Bengali Article 2023 | “স্তন কর” বিরোধী নারী আন্দোলন ও নাঙ্গেলির (Nangeli) আত্মত্যাগ

Sharing Is Caring:

“স্তন কর” বিরোধী নারী আন্দোলন ও নাঙ্গেলির (Nangeli) আত্মত্যাগ

বিশ্ব আঙ্গিনায় নজর করলে দেখা যায় বহু প্রাচীন কাল থেকেই নারীরা নিজেদের সম্ভ্রম, অধিকার, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান রক্ষার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে এসেছে। এইরকম প্রচুর উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। ১৬৪৭ সালে তৎকালীন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম নারীরা তাদের সম্ভ্রম ও অধিকার রক্ষার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। আর সেখান থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারীদের মধ্যে এই আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শুধু আমেরিকা নয় পরবর্তী সময় ফ্রান্সেও নারী অধিকার রক্ষার আন্দোলনের এক সক্রিয় নেত্রী হিসেবে এক নারীর নাম পাওয়া যায়। তিনি হলেন ফ্রান্সের নাট্যকার ও বিপ্লবী নারী ওলিম্পে দ্যা গগ্স। নারী অধিকার রক্ষার আন্দোলনের আগুন সে সময় এতটাই তীব্র থেকে তীব্রতর পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে সেই আগুনকে স্তব্ধ করার জন্য ১৭৯৩ সালে এই নারী নেত্রীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে ফ্রান্সের সরকার। তবে এই বিষয়ে কিছুটা মতান্তরও পাওয়া যায়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে এবং NCRT কর্তৃক প্রকাশিত স্কুল ভিত্তিক কিছু বইতে পাওয়া যায় যে, ওলিম্পে দ্যা গগ্সকে ডাইনি সন্দেহে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

ফ্রান্সের নারী অধিকার রক্ষা আন্দোলনের দুর্দন্ডপ্রতাপ নেত্রী তথা নাট্যকার ওলিম্পে দ্যা গগ্স’র হত্যার মধ্য দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ফরাসি সরকার এই আন্দোলনকে দমন করলেও, এই আন্দোলনের আগুনে বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও নারীরা সংঘটিত হতে থাকে। সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে, ধর্মীয় কুপ্রথা থেকে, দাসত্ব থেকে নিজেদের মুক্ত করার তাগিদে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন চরিত্রের নারী আন্দোলন সংঘটিত হতে থাকে। সেই রকমই তৎকালীন সময়ের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নারী আন্দোলনের নেত্রীরা হলেন মার্গারেট ব্রেন্ট, মার্গারেট লুকাস, মেরি ওলস্ট্যানক্রাফট প্রমুখ। নারী আন্দোলনের এই আগুন স্তিমিত হয়নি বরং লেলিহান শিখার মত রূপ নেয় দাবানলের। ১৮৪০ সালে নারী আন্দোলন নিয়ে দারুণভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেন এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন, লুক্রেশিয়া মটো, সুশান বি অ্যান্টনি, লুসি স্টোন, অ্যাঞ্জেলিনা এম গ্রিম, সারা এম গ্রিম প্রমুখ নারী নেত্রীরা।

বিশ্বের দরবার থেকে যদি আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাসে নজর রাখা যায় সেখানেও এই নারী আন্দোলনের প্রমাণ লক্ষ্য করা যায়। আঠারো শতকের প্রথমার্ধেই ভারতবর্ষের ত্রিবাঙ্কুর অঙ্গরাজ্যে নারীদের অধিকার রক্ষা, লজ্জা নিবারণ, সম্ভ্রম রক্ষা, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান রক্ষার তাগিদে এই আন্দোলনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে এক নারী নিজের জীবন দিয়ে নিজের সম্মান, সম্ভ্রম, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান রক্ষার মাধ্যমে তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রচলিত এক ধর্মীয় কুপ্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং সেই প্রথা বন্ধ করার বার্তা দিয়ে যান।

