Adonis | অ্যাডোনিসঃ আধুনিক আরবি কবিতার রূপকার | 2023 Article

Sharing Is Caring:

অ্যাডোনিসঃ আধুনিক আরবি কবিতার রূপকার – সৌম্য ঘোষ [Adonis]

আধুনিক আরবি সাহিত্যের দুই কিংবদন্তীর নাম আমাদের জানা: মাহমুদ দারবিশ এবং অ্যাডোনিস

দারবিশ ইহকালের মায়া ত্যাগ করেছেন। আর ইতিহাস, বিদ্রোহ, প্রত্যাখ্যান ও আধুনিকতার প্রতীক অ্যাডোনিস (Adonis) এখনো আছেন জীবিত কিংবদন্তী হয়ে। আধুনিক আরবি সাহিত্যের সর্বাধিক প্রভাবশালী এই সিরিয়ান কবি, প্রাবন্ধিক ও সমালোচকের পিতৃপ্রদত্ত নাম আলী আহমেদ সাঈদ। জন্ম সিরিয়ার লাধকিয়া অঞ্চলের কাসাবিন নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামে ১৯৩০ সালে। কবি স্বীকৃতি লাভের আশায় কৈশোরেই তিনি গ্রহণ করেছিলেন গ্রীক পুনর্জন্মের দেবতা ‘অ্যাডোনিস’-এর নাম। সফলও হয়েছিলেন তিনি; দেবতা অ্যাডোনিসের (Adonis) মত কাব্যভুবনে পুনর্জন্ম ঘটেছিল তাঁর। সিরিয়ার যেসব সংবাদপত্র ও সাহিত্য সাময়িকীগুলো এতদিন তাঁর কবিতা ছাপেনি, ‘অ্যাডোনিস’ (Adonis) নাম গ্রহণ করার পর সেই পত্রিকাগুলোতেই একের পর এক ছাপা হতে শুরু করে তাঁর অসাধারণ কবিতাগুলো। এই ঘটনায় তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, ঐ পত্রিকাগুলোর অবস্থা হয়েছিল দেবতা অ্যাডোনিসের (Adonis) হত্যাকারী বন্য শুকরটির মত। কারণ ঐ দাঁতাল শুকরের আঘাতে দেবতা অ্যাডোনিসের (Adonis) মৃত্যু হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তিনি অর্জন করেছিলেন পুনর্জন্মের ক্ষমতা ও প্রতি বসন্তে পৃথিবীতে ফিরে আসার অধিকার। অথচ তার হত্যাকারীকে ঘৃণ্য শুকর হয়েই হারিয়ে যেতে হয়েছিল কালের অতল গহ্বরে।

কবি অ্যাডোনিসের (Adonis) শৈশব ও কৈশোরে অন্য দশ জনের মত স্বাভাবিকত্ব ছিল না। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অন্ধকার, ছন্দপতন আর ক্লান্তিই ছিল তাঁর নিত্যদিনের ভাবসঙ্গী। লেবাননের সীমান্ত ঘেঁসে সিরিয়ার পশ্চিামাঞ্চলের যে গ্রামটিতে তাঁর জন্ম ও বেড়ে উঠা সেই কাসাবিনকে শাসন করেছে কখনো অনলবর্ষী সূর্য, কখনো ক্ষুধা আর কখনো কুসংস্কার। দারিদ্র্যক্লিষ্ট সংসারে বাবার সাথে তিনিও ছিলেন সংসারের এক ভারবাহী সত্তা। আর এই ভার বহন করতে গিয়েই কৈশোরেই তিনি হারিয়েছেন তাঁর কৈশোরকাল। এজন্যই হয়ত তিনি বলেছেন, আমার কোন শৈশব নেই, কোন কৈশোর নেই। এই অপ্রাপ্তি, এই অপূর্ণতা তাঁকে যে কতখানি কাঁদায় তা অনুভব করা যায় এই কথায় ‘আমার ভাষা কিংবা কবিতার সামর্থ্য নেই আমার শৈশবকে ফিরিয়ে দেবার।’

