অভিজিৎ পাল – সূচিপত্র [Bengali Article]
জগন্নাথ ও ‘পতিতপাবন’ শ্রীবিগ্রহের আবির্ভাব — অভিজিৎ পাল [Appearance of Jagannath and Patitapawan]
জগন্নাথ কৃপাকল্পতরু। যে ভক্ত জীবনে তাঁকে একবারের জন্যও ভালোবেসেছেন তিনি তাঁর সেই ভক্তের কাছে বদ্ধ হয়ে গেছেন চিরকালের জন্য। জগন্নাথ অশেষ করুণার অবতার। বিশাল বিশাল দুই চোখ দিয়ে ভক্তের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গুণকেও জগন্নাথ বড় করে দেখেন। ভক্তকে দেখতে দেখতে তাঁর দুই চোখের কোণে লালবর্ণ ধরে। তাঁর হাসি আকর্ণ প্রসারিত হয়। ভক্ত তাঁকে যত ভালোবাসেন, তিনি তার চেয়েও অনেক বেশি ভক্তকে ভালোবাসেন। ভক্তকে দিব্যভাবে আলিঙ্গন করতেই তাঁর দুই বাহু সামনের দিকে এগিয়ে থাকে। যে ভক্ত জাগতিক কাজে তাঁকে ভুলে বসে আছে তিনি তাকেও দেখা দিতে আসেন রথে চড়ে। তাঁকে দেখে ভক্তের যত আনন্দ, ভক্তকে দেখে তাঁর আরও বেশি আনন্দ। করুণায় ভরা আনন্দময় চিন্ময় তিনি। সময়ের বিপাকে যিনি সমাজবিধির বাঁধনে জগন্নাথের থেকে দূরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন অথচ জগন্নাথকে একনিষ্ঠ ভালোবেসে চলেছেন তাঁর জন্যও জগন্নাথ এগিয়ে এসে ধরা দিয়েছেন। ভক্তের সামাজিক অবস্থান নয়, তিনি দেখেন ভক্তের মন। গোটা বিশ্বই তাঁর ভূমি। তাঁর সৃষ্টির একই বাতাস সকলের গায়ে লাগে, একই বিপুল জলরাশি ঘাটে ঘাটে সকলকে সিক্ত করে, একই সূর্যাগ্নি সকলকে তপ্ত করে, একই মহাপ্রসাদে পূরিত হয় সকলের উদর। তিনি বিশ্ববিধাতা। তিনি সকলের আরাধ্য। পৃথিবীতে এমন কেউই নেই যে তাঁর সন্তান নয়। কৃপাময় জগন্নাথের এক অহৈতুকী কৃপার নিদর্শন পুরীর শ্রীমন্দিরের সিংহদ্বারে অবস্থিত জগন্নাথের পতিতপাবন বিগ্রহ। ভক্তের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে, ভক্তের ভক্তির মান রাখতে জগন্নাথের এই নবতম প্রকাশ ঘটেছিল। জগন্নাথের ভক্তবিলাসী রূপের আকর শ্রীমন্দিরের পতিতপাবন বিগ্রহ।
ওড়িশায় গজপতি মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেবের শাসনকালের পরবর্তী সময়ে ওড়িশার শাসন ব্যবস্থা ধীরে ধীরে পুরোপুরি মুঘল রাজাদের অধীনে চলে এসেছিল। এই সময় বঙ্গ ও ওড়িশা মূলত মুঘল নিয়ন্ত্রিত সুবেদারদের পরিচালনায় শাসিত হচ্ছিল। অখণ্ড ভারতের প্রদেশে প্রদেশে প্রাদেশিক রাজা থাকলেও সুবেদাররাই ছিল বকলমে মুঘলদের শাসক প্রতিনিধি। সুবেদাররা হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষে বিশেষ সুবিধের লোক কখনও ছিল না। মুঘল রাজাদের সহযোগিতায় ও আগ্রাসী উগ্ৰ ইসলামী ধর্মশক্তির সাহায্যে সুবেদাররা প্রাদেশিক রাজাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে মানসিক, শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় নির্যাতন করত। এই সংবাদ মুঘল রাজাদের অজানা ছিল না। সুবেদাররা যেভাবে এই অত্যাচার চালিয়েছিল তাতেই বোঝা যায় মুঘল শাসকের গোপন সমর্থন এতে বেশ অনেকখানিই ছিল। ধর্ম বিষয়ে উগ্র মনোভাবে তারা উভয়েই বিশ্বাস করত যা ইসলামে নেই তা সবকিছুই দোষের। শাসকের নিশ্চুপ ও কপট