“স্তন আমার… সেটা অনাবৃত রাখব নাকি আবৃত, সে নিয়ম করার তুমি কে”?
অবাক হলেন তো !! হঠাৎ করে এরকম অদ্ভুত ও বিতর্কিত দুটি প্রশ্নের অবতারণা কেন ? না এখানে কোন অশ্লীলতার গন্ধ নেই, বরং আছে আমাদেরই ভারতবর্ষের দক্ষিণে অবস্থিত তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক ত্রিবাঙ্কুর অঙ্গরাজ্যে (বর্তমানে কেরল ও তামিলনাড়ুর সীমান্তবর্তী অঞ্চল) প্রচলিত এক ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় কুপ্রথা বা কর ব্যবস্থার কথা। ১৭৫০ সাল নাগাদ তৎকালীন কেরলের ত্রিবাঙ্কুরে শ্রী উথ্রাডম তিরুনাল মার্থন্দা ভার্মা চেরা রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত এই রাজত্ব “ট্রাভানকোর কিংডম” নামে পরিচিত ছিল। এই পরিবারের মহিলারা “অ্যাটিংটাল কুইন্স” নামে পরিচিত ছিল। অ্যাটিংটালকে ট্রাভানকোর রাজাদের পৈত্রিক বাড়ি হিসাবেও বিবেচনা করা হত। ভি. নাগম আইয়া, এ. শ্রীধারা মেনন প্রমুখ ঐতিহাসিকরা বলেছেন যে, অ্যাটিংটাল কখনও আলাদা রাজ্য ছিল না কিন্তু পরিবারের পুরুষ প্রধান (রাজা) রাজকীয় মহিলাদের দেওয়া এস্টেট এবং প্রদেশ ছিল। এই সময়কালে এই অঞ্চলের প্রভূত উন্নতি সাধন হয় কিন্তু সাথে সাথে সাধারণ ও নিম্ন বর্ণের ও নিম্ন ধর্মের মানুষ বা প্রজাদের উপর আরোপিত হয় বিভিন্ন ধরনের করের বোঝা। জনৈক ব্রিটিশ লেখক স্যামুয়ের ম্যাটিয়ারের লেখা “নেটিভ লাইফ ইন ট্রাভানকোর” বইটি থেকে জানা যায় যে, আনুমানিক সতেরো শতকের সত্তর দশকের মধ্যভাগ থেকে উক্ত অঞ্চলে আনুমানিক ১১০ ধরনের কর-ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এই বইটি থেকেই জানা যায় যে, তৎকালীন সময়ে এই অঞ্চলে নিম্নবর্ণের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোন অলংকার পরিধানের জন্য এমনকি নিম্ন বর্ণের পুরুষদের গোঁফ রাখার উপরেও কর ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। হলো তো নিম্ন শ্রেণীর পুরুষেরা গোঁফ রাখতো না। তবে এখানকার নিম্নবর্ণীয় ও নিম্নধর্মীয় মহিলাদের মধ্যে প্রচলিত সবথেকে উল্লেখযোগ্য এবং নক্কারজনক যে কর ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল সেটি হল “স্তন কর” বা “Breast Tax”। স্থানীয় ভাষায় এই কর ব্যবস্থাকে বলা হত “মুলাক্করম”। তৎকালীন এই “স্তন কর” ব্যবস্থা সম্পর্কে কেরালায় অবস্থিত শ্রীশংকরাচার্য সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জেন্ডার ইকোলজি এবং দলিত স্টাডি’ বিভাগের সহ অধ্যাপক ডক্টর সেবা কে.এম. বলেন “The purpose of the breast-tax was to maintain the caste structure,”