অ্যাডোনিসের (Adonis) বয়স যখন বারো অর্থাৎ ১৯৪২ সাল পর্যন্তও তিনি কোন শহর, রেডিও এমনকি গাড়িও দেখেননি। এ সময় পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে ছিলেন। তাঁর গ্রামে কোন স্কুল ছিলনা। লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় অশীতিপর এক গ্রাম্য শিক্ষকের কাছে। লেখাপড়া বলতে কোরান তেলাওয়াত ও আরবি বর্ণমালার পাঠ; এটুকুই! তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। সিরিয়ার গ্রামগুলোতে এ ধরণের শিক্ষকের বাড়িকে বলা হয় ‘কুত্তাব’ বা শিক্ষাগুরুর পাঠশালা। নিজ গ্রাম সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘তখনো এ গ্রাম সভ্যতার আতুর ঘরে।’ তবে শৈশব থেকেই আরব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী আরবি কবিতার সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে বাবার মাধ্যমে। সন্ধ্যায় বাবা যে কবিতাগুলো আবৃত্তি করতেন সেগুলো মুখস্থ করে নিতেন তিনি।

প্রতিভাবান এই কবি কিশোর বয়সেই নিজের লেখাপড়ার বন্দোবস্ত করে নিয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন হওয়া সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকরি আল কোয়াতলিকে স্বরচিত কবিতা শুনিয়ে। প্রেসিডেন্ট সুকরি’র সহযোগিতায় তিনি ভর্তি হন লাধকিয়া অঞ্চলের একটি ফরাসি স্কুলে। তারপর দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সুফিতত্ত্বের উপর গবেষণার জন্য তিনি অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি। কিন্তু এখানেও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অন্য ছাত্রদের মত ছিলনা। তিনি সিংহভাগ সময় ব্যয় করেছেন তাঁর জন্য বরাদ্দ ছোট্ট কক্ষে, লাইব্রেরিতে আর কর্মস্থল পত্রিকা অফিসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কোন বন্ধু ছিলনা। বিকল্প হিসাবে শিক্ষকদের সাথেই গড়ে উঠে বন্ধুত্বের সম্পর্ক; যাকে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘অনেক বড় পাওয়া’ হিসাবে। এর কারণ জানতে তাঁর একটি কথাই যথেষ্ট: ‘আমি কোন সাধারণ ছাত্র ছিলাম না।’ তবে আধুনিক আরবি সাহিত্যের এই দিকপাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয় হিসাবে সাহিত্যকে বেছে নেননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে যা পড়ানো হয় তা তাঁর জানার পরিধিকে খুব একটা প্রসারিত করতে পারবেনা। তাই সাহিত্য বাদ দিয়ে তিনি বেছে নিয়েছিলেন দর্শনকে। লক্ষ্য ছিল জীবনের নতুন কোন ‘দৃশ্যপথ’ এর সন্ধান পাওয়া। সন্দেহ নেই ওই দৃশ্যপথের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন। কারণ পথিক থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন আরব জাতির পথপ্রদর্শক। বিস্মৃত শৈশব, অশ্রুঝরা কৈশোর আর নিঃসঙ্গ যৌবন পাড়ি দিয়ে যে পূর্ণদৈর্ঘ্য জীবনের অধিকারী তিনি হয়েছেন তার নির্যাস শুধু তাঁর একার নয়; তাঁর জাতির, তাঁর প্রজন্মের আর বিশ্ব সাহিত্যের।

দামেস্কে থাকাকালীন অ্যাডোনিস (Adonis) যোগ দেন আন্তুন সা’দার সিরিয়ান ন্যাশনাল সোসালিস্ট পার্টিতে। এই পার্টির রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিন, লেবানন, ইরাক এমনকি সাইপ্রাসকে অন্তর্ভুক্ত করে বৃহত্তর সিরিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু ১৯৪৯ সালে অভ্যুত্থানের অভিযোগে সা’দাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার পর দীর্ঘ সময় তাকে বিনাবিচারে কাটাতে হয় জেলখানায়। তবে কারামুক্তির পর ১৯৫৬ সালে তিনি চলে যান বেইরুটে। লেবাননের নাগরিকত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে সেখানেই শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়। পরিচয় হয় অনেক খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পীদের সাথে। কিন্তু ১৯৭০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত লেবানন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করলেও এখানে স্থায়ী হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। গৃহযুদ্ধের কারণে ’৮৫ সালে বৃত্তি নিয়ে তিনি চলে যান ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি প্যারিসে এবং এখন পর্যন্ত বসবাস করছেন এখানেই।