সহযোগিতায় প্রাদেশিক রাজাদের ধর্মান্তরিত করতে, নারীদের সম্মানহানি করে ও হিন্দুদের প্রাচীন দেবস্থান লুঠ করে মুঘলদের সম্পদ বৃদ্ধিতে তারা সাহায্য করত। এই প্রথা বাবর থেকে ঔরঙ্গজেব প্রত্যেক মুঘল রাজাদের সময়েই কমবেশি ছিল। বিশেষ করে প্রাচীন মন্দিরের ওপর হামলা করে হিন্দুদের মনোবল ভেঙে দিয়ে, ধর্মবোধকে ভ্রান্ত করে দেওয়ার অপচেষ্টা চলত। হিন্দুদের ওপর বিরাট তীর্থকর চাপিয়ে হিন্দুদের স্বধর্ম পালনের পথে সমস্যাও তৈরি করা হয়েছিল। ভারতের ইতিহাসে তুর্কি থেকে মুঘল শাসনের সময়ে একাধিক পৌরাণিক দেবস্থান নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। পুরীর শ্রীমন্দির ও শ্রীবিগ্ৰহের ওপরেও আঘাত কম আসেনি। কিন্তু এই মন্দির বহুবার আক্রান্ত হওয়ার পরেও প্রয়োজনে ওড়িশার জগন্নাথপ্রেমী বহু মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বধর্ম রক্ষা করেছে। জগন্নাথের প্রতি ভালোবাসায় বর্ম হয়ে হিন্দুসমাজ কালে কালে শ্রীমন্দিরকে রক্ষা করেছে, কাপুরুষ কপট হিতৈষী মুঘল রাজশক্তির কাছে নত হয়ে প্রাণভয়ে সরে যায়নি। ওড়িশার রাজা রামচন্দ্রদেবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমনই এক বীভৎস সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইতিহাস। যখন স্বয়ং রাজা এমন নিগ্ৰহের শিকার হয়েছিলেন তখন সাধারণ মানুষের অবস্থা ঠিক কেমন ছিল তা সহজেই অনুমেয়।
প্রাচীন ওড়িশার রাজা রামচন্দ্রদেব ছিলেন সুশাসক। তিনি ছিলেন সুদক্ষ ও প্রজানুরঞ্জক রাজা। পুরীর খুব কাছেই খুদা নামের একটি নগরে তিনি একটি প্রাসাদে সপরিবারে বসবাস করতেন। মুঘলদের সুবেদার টাকি খান এই সময় ওড়িশার গজপতিদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পেয়েছিল। এই টাকি খান ছিল কট্টরপন্থী, উগ্র ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, পরধর্মবিদ্বেষী মানুষ। তার অধীনস্থ এলাকায় সাধারণ হিন্দু জনতা থেকে রাজা প্রত্যেককেই তার অত্যাচারের শিকার হতো। অজস্র হিন্দু মন্দিরকে আক্রান্ত হয়েছিল টাকি খানের নেতৃত্বে। টাকি খান হিন্দু সম্প্রদায়কে ঘৃণার চোখে দেখত। মুঘল দরবারে এই সংবাদ গিয়ে পৌঁছালেও টাকি খানের বিরুদ্ধে কোনোরকম পদক্ষেপ নিয়ে তারা ওড়িশায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি। বরং দিনের পর দিন ধরে মৌনতা অবলম্বন করে পরোক্ষে টাকি খানের কদর্য কর্মকাণ্ডে ভীষণভাবে সমর্থন জানিয়েছিল। টাকি খানের ইচ্ছা ছিল পুরীর শ্রীমন্দিরকে আক্রান্ত করার। মন্দিরের সম্পদ চুরি বা ডাকাতি করার। এই আশঙ্কার কথা তার অধীনস্থ রাজা রামচন্দ্রদেব বুঝতে পারছিলেন। রামচন্দ্রদেব ছিলেন মহাপ্রভু জগন্নাথের একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় এই কূটনৈতিক পরিকল্পনা বুঝতে পারলেও অপেক্ষাকৃত বড় মুঘল রাজশক্তির কাছে তাৎক্ষণিকভাবে নিরুপায় ছিলেন। কিন্তু তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন পুরীর শ্রীমন্দির যেন বিধর্মী দের হাত থেকে রক্ষা পায়। অগত্যা একসময় উপায়ন্তর না দেখে