তৎকালীন ত্রিবাঙ্কুর অঙ্গরাজ্যের রাজার প্রচলিত নিয়ম অনুসারে এখানকার দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত তথা অন্যান্য নিম্নবর্ণীয় ও নিম্নধর্মীয় মহিলাদের শরীরের উপরের অংশ তথা স্তন জনসমক্ষে বা উচ্চ বর্ণের পুরুষদের সামনে উন্মুক্ত রাখতে হত। বর্ণবাদী সেই সমাজে মনে করা হতো, পোশাক পরার অধিকার থাকবে শুধু ‘উচ্চবর্ণের’ মানুষের এবং রাজ পরিবারের মানুষদেরই আছে। ফলে উচ্চবর্ণের পুরুষদের সামনে নিচু সম্প্রদায়ের নারীদের বুক খোলা রাখতে হতো। এটাকে দেখা হতো ভদ্রতার নিদর্শন হিসেবে। পোশাক ছিল তখন ধনসম্পদ ও আভিজাত্যের প্রতীক। তবে যদি কোনো নারী তার স্তনকে কাপড় দ্বারা আবৃত করতে চাইত, তাহলে তাকে “স্তন কর” দিতে হতো। আর এই কর-ব্যবস্থায় কর নির্ধারণের রীতিটি ছিল নারীদের কাছে আরও বেশি অপমানজনক। এই কর ব্যবস্থায় নারীদের স্তনের সাইজ অনুযায়ী কোন নারীর প্রদেয় “স্তন কর” নির্ধারিত হতো। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে নারীদের অপমানজনক এই “স্তন করের” পরিমাপ করা হতো জনসমক্ষে। মূলত নিম্নবর্ণের মানুষকে অসম্মানিত করতেই তখন এই রীতির প্রচলন করেছিল উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। নিম্নবর্ণের মানুষের বেশিরভাগের আয়ও ছিল খুব কম। তাই কথিত “স্তন কর” দেওয়া সম্ভব হতো না তাদের পক্ষে। ফলে সামান্য এই আয়ে দৈনন্দিন দিন গুজরান এবং সাথে সাথে করের বোঝা কমানোর তাগিদে নিজেদের লজ্জা, আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা সর্বোপরি নারীর সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়ে স্তনসহ বুক খোলা রাখতে হতো তাদের। “মুলাক্করম” বা “স্তন করের” বড় অংশই যেত ত্রিবাঙ্কুরের রাজাদের কুলদেবতা পদ্মনাভ মন্দিরে। তবে এই নিয়ম যে সমাজের সকল শ্রেণী বা স্তরের নারীদের জন্য প্রচলিত ছিল তা নয়। তৎকালীন সময়ে এই রাজ্যের শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ মহিলারা নিজেদের স্তনকে এক টুকরো সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারতো। ওই সময় এই অঞ্চলে শুধুমাত্র হিন্দু নয়, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর মানুষেরও অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর নারীরা নীল রঙের ছোট জ্যাকেটের (বর্তমানে ছোট ব্লাউজের মতো) আবরণে নিজেদের স্তনকে আবৃত করতে পারত।

তৎকালীন ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা কর্তৃক আরোপিত “স্তন কর” সহ বিভিন্ন ধরনের পর থেকে প্রাপ্ত খাজনা বা অর্থ মূলত হিন্দু ব্রাহ্মণ সমাজের উঁচু শ্রেণির কিছু ব্যক্তি ও তাদের সহযোগী বিশেষ সুবিধাভোগী কিছু অংশের লোকেরাই আদায় করতো এবং আদায়কৃত এই “স্তন কর” বা ব্রেষ্ট ট্যাক্স সহ সমগ্র আদায়কৃত অর্থে একটি অংশ ভোগ করতো। একটি অংশ জমা পরতো রাজকোষে আর এর বড় অংশই চলে যেতো বিখ্যাত পদ্মনাভ মন্দিরের পুরোহিতদের কাছে। এই পদ্মনাভ মন্দির ছিল তৎকালীন ত্রিবাঙ্কুরের চেরা রাজবংশের মানুষদের কাছে প্রধান আরাধ্য মন্দির। বলা যেতে পারে কুলো দেবতা। এই পদ্মনাভ মন্দিরটি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মন্দির হিসেবে বিবেচিত যা গিনেস বুকে উল্লেখ করা আছে। পদ্মনাভ মন্দিরের তৎকালীন পুরোহিতরা দাবী করেন এবং স্পষ্ট করে বলেন যে, নিম্ন বর্ণের হিন্দু মহিলারা তাদের শরীরের উপরের অংশ বিশেষ করে বুক ঢেকে রাখতে পারবে না। তাদের মতে এটি ধর্ম বিরোধী কাজ। অনেকে মনে করেন, তৎকালীন তথাকথিত ব্রাহ্মণ শ্রেণীর মতানুসারে নিম্ন বর্ণের ও শ্রেণীর মহিলারা বক্ষ বা স্তন আবৃত করে রাখলে তা উচ্চ বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ শ্রেণীকে এবং রাজ পরিবারকে অপমান করা হয়। সাথে সাথে তারাও চরম পাপের ভাগীদার হয়।