গত শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্র ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলেও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা তখনও ছিল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। প্রাচীন অহমিকা, জড়তা আর রাজনৈতিক সংকীর্ণতা তখনও আরব জাতিগুলোর স্বযত্ন-লালিত প্রথা। এই অচলায়তন শুধু যে রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, সংক্রমিত হয়েছিল আরবি সাহিত্যেও। বহু পশ্চাতে আরবি কাব্য ভুবনে নক্ষত্রতুল্য কবি-ব্যক্তিত্ব থাকলেও দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আরবি সাহিত্যে উন্মোচিত হয়নি নতুন কোন দিগন্ত কিংবা কারো পক্ষে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি পূর্বপুরুষের গড়ে তোলা সীমানা প্রাচীর। আর এই ব্যর্থতার যন্ত্রণা থেকে যে কয়েকজন কবি অবতীর্ণ হয়েছিলেন আধুনিকতা অর্জনের লড়াইয়ে কবি অ্যাডোনিস (Adonis) তাঁদের অন্যতম। মেধা ও সাহসিকতার যুগপৎ বিহারে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিদ্রোহ, প্রত্যাখ্যান ও আধুনিকতার প্রতীক। লেবানীজ কবি ইউসিফ আল-খাল এর সহযোগে তিনি প্রকাশ করেন ‘শের’ নামক একটি সাহিত্য সাময়িকী যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল আরবি কবিতাকে সনাতন ছন্দের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে গদ্য কবিতার ধারা সৃষ্টি করা কিংবা তাঁর ভাষায় ‘গদ্যকে কবিতার স্তরে উন্নীত করা।’ তাদের এই প্রচেষ্টায় যেমন শরিক হয়েছিলেন বহু মেধাবী মুখ তেমনি বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সংকীর্ণ মানসিকতার রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তাদের কর্মী-সমর্থক এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠিত কবিরাও। তাঁদেরকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল কুচক্রী, আরব চেতনা বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে। ফলশ্রুতিতে ‘শের’ এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর তা নিষিদ্ধ হয়ে যায় সবকটি আরব রাষ্ট্রে। তবে ‘শের’ এর যাত্রা এখানেই থেমে যায়নি। সব বাঁধা অতিক্রম করে আরবি সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের স্তরে উন্নীত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন অ্যাডোনিস (Adonis), ইউসিফ আল-খাল ও ফুয়াদ রিফকার মত মহানায়কেরা। আজকের যে আরবি কবিতা তা ওই শের-এরই উত্তরাধিকার। মাহমুদ দারবিশ, অ্যাডোনিস (Adonis) ও ফুয়াদ রিফকার মত আরব কবিরা যে শক্তিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কবিতাকে একই মঞ্চে দাঁড় করাতে পেরেছেন তা মূলত ‘শের’ সৃষ্ট আন্দোলন থেকেই পাওয়া।

