবে বললো, ঠিকই বলেছো, কি বা করার আছে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই রিক্সা থানার সামনে এসে দাঁড়ালো। হাল-আমলের রং করা পুরনো একতলা বাড়ি। আশপাশ একটু ফাঁকা, সামনে একটা কালো রঙের পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে ।ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু চারজন লোক। গেটের মুখে একজন বন্দুকধারী পুলিশ দাঁড়িয়ে। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে গেটের সামনে গেলো শঙ্খ বললো, বড়বাবু আছেন ?

পুলিশটা বললো, আছেন অপেক্ষা করুন। ঘরে লোক আছে। সামনের বেঞ্চে বসার জন্য দেখিয়ে দিলো।
ভিতরে ঢুকে ব্যাগটা পাশে রেখে একটু আরাম করে বসলো শঙ্খ। রিকশায় বসে একটু কষ্ট পেতে হয়েছে তাকে। মনে মনে ভেবেনিচ্ছিল কিভাবে উত্থাপন করবে তার কথাগুলো। কিভাবে নেবেন ব্যাপারটা, তার উপরে নির্ভর করবে সবকিছু। আই কার্ড দেখালে এখানে কিছু প্রাধান্য পেতে পারে সে। যেহেতু সে নিজে একজন ডিফেন্স কর্মী। অনেক ভাবনার জটিল গহ্বরে আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছিলো শঙ্খ।এই প্রতিহিংসা-পরায়ণতা কেন রে তার মধ্যে এলো বোঝা গেল না । কার পাপে কে শাস্তি পাবে ? সত্যিই কি পাপ কিছু আছে ? স্বাতী কি কিছু পাপ করেছে ? তাহলে স্বাতীর উপরে কি কেউ অন্যায় করেছে ? স্বাতী কি কারো কাছে কোন অভিযোগ করেছে ? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি নেই। আসলে এইসব প্রশ্নই বা কে করেছে, যে তার উত্তর দিতে হবে। আর উত্তর সঠিক না হলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। কে উত্তর দেবে ?

 — আপনি আসুন‌। এই যে দাদা। পুলিশকর্মীর ডাকে অতল গহ্বর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো শঙ্খ।
দরজা ঠেলে বড় বাবুর ঘরে ঢুকলো। তারই বয়সী প্রায়। বুকে নেমপ্লেটে অজয় সিনহা লেখা। নমস্কার বিনিময়ে সামনে চেয়ারে বসলে শঙ্খ। নিজের বুক পকেট থেকে আই কার্ড বের করে মিস্টার সিংহাকে দিয়ে বললে, – খুবই অসহায় হয়ে আপনার কাছে সুবিচারের আশায় এসেছি কলকাতা থেকে। কার্ডখানা ফেরত দিয়ে অজয় সিনহা বললেন, — বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি ?

শঙ্খ বললো, গত পরশু রাতে কলকাতা যাবার গাড়ি মানে ট্রেন না পেয়ে, নাজিরপুর স্টেশনে রাত্রি দশটার পরে স্টেশন মাস্টারের কাছে গিয়ে- আমার স্ত্রী সঙ্গে ছোট মেয়েও ছিল আশ্রয় চেয়েছিলো রাত্রিযাপনের। উনি স্টেশনে থাকার জন্য নিরাপদ আশ্রয় নেই বলে এবং কাছাকাছি থাকার জন্য কোন হোটেল ব্যবস্থা নেই বলে। সেই রাত্রে একজন মুসলিম রিকশা চালক, যার নাম আরশাদ শেখ। তার আজাদ কলোনির বস্তি বাড়িতে আমার স্ত্রী ও মেয়ের থাকার ব্যবস্থা করেন। ভদ্রলোকের মিষ্টি কথা এবং মুহূর্তের ব্যবহারে অসহায় মেয়ে ওই রাত্রে ওই রিক্সাওয়ালার সঙ্গে তার বস্তির জঘন্য পরিবেশের মধ্যে রাত্রি যাপন করতে বাধ্য হয়। আর ওই লম্পট রিকশাওয়ালা আমার স্ত্রীর শ্লীলতাহানি করে, ঘরে ওর বউ পর্যন্ত এই কাজে সহায়তা ছাড়া স্ত্রীর সঙ্গে র ব্যাগ থেকে চার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। লজ্জায় ঘৃণায় কোনোরকমে রাত্রি কাটলে মেয়েকে নিয়ে সকালেই স্টেশনে পৌঁছয়‌। এবং সকালে ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরে। আমার স্ত্রীকে যদিও নিয়ে আসবো ভেবেছিলাম। কিন্তু এতটাই সে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে যে, না জানি জীবনে কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে। যদিও এই পরিস্থিতি অন্য কাউকে বলতে পারিনি।