রাজা রামচন্দ্রদেব সুবেদার টাকি খানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরিমিত ক্ষমতা ও লোকবলে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত মুঘল সেনার সাহায্য নিয়ে লড়া টাকি খানের কাছে রাজা রামচন্দ্রদেব পরাজিত হন। টাকি খান রাজার এই অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে নিজের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কুমতলব প্রতিষ্ঠা করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। পরাজিত রামচন্দ্রদেবকে টাকি খান এই সুযোগে বন্দি করে কারাগারে আটকে রেখে নিজের কুমতলবকে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিল। কারাগারে বন্দি অবস্থায় রামচন্দ্রদেব বুঝতে পারছিলেন তাঁর শাসনের অবর্তমানে পুরীর মন্দিরের উপর টাকি খানের যে লোভ, তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। কিন্তু বন্দী অবস্থায় রামচন্দ্রদেব কিছুই করতে পারছিলেন না। তিনি মনে মনে জগন্নাথকে স্মরণ করছিলেন এবং প্রার্থনা করছিলেন যেন শ্রীমন্দির যে কোনো অবস্থাতেই রক্ষা পায়। এই সময় হিন্দু রাজাকে আয়ত্তে এনে টাকি খানের হিন্দু বিদ্বেষ আরও অনেকটাই প্রসারিত হয়েছিল। পুরী তীর্থে আগত জগন্নাথের ভক্তদের ওপর অপরিমিত তীর্থ কর আদায় করতে শুরু করেছিল টাকি খান। রামচন্দ্রদেবকে নিজের আয়ত্তের মধ্যে পেয়ে টাকি খানের নতুন নতুন দুরভিসন্ধি আবার প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। টাকি খান তার বোন রিজিয়ার সঙ্গে রাজা রামচন্দ্রদেবের বিবাহ দিয়ে রামচন্দ্রদেবকে হাতের মধ্যে রাখতে চেয়েছিল। টাকি খান চেয়েছিল রাজাকে ধর্মভ্রষ্ট করে হিন্দু সমাজকে দুর্বল করে দিতে। টাকি খান রিজিয়ার (বোনের) বিয়ের প্রস্তাব রামচন্দ্রদেবের কাছে রাখতেই রাজা ভীষণ আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু টাকি খান এই আপত্তিতে রামচন্দ্রদেবের ওপর আরো অত্যাচার শুরু করেছিল। দাদার এই অসভ্য আচরণের কথা জানতে পেরে রিজিয়া গোপনে রামচন্দ্রদেবের সঙ্গে দেখা করতে কারাগারে এসে রামচন্দ্রদেবকে এই বিবাহের রাজি হওয়ার অনুরোধ করে। রিজিয়ার মা প্রথমে হিন্দু ঘরের মেয়ে ছিলেন। কিন্তু মুসলমান শাসকদের নিগ্রহের শিকার হয়ে বাধ্য হয়ে মুসলমানকে বিয়ে করেছিলেন। ফলে মায়ের সূত্রে জগন্নাথের প্রতি ও হিন্দুদের প্রতি রিজিয়ার মনে একটি কোমল ভাব ছিল। রিজিয়া বুঝতে পেরেছিল টাকি খানের এই বৈবাহিক শর্তে রাজি না হলে রাজা রামচন্দ্রদেবের সঙ্গে সঙ্গে ওড়িশার জনতা ও জগন্নাথ মন্দিরের বড় ক্ষতি হতে পারে। এই সমস্যার প্রাথমিক সমাধান হতে পারে রামচন্দ্রদেব ও রাজিয়ার বিবাহ। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি সমস্যা ছিল। হিন্দু রাজাকে বিবাহ করলেও রিজিয়া নিজের ধর্মত্যাগের সুযোগ পেত না। উল্টে রাজা রামচন্দ্রদেবকেই নিজের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামকে গ্রহণ করতে হতো। ইসলামীদের সংখ্যা বৃদ্ধির এটি ছিল একটি পরিকল্পিত প্রয়াস। রামচন্দ্রদেব বুঝতে পারছিলেন তাঁর স্বধর্ম ত্যাগ বৃহত্তর জনতার মঙ্গল ডেকে আনবে। হয়তো বৃহত্তর স্বার্থে নিজের ধর্ম পরিচয় তাঁকে ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু রামচন্দ্রদেব দুঃখিত হচ্ছিলেন। তিনি জানতেন একবার ধর্ম ত্যাগ করলে আর জগন্নাথদর্শন তাঁর ভাগ্যে জুটবে না। অথচ রাজা হিসেবে জগন্নাথের মন্দির রক্ষা করাও তাঁর কর্তব্য। রাজা রামচন্দ্রদেব অন্তর্দ্বন্দ্বে ব্যথিত হয়ে উঠলেন কিন্তু কোনো সঠিক পথ তিনি দেখতে পেলেন না। অবশেষে রাজকুমারী রিজিয়া তাঁকে পরামর্শ দিলেন বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হলেও তারা কখনো স্বামী-স্ত্রীর মতো জীবন যাপন করবেন না। কিন্তু জগন্নাথের মন্দির রক্ষার এই সুযোগ যদি নষ্ট হয় তাহলে বড় ক্ষতি হতে পারে। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে বৃহত্তর জগন্নাথ সভ্যতা রক্ষা করা এখন ধর্ম। জগন্নাথ ভক্তের মন বোঝেন। ভক্ত তাঁকে ত্যাগ করলেও তিনি ভক্তকে ত্যাগ করেন না। যে জগন্নাথ মন্দিরে রয়েছেন সেই জগন্নাথ বিশ্বচরাচরে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। সর্বভূতে জগন্নাথকে দর্শনই হয়ে উঠবে রামচন্দ্রদেবের জীবনের উপাসনা। তাই এখন রিজিয়ার সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে সুবেদার টাকি খানের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করলেই জগতের কল্যাণ।
অনেক চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত রামচন্দ্রদেব সিদ্ধান্ত নেন রিজিয়াকে বিবাহ করবেন তিনি। রিজিয়াকে বিবাহ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করতে হয়েছিল। ইসলাম গ্রহণ করার পর রাজা রামচন্দ্রদেব হাবিজ কাদের খান নামে পরিচিত হন। রাজার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের খবর ধীরে ধীরে গোটা ওড়িশায় আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। ওড়িশার ধর্মপ্রাণ ভক্তরা মর্মাহত হয়েছিলেন এই সংবাদ শুনে। শ্রীমন্দিরের কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য কর্মী রাজার এইভাবে ধর্মপরিবর্তনে দুঃখিত হয়েছিলেন। রাজা ইসলাম গ্রহণ করে রিজিয়াকে বিবাহ করলেও রিজিয়ার সঙ্গে দাম্পত্যজীবন কাটাতে চাননি। তিনি রিজিয়াকে কটক শহরে রেখেই তাঁর নিজভূমি খুদাতে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু ফিরে এসেই আত্মীয়-স্বজন, গৃহজন প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁর এক প্রকার বিচ্ছেদ ঘটেছিল। এমনকি তাঁর অন্য রানীরা ধর্মত্যাগী স্বামীর সঙ্গে থাকতে রাজি হননি। সমস্ত রানী সন্তানদের নিয়ে রাজাকে একা করে অন্যত্র গমন করেছিলেন। শ্রীমন্দিরের সকলে রাজার শ্রীমন্দিরে প্রবেশের অধিকার বন্ধ করে দিয়েছিল। জগন্নাথের পূজা ও রথযাত্রাকে ঘিরে রাজার যেসব রীতিনীতি রয়েছে তাতেও রামচন্দ্রদেবের অধিকার নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। রামচন্দ্রদেব আগে থেকেই জানতেন ধর্মীয় পবিত্রতা রক্ষা করা শ্রীমন্দিরের অধিকার। ধর্মান্তরিত হলেও