আরবি সাহিত্যের টি. এস. ইলিয়ট খ্যাত পরাবাস্তব কবি অ্যাডোনিসের (Adonis) কাব্য চিন্তায় বিখ্যাত আরব কবি আল নিফ্ফারি ও আবু নুয়াস এবং ফরাসি কবি র্যাঁবো ও ম্যালার্মে’র প্রভাব সর্বাধিক। ম্যালার্মে-কে পাঠ করে অ্যাডোনিস (Adonis) যেমন আবু তাম্মামের কাব্যভাষার রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তেমনি বোদলেয়ার ও র্যাঁবোর সৃষ্টিকর্মের সংস্পর্শে এসে তিনি উপলব্ধি করেন আধুনিকতা শুধুমাত্র আধুনিক সময়ের একক কোন সম্পদ নয় বরং তা মিশে আছে প্রাচীন আরবি কবিতার পরতে পরতে। তবে একথা স্বীকার করতেও তিনি কুন্ঠা বোধ করেননি যে, প্রাচীন আরবি কবিরা তাদের উত্তরসূরিদের জন্যে কোন স্বতন্ত্র প্রকাশভঙ্গী রেখে যেতে পারেননি। এমনকি কাব্যচর্চায় প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি নিজেও গ্রহণ করেছিলেন পশ্চিমা প্রকাশভঙ্গী। আর তাঁর মতে, আরবি সাহিত্যের এই দৈন্যের কারণেই প্রত্যেক আরবি কবিই দ্বৈত সত্তার অধিকারী অর্থাৎ প্রথমত সে আরবি আর দ্বিতীয়ত সে পশ্চিমা কাব্যরীতির ধারক। আরবি সুফিতত্ত্ব থেকে কিছুটা পৃথক করে অ্যাডোনিস (Adonis) সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদকে তুলনা করেছেন ঈশ্বরবিহীন মরমিবাদের সাথে। তাঁর দৃষ্টিতে কবিরা পয়গম্বর আর প্রত্যেক পয়গম্বর কবিই যুদ্ধ করেন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কর্তৃত্ব, বস্তুবাদ ও সাংস্কৃতিক নির্ভরশীলতার বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে হাতিয়ার হিসাবে তারা গ্রহণ করেন শব্দকে, ভাষাকে।

যদিও তাঁর কাব্য-দর্শনের ভিত্তিতে তিনি বিশ্বাস করেন, কোনো বিষয়কে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার ক্ষমতা কোন শব্দেরই নেই। শব্দ তাঁর অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ কোনটিকেই প্রতিফলিত করতে সক্ষম নয়। তাঁর অধিকাংশ কবিতাতেই এ বিশ্বাসের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। অ্যাডোনিস (Adonis) তাঁর ‘পাপের ভাষা’ কবিতায় লিখেছেন,

‘আমি ঈশ্বর ও শয়তানের ঊর্ধ্বে আরোহণ করেছি
আমার পরে কোন স্বর্গ নেই, কোন পতন নেই।’

চিন্তার প্রথাগত বিন্যাসকে ভেঙ্গে দিয়ে তিনি এমন সব পরাবাস্তব কবিতা রচনা করেছেন যা শুধুমাত্র আরবি কাব্য ধারাকেই নয় প্রভাবিত করেছে পাশ্চাত্যের পরাবাস্তববাদকেও। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত দীর্ঘ কবিতা ‘শূন্যতা’ কে যেমন তুলনা করা হয় টি. এস. ইলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ডে’র সাথে তেমনি ১৯৬১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দামেস্কের মিহিয়ার’ কাব্যগ্রন্থকে গণ্য করা হয় পরাবাস্তববাদের আদর্শ অভিধান হিসাবে। এ গ্রন্থের কবিতাগুলোতে তিনি উপস্থিত করেছেন সযত্নে নির্মিত চরিত্র মিহিয়ারকে। মিহিয়ার কখনো প্রথা ও কুসংস্কারের শিকার, কখনো বিদ্রোহ ও প্রত্যাখ্যানের প্রতীক, আবার কখনো এক নিষ্কলঙ্ক প্রেমিক। মিহিয়ার— এক পথপ্রদর্শকের নাম, মিহিয়ার— এক নতুন সূর্যোদয়ের নাম। এ রহস্যময় চরিত্রকে নিয়ে সমালোচকদের মধ্যেও রয়েছে মতভেদ। তবে এই মিহিয়ার যে কবি মিহিয়ার আল-দাইলানি নন তা নিশ্চিত করেছেন অ্যাডোনিস (Adonis) নিজেই ‘শুধুমাত্র নামের মিল ছাড়া আমার এই গ্রন্থের সাথে কবি মিহিয়ারের কোন সম্পর্ক নেই ।’ তাই প্রশ্ন এসে যায়, কে এই মিহিয়ার? তবে কি কবি নিজেই! এই মিহিয়ারকে মঞ্চে দাঁড় করিয়ে অ্যাডোনিস (Adonis) রচনা করেছেন বহু অসাধারণ পঙক্তি। তিনি লিখেছেন,