দলিত শ্রেণীর মানুষদের আজীবন ঋণের নিগড়ে বেঁধে রাখার এই ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রক্রিয়া ছিল তৎকালীন নারীদের কাছে অত্যন্ত অস্বস্তিকর এবং চরম অপমানজনক একটি রীতি। এই কর ব্যবস্থা ছিল “শাঁখের করাতের” মত কারণ নারীরা নিজেদের লজ্জা, সম্মান, সম্ভ্রম রক্ষা করতে চাইলে দিতে হতো বিপুল পরিমাণে “স্তন কর”। আবার এই “স্তন কর” দিতে না পারলে নিজেদের লজ্জা ও সম্ভ্রম তো যেতই, সাথে সাথে চলতো অকথ্য অত্যাচার ও চরম নির্যাতন। হলো তুই তৎকালীন নিম্নবর্ণীয় ও শ্রেণীর নারীরা ছিল দিশেহারা। কিন্তু সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে দিন পরিবর্তন হয়, নিয়মের পরিবর্তন হয়। গড়ে ওঠে প্রতিরোধ, আন্দোলন। ঠিক তেমনভাবে এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে আর সেই প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আলাপুঝার নিম্নবর্ণীয় এঝাওয়া সম্প্রদায়ের এক অসম সাহসী প্রতিবাদী নারী। এই অসম সাহসী প্রতিবাদী নারী নেত্রীর নাম ছিল নাঙ্গেলি (Nangeli)।

১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে কেরালা রাজ্যের ত্রিভাঙ্কুরের (এখনকার কেরালা ও তামিলনাড়ুর কিছু অংশ) আলাপুঝার এঝাওয়া সম্প্রদায়ের এক নিম্নবর্ণের কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন নাঙ্গেলি। যথা সময়ে তাঁর বিবাহও হয়েছিল। তারা ছিলেন নিঃসন্তান। নাঙ্গেলি (Nangeli) ছিলেন যথেষ্ট উদ্যমী, বুদ্ধিমতী ও কর্মদ্যম মহিলা। তাই তাকে পরিবারের বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন সময়ে বাইরেও যেতে হতো আর সেই কারণেই তিনি এই অস্বস্তিকর ও অপমানজনক “স্তন বরের” বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। অস্বীকার করেন নিজের লজ্জা, সম্মান, সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়ে জনসমক্ষে উচ্চবর্ণের পুরুষদের সামনে নিজের বক্ষদ্বয় বা স্তনকে অনাবৃত রাখতে। তিনি নিজের বক্ষদ্বয়কে বা স্তনদ্বয়কে কাপড় দ্বারা আবৃত করে রাখতে শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই সমাজের তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষদের তা চোখে পড়ে। এবং তারা নাঙ্গেলিকে (Nangeli) “স্তন কর” দেবার জন্য চাপ দিতে শুরু করেন। কিন্তু নাঙ্গেলি (Nangeli) তৎক্ষণাৎ সেই কর দিতে অস্বীকার করেন তাদের দারিদ্র্যতার জন্য, সাথে অবশ্যই ছিল তার সাহসী ও প্রতিবাদী মন। শুরু হয় তার ওপর মানসিক নির্যাতন। তাকে বাধ্য করা হয় জনসমক্ষে তার বক্ষদ্বয় অনাবৃত রাখতে। কিন্তু তিনি তো আর পাঁচজনের মত সাধারণ নারী ছিলেন না বরং ছিলেন বুকভরা প্রতিবাদী বারুদ ভর্তি অসম সাহসী এক নারী। এর ফলস্বরূপ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে তার উপর অর্পিত “স্তন করের” পরিমাণ। এরপরেই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, সেই অন্তিম মুহূর্ত। জেগে ওঠে এক প্রতিবাদী নারী। যিনি এই সমাজতান্ত্রিক ব্রাহ্মণবাদী নিপীড়নমূলক রীতির প্রতিবাদে হয়ে ওঠেন লেলিহান বহ্নিশিখা। কিন্তু কি এমন ঘটেছিল তখন যার জন্য পরবর্তী সময় এই প্রতিবাদী সত্তা বা এই প্রতিবাদের আগুন পরিণত হয় ছাই চাপা আগুনে ? যে আগুনের সমাপ্তি ঘটে কাপড়ের দাবিতে “কাপড়ের বিপ্লব” দিয়ে।