শঙ্খর বলা কথাগুলো একটা রাইটিং প্যাডে লিখছিলেন অজয় সিনহা। পাশের ঘরের এসিস্ট্যান্ট ওসিকে ডেকে প্যাডটা দিয়ে বললেন,
 — এটা একটা ডাইরি লিখুন। আজ রাতে ইনভেস্টিগেশনে যেতে হবে তৈরি থাকুন। শঙ্খ বাবু, আপনার কথা শুনলাম ডাইরি করে নিচ্ছি। তবে যতটুকু জানি- নাজিরপুর স্টেশন মাস্টার অমৃতলাল বসু ভদ্রলোক। ভালো মানুষ। সজ্জন ব্যক্তি। লোক নির্বাচন ভুল হতেই পারে। বস্তি বাড়িতে বসবাস ভদ্রলোকের হয় না সকলেই জানি। অতএব অঘটন ঘটতেই পারে। আপনি নিশ্চিত থাকুন। অপরাধীর হলে তার শাস্তি হবে।

শঙ্খ বললো, — কিন্তু আমি তো রাতের গাড়িতেই কলকাতায় ফিরবো।
অজয় সিনহা বললেন, – ডাইরি স্লিপ নিয়ে আপনার ফোন নম্বর লিখে দিয়ে যান। খবর পেয়ে যাবেন।
চেয়ার ছেড়ে উঠে পকেট থেকে চারখানা পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে মুড়ে, হ্যান্ডশেক করার মুহূর্তে হাতে দিয়ে শঙ্খ বললে, – কাছে হোটেল থাকলে আপনার সঙ্গে থাকতাম। নেই যখন মন্দ ভাগ্য। না করবেন না।

— আরে, না– না। দরকার নেই। লাগবে না । অজয় সিনহার মৃদু আপত্তি।

শঙ্খ নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে এলো বড়বাবুর চেম্বার থেকে। পাশের ঘরে ঢুকে ডায়েরির টোকেন নিলো। ফোন নম্বরটা লিখিয়ে দিলো। থানা থেকে বেরিয়ে একটু ফুরফুরে হালকা লাগলো নিজেকে। একটা জয়ের হাতছানি তার চোখের সামনে। দাঁড়িয়ে থাকা রিকশায় ওঠার আগেই একটা সিগারেট ধরালে। রিক্সা চলতে শুরু করলে কোলের উপর ব্যাগটা ধরে ধোঁয়ায় মনটা ছেঁকে নিতে থাকলো। হাত ঘড়িতে সময় টা দেখল একবার আটটা পনেরো। ট্রেন নটা পঞ্চান্ন অনেক সময় আছে । স্টেশনের বাইরের দোকানে কিছু খেয়ে নেবে। টিকিট কিনবে। নটার মধ্যে স্টেশনে পৌঁছালো শঙ্খ। কাউন্টারে টিকিট কাটতে গিয়ে এস ফোর কোচে একটা রিজার্ভেশন পেলো শঙ্খ। আপার শিট আরাম করে রাত্রিটা শুয়ে শুয়ে যাওয়া যাবে। টিকিট নিয়ে বাইরে এসে খাবারের দোকানে ঢুকলো।