‘ঈশ্বর কিংবা শয়তান আমি কাউকেই বেছে নেইনি
প্রত্যেকেই দেয়াল
প্রত্যেকেই আমার চোখ ঢেকে দেয়।’
(সংলাপ)
কিম্বা
‘তোমার বাহু প্রসারিত কর
হে গোঁড়া জনপদ।
অভ্যর্থনা জানাও তাকে কাঁটা
কিম্বা পাথর দিয়ে। …
আর অগ্নিশিখাকে সুযোগ দাও
মিহিয়ারকে গ্রাস করার।’ (গোঁড়া জনপদ)

আবার মিহিয়ারের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন :

‘মিহিয়ার কোন নক্ষত্র নয়।
পয়গম্বর সুলভ অনুপ্রেরণা কিংবা
চন্দ্র উপাসনায় মগ্ন কোন চেহারাও সে নয়;
সে মিহিয়ার।
এই তো সে আসছে
নিখাদ প্যাগান বল্লমের মত;
রক্তাক্ত;
ঝরা রক্তকে সে উৎসর্গ করে সূর্যের কাছে।’ (নক্ষত্র নয়)

নির্বাসনই আরব কবিদের নিয়তি। এ কথা বললে হয়তো ভুল হবে না যে, আধুনিক আরবি কবিতার বিকাশ ঘটেছে নির্বাসনে। অ্যাডোনিসের (Adonis) মতে শুধু আরব কবিরাই নন, আরবি ভাষাও জন্ম নিয়েছে নির্বাসনে। এক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘আমি যে ভাষায় লিখি সে ভাষাই আমাকে নির্বাসিত করে।’ চরিত্রগতভাবেই পরাবাস্তব কবিতার বক্তব্য শব্দের মেঘের আড়ালে ঢাকা পরে থাকে। তবে অ্যাডোনিসের (Adonis) কবিতায় এই মেঘাচ্ছন্নতা কখনো কখনো প্রকাশ পেয়েছে খানিক বেশি মাত্রায়। তবে তাঁর কবিতা অতিমাত্রায় বিমূর্ত এমন সমালোচনার জবাবে তিনি লিখেছেন, ‘এই অস্পষ্টার মত অন্য কিছু আমাকে স্পষ্ট করেনা/ কিংবা এই স্পষ্টতার মত অন্য কিছু আমাকে অস্পষ্ট করেনা।’ আরব সংস্কৃতি ও সাহিত্যের স্থবিরতা নিয়ে মন্তব্য করে অ্যাডোনিস (Adonis) বিতর্কিত হয়েছেন বহুবার। তিনি মনে করেন, পাশ্চাত্যের প্রভাব উবে গেলে মসজিদ, গির্জা আর ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া আরবদের আর কিছুই অবিশিষ্ট থাকবে না। এক সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘এক অর্থে আমরা আরবরা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। কারণ বিশ্ব সভ্যতায় আমাদের কোন বুদ্ধিবৃত্তিক উপস্থিতি নেই।’ তার ‘আগুনের বৃক্ষ’ কবিতায় এই চিন্তারই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়:

‘আমার জনগণ
মৃত্যুবরণ করেছে আগুনের মত
তারা মৃত্যুবরণ করেছে কোন নিশানা না রেখেই।’
আর ‘স্বদেশ’ কবিতা পড়লে পাঠক মাত্রই বুঝে যাবেন হালে আরব জাতি কোন স্তরে এসে ঠেকেছে আর অ্যাডোনিস (Adonis) কবি হিসাবে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বজাতিকে মূল্যায়ন করেছেন:
‘আমি অবনত হই সেই শিশুটির সামনে যাকে বিক্রি করা হয়েছে, যাতে সে উপাসনা করতে পারে, যাতে সে জুতা পালিশ করতে পারে। (আমার দেশের সবাই উপাসনা করে; আমার দেশের সবাই জুতা পালিশ করে।)’

আরব জাতির উপর পশ্চিমাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বিশেষ করে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার ঘোর বিরোধী কবি অ্যাডোনিস (Adonis)। মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওরিয়ে আমেরিকা পুরো বিশ্বটাকেই যে অস্থিতিশীল করে তুলেছে সে কথা লিখবার দায়িত্ববোধকেও তিনি পাশ কাটিয়ে যাননি। তাঁর বহুল আলোচিত ‘নিউ ইয়র্কের সমাধি’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:

‘নিউ ইয়র্ক এক রমণী,
ইতিহাস মতে, এক হাতে সে আঁকড়ে ধরেছে এক ছিন্নপত্র
যাকে বলা হয় স্বাধীনতা।
আর অন্য হাতে, সে টুটি চেপে ধরেছে পুরো পৃথিবীর।’

অ্যাডোনিস (Adonis) ২০০৫ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য শর্ট লিস্টেড হয়েছিলেন, যদিও এ পুরস্কার তিনি পাননি। তবে ভূষিত হয়েছেন Nazim Hikmet Poetry Award , The Syria-Lebanon Best Poet Award সহ বহু মূল্যবান পুরস্কারে। দামেস্কের মিহিয়ার (১৯৬১), ছাই ও গোলাপের মধ্যবর্তী সময় (২০০৪), কেবল যদি সমুদ্র ঘুমাতে পারতো (২০০৩), দিবা-রাত্রির পাতা (২০০১), অ্যাডোনিসের (Adonis) রক্ত (১৯৭১), মানচিত্রের শিকার (১৯৮৪) তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও তিনি রচনা করেছেন ‘জড়তা ও পরিবর্তন’, ‘কবিতার সময়’ ‘আধুনিকতার স্পন্দন’, ‘আরবি কাব্যরীতি’, ‘কবিতা ও মরুভূমি’ এবং ‘সুফিতত্ত্ব ও পরাবাস্তববাদ’ সহ বহু সমালোচনা গ্রন্থ।

সৌম্য ঘোষ | Soumya Ghosh

Bengali Article 2023 | এক নিভৃত কবির উচ্চারণ : সপ্রসঙ্গ কবি দীপক হালদার

Tebhaga Movement | বাংলায় “তেভাগা আন্দোলন” এবং সলিল চৌধুরীর গণসঙ্গী

Bengali Article 2023 | নিছক, কথার কথা নয়

Bengali Article 2023 | কবিগুরুর মানবতার ভাবরূপ

অ্যাডোনিস | ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস | আমুর অ্যাডোনিস | অ্যাডোনিস এবং এফ্রোডাইট | অ্যাডোনিস (বিশৃঙ্খলা) | অ্যাডোনিস : পুরাণ থেকে উঠে আসা নায়ক-কবি | আরবি সাহিত্য | আধুনিক আরবি সাহিত্যের ক্রমবিকাশধারা | আরবি ছোটগল্পের সার্থক রূপকার | আধুনিক আরবি কবিতার উজ্জ্বল স্তম্ভ | আধুনিক আরবি সাহিত্যের ইতিহাস | আরবি সাহিত্যের যুগ বিভাগ | আধুনিক আরবি সাহিত্যের জনক কে | জাহেলী যুগের কবিতার বৈশিষ্ট্য | আরবি সাহিত্য সমালোচনা | আরবী সাহিত্যের ইতিহাস | আরবি সাহিত্যের কিতাব | মাকামা সাহিত্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ | বাংলা প্রবন্ধ | বাংলার লেখক | প্রবন্ধ ও প্রাবন্ধিক | সেরা প্রবন্ধ ২০২৩ | শব্দদ্বীপ | শব্দদ্বীপের লেখক | বাংলা ম্যাগাজিন | ম্যাগাজিন পত্রিকা | শব্দদ্বীপ ম্যাগাজিন | আধুনিক আরবি কবিতার রূপকার

Adonis | Adonis meaning | Adonis and Aphrodite | Adonis Urban Dictionary | Adonis and Persephone | Adonia | Adonis meaning in Hindi | Adonis Otogari | Venus and Adonis | Adonis Definition & Meaning | Adonis Body And Face Care | Bangla Prabandha | Probondho | Definite Article | Bengali Article Writer | Short Bengali Article | Long Bengali Article | Bangla kobita | Bengali Story | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Web Magazine | Shabdodweep Writer | Shabdodweep Founder

Leave a Comment