বৌদ্ধদর্শন ও সুধীন্দ্রনাথের কবি ভাবনা
- সৌম্য ঘোষ
রবীন্দ্রনাথের মতে, বুদ্ধদেব 'সর্বশ্রেষ্ঠ মানব'। বুদ্ধদেবের এই মানববাদ সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে আকর্ষণ করে তাঁর নিজস্ব পঠন-পাঠন এবং পিতা হীরেন্দ্রনাথ দত্তের বৌদ্ধধর্মের উপর লেখালেখির সূত্রে। তবে অবিমিশ্রভাবে তিনি বৌদ্ধদর্শনের চিন্তা-চেতনাকে গ্রহণ করেননি। তাঁর মু্ক্তচিন্তা ও ব্যক্তি মানসিকতার আলোকে নির্মাণ করে নিয়েছেন কবি চেতনার নিজস্ব যাত্রাপথ।
সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় শূন্য, শূন্যতা ও শূন্যবাদ --- বাচক শব্দ ও বাক্যাংশের বহু ব্যবহার দেখা যায়। অচরিতার্থ প্রেম, বিরুদ্ধ সমাজ পরিবেশ, ঈশ্বরের প্রতি প্রশ্নবোধক অনাস্থা তাঁকে শূন্যবাদী দার্শনিক চেতনায় নিমগ্ন করেছিল। তাঁর রচিত বিভিন্ন কাব্য থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উদ্ধৃতি হিসাবে এখানে ব্যবহার করলামঃ-
(ক) তন্বীঃ-
(১) "পরশে কি তোর, ইন্দ্রজালিক,
শূন্যে মিলাবে দানবীর অলীক?
( ('নবীন লেখনী')
(২) "কি অধরা গাঁথা তার শূন্যে শূন্যে দেয়
বিকীর্ণিয়া" ('পশ্চিমের ডাক')
(৩) "ছুটে গেনু তোমা পাশে-- কোথা তুমি?
এশুধু শূন্যতা!'' ('চিরন্তনী')
(খ) অর্কেস্ট্রাঃ-
(৪) "অখণ্ড আননখানি সীমাশূন্যে যে লুকালে"
('বিকলতা')
(৫) "বিরহ সন্তপ্ত এই শূন্যতা আমার" ('প্রলাপ')
(৬) "সমস্বরে শূন্যবাদ দেখায় প্রমাণ।" ('উদ্ভ্রান্তি')
(গ) ক্রন্দসীঃ-
(৭) "পন্ডশ্রম, নাহি মিলে সারা।
শূন্যতার কারা" ('নরক')
(৮) "ছুটেছে গৈরিক পথ নির্বিকার সন্নাসীর মতো
নির্গুণ, নির্বাণভরা, নিরাকার শূন্যের অন্বেষে"
('পরাবর্ত')
(ঘ) উত্তর ফাল্গুনীঃ-
(৯) '' হৃদয় তবু বিষাদে ভরে ওঠে
নিরুদ্দেশ শূন্যে যবে চাই;" ('নিরুক্তি')
(ঙ) সংবর্তঃ-
(১০) "ঐকান্তিক শূন্য তাকে করে বিশ্বেশ্বর"
('সংবর্ত')
'তন্বী' থেকে 'দশমী' পর্যন্ত তাঁর কাব্যমানস শূন্যচেতনাগ্রস্ত। কোথাও শূন্যবোধ হয়েছে অন্তর্বিশ্ব ও বহির্বিশ্বের বৈরিতায় হৃদয়ের বিপুল বেদনাভারবহ নঞর্থক প্রতিফলন। কোথাও শূন্যবোধ হয়েছে বৌদ্ধ শূন্যবাদের স্পষ্ট বাহক, কোথাও শূন্যবোধ হয়েছে শূন্যতায় আক্রান্ত পারিপার্শ্বিক বিশ্ব। কোথাও এক অজ্ঞাত জগতের স্বরূপ বিবেচনা, কোথাও হয়েছে স্থির অনুধ্যানে সংস্থিত। 'পূরবী'তে রবীন্দ্র হৃদয় রিক্ততার শূন্যতায় জাগ্রত করেছিল কিন্তু রবীন্দ্রনাথের 'শূন্য' কখনো ব্যথাময়, কখনো 'জ্যোতির পথে' বিসপির্ত। কিন্তু ইতিবাচক। অরূপচেতনা সঞ্জাত রবীন্দ্র মনোভাব সুধীন্দ্রনাথ অধিগত করেনি। ফলে তিনি শূন্যতাপীড়িত হয়েছেন।
বৌদ্ধদর্শনের শূন্যবাদের সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথের শূন্যচেতনার কতটাই সম্পর্ক। উপনিষদ বা বেদান্তমতে এক ব্রহ্ম থেকে সমস্ত জগতের উৎপত্তি এবং ব্রহ্মেই বিলয়। বলা হয়েছে, ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। বুদ্ধদেব ব্রহ্ম, ঈশ্বর বা পরাতত্ত্ব বিষয়ে নিরুত্তর থাকলেও জগতের অনিত্যতা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন,
"সর্বম্ অনিত্যম্, সর্বম্ শূন্যম্।"
তাঁর মতে, "দৃশ্যমান জগত বা প্রকৃতি প্রতিভাস মাত্র।" আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বহির্জগতের সংযোগসূত্রে জ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে। এই সংযোগ বর্জিত হলে বহির্জগৎ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। আবার এই সংযোগও শাশ্বত নয়। প্রতিটি মুহূর্তে তার পরিবর্তন ঘটে। তাই বলা যায়, জীবজগৎ কতকগুলি নিয়ত পরিবর্তনশীল 'ধর্ম ও সংস্কারের' প্রবাহমাত্র। এখানে ড: রাধারমন জানার 'পালি ভাষা সাহিত্য বৌদ্ধদর্শন ও রবীন্দ্রনাথ' শীর্ষক গ্রন্থে 'বৌদ্ধদর্শনের ভিত্তি' প্রবন্ধের একাংশ স্মরণযোগ্যঃ-