তিনি শ্রীমন্দিরের পবিত্রতা রক্ষা করতে বাধ্য। জগন্নাথের ভক্ত তিনি। তিনি জানেন জগন্নাথ ভাবগ্ৰাহী জনার্দন। ইসলাম গ্রহণ করেও তিনি যদি শ্রীমন্দিরে বলপূর্বক প্রবেশ করেন তবে তাঁর দেখাদেখি অজস্র ইসলামপন্থী শ্রীমন্দিরে প্রবেশ করে বিগ্রহ ও মন্দিরের ক্ষতিসাধন করতে পারে। এভাবে শ্রীমন্দিরের নিরাপত্তা নষ্ট হতে পারে। অতএব এখন তাঁর এক্ষেত্রে সংযম ছাড়া আর কিছুই করার নেই। বাস্তবিকই রিজিয়ার সঙ্গে রাজার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পর টাকি খান রাজার পরামর্শে আর শ্রীমন্দিরের প্রতি কুনজর রাখেনি। রাজার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এক বৃহত্তর ভালো সাধিত হয়েছিল।
ধর্মান্তরিত হলেও রাজা রামচন্দ্রদেবের জগন্নাথের প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তি ম্লান হয়নি। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করছিলেন আর কেউ সত্য না জানুক জগন্নাথ জানেন ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তিনি ধর্ম ত্যাগ করেননি। বরং বৃহত্তর স্বার্থে নিজেকে টাকি খানের কুটিল অভিসন্ধির শিকার হতে দিয়েছেন। জগন্নাথ সত্যদ্রষ্টা। তাঁর কাছে গোপন কিছুই নেই। মন্দিরের প্রবেশ অধিকার হারিয়ে তাঁরও বড় অভিমান হয়েছিল। তিনি ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে প্রতিদিন শ্রীমন্দিরে গিয়ে জগন্নাথ দর্শন করতেন। এখন কালের বিপর্যয় ঘটেছে। সেই অধিকার তাঁর নেই, কিন্তু তাই বলে জগন্নাথ তাঁকে বঞ্চিত করবেন নিজের দর্শন থেকে? জগন্নাথ যদি সত্য হবেন তবে তিনি ঠিক ভক্তের ডাকে সাড়া দেবেন। তিনি যে চিন্ময় তনু। তাঁর তো অজ্ঞাত কিচ্ছু নেই। এ শুধু ভক্তের পরীক্ষা নয়, ভগবানের পরীক্ষা। তাঁর মন্দিরে প্রবেশের অধিকার বন্ধ হয়ে গেলে, এবার জগন্নাথকেই বাইরে আসতে হবে তাঁকে দেখা দিতে। যিনি পরম দয়ালু, তাঁকে দয়া করতেই হবে। নইলে যে তাঁর নামের কলঙ্ক বাড়বে।
ধর্ম ত্যাগের পর রাজা রামচন্দ্রদেবের পরিজনেরা তাঁকে ত্যাগ করলে তাঁর একমাত্র মনের আশ্রয় হয়ে ওঠেন জগন্নাথ। ধর্ম সময়ে বিপাকের সঙ্গে বাধ্য হয়ে পরিবর্তন করতে হলেও জগন্নাথের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কখনো পরিবর্তিত হয়নি। কিন্তু সেই কথা তিনি কাকে বোঝাবেন। গোটা রাজমহলে কে আর আছে যে তাঁর মনের এই কথা বুঝবে। দীর্ঘদিন ধরে জগন্নাথের অদর্শনে রামচন্দ্রদেবের মানসিক স্থিরতা নষ্ট হতে শুরু করেছিল। গভীর রাতে তিনি সবার অগোচরে একদিন রাজমহল থেকে বেরিয়ে হাজির হলেন শ্রীমন্দিরের মূল দরজার কাছে। তখন মন্দির বন্ধ। ছদ্মবেশে থাকায় রাজাকে কেউ চিনতে পারলেন না। সিংহদ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে ঘোড়া বেঁধে রেখে তিনি জগন্নাথের দিকে মুখ করে মনে মনে প্রার্থনা করলেন। তিনি মনে মনে প্রভুকে বললেন, জগতের আর কেউ না জানুক, জগন্নাথ তো জানেন ধর্ম পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে তাঁর নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা ছিল