লুচি, তরকারি, মিষ্টি সহযোগে রাতের খাওয়া সারতে হলো। ভাতের জোগাড় রাত্রে এখানে নেই। দোকান থেকে বেরিয়ে সিগারেট ধরালো একটা। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে চারিদিক তাকিয়ে দেখলো একবার। আজাদ কলোনি কোন দিকে বা কতদূর যাবার সময় হাতে নেই। তবু কোন দিক জানার ইচ্ছে হচ্ছিলো তার। অতিরিক্ত সময় আজ হাতে নেই, ইচ্ছেটা তাই মনে রেখেই স্টেশনের দিকে এগোলো। দু’ নম্বর প্লাটফর্মে গাড়ি আসবে। একটু আগে ঘোষণা হয়েছে। পায়ে পায়ে দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছালো শঙ্খ ।আন্দাজ মতো দাঁড়ালো একটা জায়গায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু যাত্রী। ট্রেন অল্পক্ষণের জন্য দাঁড়ালো। নিজের সিট বেছে উপরে বার্থে উঠে শটান শুয়ে পড়লো মাথায় ব্যাগটা রেখে। সারাদিনের ক্লান্তির পর গাড়ির দোলায় কখন ঘুমের দেশে তলিয়ে পড়লো বুঝতেই পারলো না।

জয়নাল আবেদিন | Joynal Abedin

New Bengali Novel 2022 | ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ১) | উপন্যাস

New Bengali Novel 2022 | ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ২) | উপন্যাস

New Bengali Novel 2022 | ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ৩) | উপন্যাস

New Bengali Novel 2022 | ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ৪) | উপন্যাস

খুঁজে ফিরি বিশল্যকরণী | বিশল্যকরণী | বিশল্যকরণী | রামায়নের বিশল্যকরনী | বিশল্যকরণী গাছের উপকারিতা | লাল বিশল্যকরণী | মৃতসঞ্জীবনী গাছ | বিশল্যকরণী গাছের গুনাগুন | মৃত সঞ্জীবনী গাছের উপকারিতা | বিশল্যকরণী গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম | বিশল্যকরণী কী | বাঁচানো হোক বিশল্যকরণী | শব্দদ্বীপের লেখক | শব্দদ্বীপ | সেরা বাংলা গল্প | গল্প ও গল্পকার | সেরা সাহিত্যিক | সেরা গল্পকার ২০২২ | বাংলা বিশ্ব গল্প | বাংলা গল্প ২০২২ | বাংলা ম্যাগাজিন | ম্যাগাজিন পত্রিকা | শব্দদ্বীপ ম্যাগাজিন

Bisholyokoroni | bengali novel | indian poetry | indian poetry in english | indian poetry in urdu | indian poems | indian poems about life | indian poems about love | indian poems about death | bengali story | bengali story books for child pdf | bengali novel for adults | bengali story books | bengali story books for child | bengali novel pdf | bengali story for kids | bengali novel reading | short story | bengali novel analysis | bengali novel characteristics | bengali novel competition | short story definition | short story english | short story for kids | short story generator | short story ideas | bengali novel length | long story short | bengali novel meaning | long story | long story instagram | story writing competition | story writing competition topics | story writing competition for students | story writing competition malayalam | bengali novel competition india | story competition | writing competition | writing competition malaysia | writing competition london | writing competition hong kong | writing competition game | writing competition essay | writing competition australia | writing competition prizes | writing competition for students | writing competition 2022 | writing competitions nz | writing competitions ireland | writing competitions in africa 2022 | writing competitions for high school students | writing competitions for teens | writing competitions australia 2022 | writing cmpetitions 2022 | writing competitions uk | bengali novel writing | bangla news article | bangla article rewriter | article writing | bengali novel ai | bengali novel app | article writing book | bengali novel bot | bengali novel description | bengali novel example | article writing examples for students | article writing for class 8 | article writing for class 9 | bengali novel format | bengali novel generator | article writing global warming | article writing igcse | article writing in english | article writing jobs | article writing jobs for students | article writing jobs work from home | article writing lesson plan | bengali novel on child labour | article writing on global warming | article writing pdf | bengali novel practice | article writing topics | trending topics for article writing 2022 | what is article writing | bengali novel trends 2023 | bengali novel topics 2023 | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder

Leave a Comment