কিন্তু নাঙ্গেলির (Nangeli) এই প্রতিবাদ এবং প্রচলিত কাহিনীটি কতটা সত্য বা প্রাসঙ্গিক সে বিষয়ে বর্তমানেও বহু বিতর্ক রয়েছে। অনেকের ঐতিহাসিকদের মতে এই ঘটনা সম্পূর্ণ সত্য আবার অনেকের মতে এটি একটি প্রতিবাদ মূলক কল্পকাহিনী। নাঙ্গিলির পরিবার ছিল দরিদ্র। পরিবারের জন্য রোজগার করতে প্রতিদিনই বাইরে যেতে হতো তাকে। কিন্তু বুক খোলা রাখতে রাজি ছিলেন না নাঙ্গেলি (Nangeli)। ফলে অনেক টাকা স্তনকর জমে যায় তার। এক পর্যায়ে তার বাড়ী গিয়ে করের টাকার আদায়ে তাগাদা দিতে থাকে রাজার লোকেরা। কিন্তু তার পক্ষে এই টাকা পরিশোধ করা সম্ভব ছিল না। ফলে শুরু হয় মানসিক, সামাজিক ও অকথ্য শারীরিক নির্যাতন। তবুও দমানো যান নি নাঙ্গেলিকে (Nangeli)। নিজের অবস্থান থেকে তাকে এক চুলও নড়ানো যায়নি। উচ্চবর্ণের মানুষদের সামনে নিম্নবর্ণের নাঙ্গেলিকে (Nangeli) তার বক্ষদ্বয় অনাবৃত রাখতে বাধ্য করা যায়নি। একদিন গ্রামের প্রবথিয়রা নাঙ্গেলির স্তনের জরিপ করে পূর্ণ কর আদায়ের উদ্দেশ্যে আরো বেশকিছু উচ্চপদস্থ মানুষদের নিয়ে নাঙ্গেলির (Nangeli) বাড়িতে আসেন। কর্মকর্তা দেখতে পেলো যে, নাঙ্গেলি (Nangeli) তার বুকে স্তনের ওপর কাপড় পরিধান করে আছে। কর্মকর্তা নাঙ্গেলির (Nangeli) থেকে এজন্য কর দাবী করলো এবং তাকে বারবার কর পরিশোধের জন্য চাপ দিতে লাগলো। কিন্তু নাঙ্গেলি (Nangeli) স্তন কর দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এভাবে দিনের পর দিন শুল্ক সংগ্রাহক তার বাড়িতে এসে শুল্কের দাবী আদায়ে চাপ প্রয়োগ করতে লাগলো এবং বিষয়টি মন্দিরের পুরোহিতদের এবং স্থানীয় উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। শুল্ক কর্মকর্তা শুল্ক প্রদানের জন্য নাঙ্গেলিকে (Nangeli) আরো বেশী চাপ প্রয়োগ করতে থাকে এবং তাকে অতিষ্ঠ করে তুলে। এদিকে দিনের পর দিন করের বোঝাও বাড়তে থাকে। অবশেষে একদিন নাঙ্গেলি (Nangeli) “স্তন কর” প্রদান করতে রাজি হয়। আনুমানিক ১৮০৩ সালের নির্দিষ্ট দিনে শুল্ক সংগ্রাহকেরা ৩৫ বছর বয়স্কা নাঙ্গেলীর বাড়িতে শুল্ক সংগ্রহ করতে এলে দরজার বাইরে তিনি তাদেরকে অপেক্ষা করতে বলেন। এরপর নাঙ্গেলি (Nangeli) ঘরের ভিতর প্রবেশ করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার স্তন দুটি কেটে ফেলেন। তারপর রক্তেমাখা কলাপাতায় স্তন দুটি কলাপাতায় মুড়িয়ে স্তন শুল্ক বা ব্রেষ্ট ট্যাক্স হিসেবে তার কর্তিত ও রক্তাত্ত স্তন শুল্ক কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেন। কথিত আছে এই সময় উনি বলেন “যে জিনিসের জন্য আমাকে কর দিতে বাধ্য করা হবে, সেই জিনিস আমি রাখবো না”। স্তন কর্তনের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তখনই মৃত্যু হয় নাঙ্গেলির (Nangeli)। নাঙ্গেলির (Nangeli) স্বামী চিরুকান্দান নাঙ্গেলির বিকৃত মৃতদেহ দেখে শোক সহ্য করতে পারলেন না। তিনি নাঙ্গেলির (Nangeli) শেষকৃত্যের সময় জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে আত্মহুতি দিলেন। ভারতে সেটাই ছিল সম্ভবত পুরুষের প্রথম সতীদাহ।

এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর থেকেই ‘মুলাক্করম’ বা ‘স্তনশুল্ক’ রোহিত হয়। তবে ‘মুলাক্করম’ বা ‘স্তনশুল্ক’ রোহিত হলেও দক্ষিণ ভারতে নারীদের স্তন আবৃত করার জন্য বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে। এমনকি এ নিয়ে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা পর্যন্ত হয়েছে। নিপীড়নমূলক এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তখন বেশ কয়েকটি বিদ্রোহও হয়েছিল। সিরিজ এই বিদ্রোহগুলোকে একত্রে বলা হয়, “চান্নার রিভোল্ট”। এসব বিদ্রোহে খ্রিস্টানদের গির্জা এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। নিম্নবর্ণের নারীরা প্রকাশ্যে ব্লাউজ পরতে শুরু করে। এ বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৯ সালে দক্ষিণ ভারতে দাঙ্গা পর্যন্ত হয়েছিল। এই দাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার আদায় করা। ভারতে এই দাঙ্গা ‘কাপড়ের দাঙ্গা’ হিসাবেও পরিচিত। শেষ পর্যন্ত মাদ্রাজের ব্রিটিশ গভর্নরকে হস্তক্ষেপ করতে হয় বিষয়টিতে। পরপর দুই দফা আদেশের মধ্য দিয়ে নারীদের দেহের ওপরের অংশ আবৃত করে রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।

নারীদের সম্মান রক্ষার উদ্দেশ্যে নাঙ্গেলির এই প্রতিবাদী চরিত্রকে সময়ের স্রোতে মানুষ প্রায় ভুলেই গেছিল। এই ইতিহাস সেরকম ভাবে বিশেষ কোনো জায়গায় লিপিবদ্ধ হয়নি। খুব কম কিছু লেখক তাদের বইতে এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি বই হল দীপ্তিপ্রিয়া মেহেরত্রা কর্তৃক লিখিত “Her Stories: Indian Women Down the Ages” নামক বইটি। এই বইটি থেকেই জানা যায় যে, এই ঘটনার বহু বছর পর নাঙ্গেলের এক প্রপৌত্রী লেনি তাদের এই পারিবারিক ইতিহাসকে সকলের সামনে পুনরায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। আবার BBC News ওয়েব পেজ থেকে জানা যায় যে, তার পারিবারিক এক ভ্রাতার প্রপৌত্র মানিআন ভেলুর মতে “Her act was selfless, a sacrifice to benefit all the women of Travancore, and ultimately forced the King to roll back the breast-tax,”। পারিবারিক এই উদ্যোগের ফলে আজকের প্রজন্ম জানতে পারে নারীদের সম্মান রক্ষার উদ্দেশ্যে নাঙ্গেলির আত্মত্যাগের এক বিদ্রোহী ও করুন কাহিনী। তারপরই সম্ভবত নাঙ্গেলি যে জায়গায় থাকতেন সেই জায়গাটি “মুলাচিপারাম্বু” (যার অর্থ স্তনযুক্ত মহিলার দেশ) নামে নামকরণ করা হয়। এই স্থানে কর্তিত স্তন যুক্ত এক নারীর মূর্তি ও স্থাপন করা হয় নাঙ্গেলির (Nangeli) স্মৃতির উদ্দেশ্যে।

নাঙ্গেলিকে নিজের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন ভারতের চিত্রশিল্পীটি মুরালি। অ্যাক্রেলিকে আঁকা সেই ছবি ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে ভারতীয় ব্রহ্মণ্যবাদীদের মধ্যে। সমালোচিতও হয়েছেন তিনি। তবে মুরালি বলেন, “চেরথালার সবাই নাঙ্গেলির (Nangeli) গল্প জানে। বছরের পর বছর ধরে লোকের মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে তার নির্ভীক আত্মদানের ইতিহাস “।

তথ্যসূত্র:

  • জনৈক ব্রিটিশ লেখক স্যামুয়ের ম্যাটিয়ারের লেখা বই “নেটিভ লাইফ ইন ট্রাভানকোর”
  • দীপ্তিপ্রিয়া মেহেরত্রার লেখা “Her Stories: Indian Women Down the Ages”
  • ভারতের চিত্রশিল্পী টি মুরালি কর্তৃক অঙ্কিত নাঙ্গেলি (Nangeli) সম্পর্কিত একটি ছবি
  • The Print ওয়েবপেজে ৮ই মার্চ,২০২২ তারিখে প্রকাশিত দীপ্তিপ্রিয়া মেহেরত্রা কর্তৃক লিখিত “Nangeli – The forgotten Dalit woman who stood up against Travancore’s ‘breast tax’” শীর্ষক প্রতিবেদন। BBC News ওয়েবপেজে ২৮শে জুলাই, ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত “The woman who cut off her breasts to protest a tax” শীর্ষক প্রতিবেদন
  • মুক্তচিন্তার আসর ওয়েবপেজে ফেব্রুয়ারী ১৪, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত “স্তন কর কি এবং কেন?” শীর্ষক প্রতিবেদন
  • Onushilon.org ওয়েবপেজে নাঙ্গেলির জীবনী মূলক একটি প্রতিবেদন
  • Gonews.com ওয়েবপেজের আন্তর্জাতিক ডেস্কে জুন ১৮, ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত “যে রাজ্যে মেয়েদের বুক ঢাকলে দিতে হতো ‘স্তনকর’” শীর্ষক প্রতিবেদন
  • wikibn.icu ওয়েবপেজ – ট্রাভানকোর রাজপরিবার
  • Womeneye24.com ওয়েবপেজে ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত “নারী আন্দোলন : এক ও অনন্য নাঙ্গেলি” শীর্ষক প্রতিবেদন
  • Quora.com ওয়েবপেজ
  • ইতিহাস অনুসন্ধানী প্রাক্তন শিক্ষিকা শ্রীমতি সুলগ্না চক্রবর্তী মহাশয়ার সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাবলী

অনির্বাণ সাহা | Anirban Saha

মন্টুর মা | গল্পগুচ্ছ ২০২৩ | Bengali Story 2023

প্রবীর রঞ্জন মণ্ডল | কবিতাগুচ্ছ ২০২৩ | Bengali Poetry 2023

সুশান্ত সেন | কবিতাগুচ্ছ ২০২৩ | Bengali Poetry 2023

তিন্নির ফড়িং আর মানুর কারসাজি | গল্পগুচ্ছ ২০২৩ | Bengali Story 2023

নাঙ্গেলি – উইকিপিডিয়া | নাঙ্গেলির প্রতিবাদ | স্তনকর ও একটি নির্মম প্রতিবাদ | ব্রেস্ট নিয়ে খেলা করা | কিশোরীর বুক | ব্রেস্ট টিউমারের লক্ষণ | ব্রেস্ট ক্যান্সারের ধাপ | স্তন শুল্ক | বাংলা প্রবন্ধ | বাংলার লেখক | প্রবন্ধ ও প্রাবন্ধিক | সেরা প্রবন্ধ ২০২২ | শব্দদ্বীপ | শব্দদ্বীপের লেখক | বাংলা ম্যাগাজিন | ম্যাগাজিন পত্রিকা | শব্দদ্বীপ ম্যাগাজিন

Nangeli by Hasan Hamid | Nangeli | The Story Of Nangeli | breast tax was imposed by | breast tax india | breast tax travancore | breast tax myth | when breast tax started | breast tax in kerala | breast tax propaganda | history of breast tax in india | writing competition | writing competition malaysia | writing competition london | writing competition hong kong | writing competition game | writing competition essay | writing competition australia | writing competition prizes | writing competition for students | writing competition 2022 | writing competitions nz | writing competitions ireland | writing competitions in africa 2022 | writing competitions for high school students | writing competitions for teens | writing competitions australia 2022 | writing competitions 2022 | writing competitions uk | bengali article writing | bangla news article | bangla article rewriter | article writing | article writing ai | article writing app | article writing book | article writing bot | article writing description | article writing example | article writing examples for students | article writing for class 8 | article writing for class 9 | article writing format | article writing gcse | article writing generator | article writing global warming | article writing igcse | article writing in english | article writing jobs | article writing jobs for students | article writing jobs work from home | article writing lesson plan | article writing on child labour | article writing on global warming | article writing pdf | article writing practice | article writing topics | trending topics for article writing 2022 | what is article writing | content writing trends 2022 | content writing topics 2022 | Bangla Prabandha | Probondho | Definite Article | Article Writer | Short Article | Long Article | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Writer | Shabdodweep Founder

1 thought on “Bengali Article 2023 | “স্তন কর” বিরোধী নারী আন্দোলন ও নাঙ্গেলির (Nangeli) আত্মত্যাগ”

Leave a Comment