না। প্রজার কল্যাণ ও মন্দিরের রক্ষার জন্য তাঁকে এই পথে আসতে হয়েছে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে এই কঠিন পথ বেছে নিতে হয়েছে। আজ ধর্ম ত্যাগ করার অপরাধে তাঁর শ্রীমন্দিরে প্রবেশের অধিকার নেই। কিন্তু তিনি তো একদিনের জন্যও জগন্নাথকে ছেড়ে থাকেননি। নিত্য স্মরণ করেছেন জগন্নাথকে। তারপরেও জগন্নাথ এরকম নিষ্ঠুর হবেন? অচলা হয়ে মন্দিরে আবদ্ধ থাকবেন? তিনি কি আর ভক্তকে দর্শন দেবেন না? এই চিন্তা করতে করতেই রাজা রামচন্দ্রদেব অশ্রুসিক্ত নয়নে হাঁটু গেড়ে বসলেন সিংহদ্বারের কাছে। রত্নসিংহাসনে বিরাজমান জগন্নাথের মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু তিনি তখনও ভক্তকে পরীক্ষা করে চলেছেন। ভোর হয়ে আসছে দেখে রাজা রামচন্দ্রদেব ফিরে গেলেন নিজের ভবনে। আবার রাত হতেই তিনি ছদ্মবেশে হাজির হলেন শ্রীমন্দিরের সামনে। আবার সেই একই প্রার্থনা। আবার সেই ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যাওয়া। এভাবে চলতে থাকল কয়েকদিন। যত রাত যায় তত ব্যাকুলতা বাড়ে রাজার। এবার জগন্নাথের আসন টলে উঠল। তিনি ভক্তের জন্য ছুটে ছুটে এলেন সিংহদ্বারে। ভক্তের সামনে দাঁড়িয়ে জগন্নাথ ভক্তকে সন্তুষ্ট করলেন দর্শন দিয়ে। রাজা রামচন্দ্রদেব ধন্য হলেন। ভক্তের ভগবান ভক্তের ডাকে এসেছেন। সমাজের প্রতিবন্ধকতা ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে কোনো ব্যবধান তৈরি করতে পারে না। জগন্নাথ আজ এসেছেন ভক্তের কাছে। রাজা রামচন্দ্রদেব আনন্দে অধীর হয়ে গেলেন। আনন্দে তিনি ফিরে চললেন নিজের প্রাসাদে। জগন্নাথ তাঁকে ছেড়ে যাননি এই ভেবেই তিনি সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবেন। এই চিন্তা করে নিজেকে ধন্য মনে করলেন। পরের দিন সকাল হতেই দেখা গেল রত্নসিংহাসন থেকে শুরু করে সিংহদ্বার পর্যন্ত সারা মন্দিরময় অজস্র ফুল ছড়িয়ে আছে। কুমকুম, হলুদ, চন্দনের গন্ধে মন্দিরের বাতাস ভরে আছে। জগন্নাথের পোশাক আলুথালু। গহনা অবিন্যস্ত হয়ে গেছে। তিনি যেন দীর্ঘ পথ হেঁটে চলে বেরিয়ে ক্লান্ত হয়েছেন। সেদিনের এই ঘটনায় অনেকেই আশ্চর্য হলেন। আবার রাত হল। আবার রামচন্দ্রদেব এলেন দীন ভক্তের মতো জগন্নাথের দ্বারে। আবার শুরু হল সেই একই প্রার্থনা। জগন্নাথ আবার এসে ধরা দিলেন। রাতে শেষদিকে রাজা ফিরে চললেন প্রাসাদে আর জগন্নাথ গিয়ে বসলেন রত্নসিংহাসনে। পরের দিন সকাল হতেই আবার দেখা গেলো একই দৃশ্য। সারা মন্দিরে ফুল আর ফুল। জগন্নাথের বস্ত্র এলোমেলো। কয়েকদিন ধরে এমনই চলছে দেখে পূজারীদের ভয় হলো। তারা ভাবলেন বোধহয় জগন্নাথের পূজা ইত্যাদিতে কোথাও ত্রুটি হয়েছে বলে এই রকম পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছে। প্রধান পূজারী জগন্নাথকে স্মরণ করে এই পরিস্থিতির সঠিক কারণ জানতে চাইলেন। অনেক সাধ্য সাধনার পর জগন্নাথ সত্য উদঘাটিত করলেন। তিনি বললেন তাঁর ভক্ত ধর্ম ত্যাগ করে আপাতভাবে পতিত হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর ভক্তকে ত্যাগ করতে পারছেন না। তাঁর এই ভক্ত মন্দিরে প্রবেশের অধিকার পাচ্ছে না বলে তাঁকেই মন্দিরের দুয়ারে গিয়ে ভক্তকে দেখা দিতে হচ্ছে। তিনি যে পতিতপাবন হরি নারায়ণ। ভক্তকে রক্ষা করতে তিনি এভাবেই প্রতিরাতে সিংহদ্বারের কাছে যান। আর এই যাত্রাপথময় ফুল ভরে ওঠে। তাঁর এই ভক্ত আর কেউ নয় ধর্মত্যাগী রাজা রামচন্দ্রদেব। অধুনা যিনি ধর্মপরিচয়ের জন্য শ্রীমন্দিরে প্রবেশ-অধিকার হারিয়েছে। তাঁর আরও যে সমস্ত ভক্ত এভাবে পতিত হয়েছে তাঁদের সকলের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সিংহদ্বারের কাছে এক নতুন বিগ্রহ স্থাপনের আদেশ করেছিলেন জগন্নাথ। যাদের শ্রীমন্দিরে প্রবেশের অধিকার নেই তারা বাইরে থেকে এভাবেই প্রভুর দর্শন পাবে। পতিতপাবন বিগ্রহ স্থাপনের পর রাজা রামচন্দ্রদেব এভাবেই নিয়মিত জগন্নাথের দর্শন করতেন। সেই থেকে এই জগন্নাথ বিগ্রহ পতিতপাবন নামে পরিচিত হয়েছেন। পতিতপাবন বিগ্রহ দর্শন করে অহিন্দু সমস্ত সম্প্রদায় আজও ধন্য হন। পতিতপাবনের মঙ্গল আরতি, পূজা ও শৃঙ্গার আজও শ্রীমন্দিরের একটি বিখ্যাত রীতি। শুচি-অশুচি সমস্ত অবস্থায় পতিতপাবনকে দর্শন করা যায়। পতিতপাবন বিগ্রহ দর্শন করলেই মুক্তির দরজা উন্মোচিত হয়। এমনই তাঁর মহিমা।
অভিজিৎ পাল | Avijit Pal
Bengali Story 2023 | কর্ণফূলী | গল্পগুচ্ছ ২০২৩
Top Best Bengali Poetry 2023 | কবিতাগুচ্ছ | গোবিন্দ মোদক
History of Bengali Poetry | কবিতা কি ও কেন এবং তার ইতিহাস
Tebhaga Movement | বাংলায় “তেভাগা আন্দোলন” এবং সলিল চৌধুরীর গণসঙ্গী
Appearance of Jagannath and Patitapawan 2023 | new article – Appearance of Jagannath and Patitapawan | trend topic – Appearance of Jagannath and Patitapawan | pdf article – Appearance of Jagannath and Patitapawan | full article – Appearance of Jagannath and Patitapawan | article download – Appearance of Jagannath and Patitapawan | video – Appearance of Jagannath and Patitapawan | video 2023 – Appearance of Jagannath and Patitapawan | full video – Appearance of Jagannath and Patitapawan | pdf history – Appearance of Jagannath and Patitapawan | history – Appearance of Jagannath and Patitapawan | history review – Appearance of Jagannath and Patitapawan | review 2023 – Appearance of Jagannath and Patitapawan | review pdf – Appearance of Jagannath and Patitapawan | review – Appearance of Jagannath and Patitapawan | new journal – Appearance of Jagannath and Patitapawan | journal 2023 – Appearance of Jagannath and Patitapawan | full journal – Appearance of Jagannath and Patitapawan | pdf journal – Appearance of Jagannath and Patitapawan | best article – Appearance of Jagannath and Patitapawan | content – Appearance of Jagannath and Patitapawan | trend video – Appearance of Jagannath and Patitapawan | trend review – Appearance of Jagannath and Patitapawan | article caption – Appearance of Jagannath and Patitapawan | article title – Appearance of Jagannath and Patitapawan | bengali article – Appearance of Jagannath and Patitapawan | Shabdoweep Founder | Shabdodweep | Shabdodweep Web Magazine | Shabdodweep Writer | Bhimrao Ramji Ambedkar | Bharat Ratna Dr. Bhim Rao Ambedkar | Dr. Babasaheb Ambedkar | Why is Ambedkar so famous? | How many degrees did Dr BR Ambedkar have? | Is Ambedkar a freedom fighter? | How many hours did Ambedkar study in a day? | Who is the first doctor of science in India? | Who is the real father of Indian? | Who is known as father of India? | Which person has most statue in India? | writing competition | writing competition malaysia | writing competition london | writing competition hong kong | writing competition game | writing competition essay | writing competition australia | writing competition prizes | writing competition for students | writing competition 2022 | writing competitions nz | writing competitions ireland | writing competitions in africa 2022 | writing competitions for high school students | writing competitions for teens | writing competitions australia 2022 | writing competitions 2022 | writing competitions uk | bengali article writing | bangla news article | bangla article rewriter | bengali article writing format | bengali article writing ai | bengali article writing app | article writing book | bengali article writing bot | bengali article writing description | article writing example | bengali article writing examples for students | article writing for class 8 | article writing for class 9 | bengali article writing format | article writing gcse | bengali article writing generator | article writing global warming | article writing igcse | article writing in english | bengali article writing jobs | article writing jobs for students | article writing jobs work from home | article writing lesson plan | article writing on child labour | article writing on global warming | bengali article writing pdf | bengali article writing practice | Bengali article writing topics | trending topics for article writing 2022 | what is article writing | content writing trends 2022 | content writing topics 2022 | Bangla Prabandha | Probondho | Definite Article | Bengali Article Writer | Short Bengali Article | Long Bengali Article | Bangla kobita | Kabitaguccha 2022 | Galpoguccha | Galpo | Bangla Galpo | Bengali Story | Bengali Article