"প্রতিমুহূর্তে ইন্দ্রিয়ের গ্রহণকে ধর্ম আখ্যা দেওয়া হয়, যে ধর্ম অনিত্য ও বিনাশশীল।"
এই অবিরাম পরিবর্তনশীল জগৎসংসারের অনিত্যতা বা শূন্যতা চেতনাগোচর করে। মহেশচন্দ্র ঘোষ তাঁর "বৌদ্ধ প্রসঙ্গ" প্রবন্ধে বলেছেনঃ-
"সম্যক সমাধিতে চিত্তের যে বিমুক্ত হয় তাহার নাম অনিমিত্ত চিত্র-বিমুক্ত, আকিঞ্চন্য চিত্ত-বিমুক্তি এবং শূন্যতা চিত্ত-বিমুক্ত। সমাধির উচ্চ অবস্থায় কোন বাহ্যবস্তু চিন্তার বিষয় হয় না, এইজন্য ইহা অনিমিত্ত (নিমিত্তবিহীন)। তখন অন্তরে এই চিন্তা উপস্থিত হয় 'কিছুই নাই' 'কিছুই নাই' ; এইজন্যই ইহার নাম আকিঞ্চন্য। তখন আমিত্ব জ্ঞান ও মমত্ববোধ বিদূরিত হয়, এইজন্য ইহার নাম শূন্যতা।" (বিশ্বভারতী, পৃ: ৩৬, ১৩৬৩)
বৌদ্ধদর্শনের উত্তরকালীন বিকাশে মহাযান শাখার মাধ্যমিক সম্প্রদায় শূন্যবাদী নামে খ্যাত। এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা নাগার্জুনের মতে, - অস্তি-নাস্তি, নিত্য-অনিত্য, আত্মা-অনাত্মা কোনোটিই সত্য নয়। জগৎ যেমন আদি, মধ্য ও অন্তহীন; কেমনি পাপ-পুণ্য, রূপ-রস-গন্ধ স্পর্শ কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। সমস্তই শূন্যগর্ভ। মহাজনীরাও আদি বুদ্ধ বা পরমাত্মাকে শূন্য স্বরূপ বিবেচনা করেছেন। তাদের মতে নির্বাণও শূন্য। সুতরাং শূন্য থেকে উৎপত্তি এবং শূন্য নয়। বৌদ্ধদর্শনের এই 'শূন্যবাদ'কে পাশ্চাত্য পণ্ডিত এবং প্রাচীন হিন্দু দার্শনিকেরা সর্বনাস্তিবাদ রূপে আখ্যায়িত করেছেন। এক্ষণে দ্বিধাগ্রস্ত আমি। যে সংগত প্রশ্ন আসে মনে, সব কিছু নাস্তিক হলে ধর্মীয় আচরণ ও মৈত্রী ভাবনা নিরর্থক প্রতীয়মান হয়। এক্ষেত্রে সবকিছুই নঞর্থক হয়ে ওঠে। এখানেও শরণাপন্ন হই রবীন্দ্রনাথের কাছে। কবিগুরুর মতে, বৌদ্ধ দর্শনের নিখিল ব্যাপ্ত প্রেম ও করুণা নঞর্থক হতে পারে না। তিনি বৌদ্ধ দর্শনের শূন্যতাকে অভাবাত্মক অর্থে গ্রহণ করেননি। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে দীপক রায়ের রচিত "মার্কস, সুধীন্দ্রনাথ ও বৌদ্ধদর্শন" গ্রন্থের একাংশঃ-
"সুধীন্দ্রনাথের পিতাও বৌদ্ধ দর্শনকে ক্রমাগত নাস্তির প্রয়োগের মাধ্যমে সার্থক অস্তিত্বে উত্তরণে বিশ্বাসী বলে মনে করেছেন। আধুনিক পুত্র অবশ্য এই অস্তিবাদী ও পরাশান্তিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। জগৎ ব্যাখ্যানে 'সর্বংক্ষণিকং', 'সর্বশূন্যং' প্রভৃতি নেতিবাচক বৌদ্ধ ধারনাগুলি সুধীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিল।"
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত মানবতাতন্ত্রী, 'অন্বিষ্ট নির্মাণ আর সর্বদর্শী ক্ষমা' ('অনিকেত') তাঁর কণ্ঠেও অনুরণিত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ক্ষয়, বিনষ্টি ও অবক্ষয় তাঁর চেতনায় প্রবল ছায়া বিস্তার করেছে এবং তিনি নৈরাশ্যগ্রস্থ হয়েছেন। আবার ঈশ্বর সংক্রান্ত দ্বন্ধাত্মক অনুভবনায় তাঁর নেতিবাদী দৃষ্টিকোণ তাঁকে বৌদ্ধদর্শনের নিঃসীম শূন্যতার নিকটবর্তী করেছে। "দশমী" কাব্যগ্রন্থে তিনি যে ব্যক্তিজীবনের ব্যর্থতাবোধ বা মৃত্যুচেতনাপৃষ্ট শূন্যতাকে উপলব্ধি করেছেন হীনযানীদের শূন্যবোধের সঙ্গে তার সাধর্ম রয়েছে। যখন তিনি লেখেনঃ-
"শোধবোধ শূন্যে অবমিত...." ('অগ্রায়ণ')
কিংবা----
"তারপর মিশে আদিভুতে
হবেই স্বাভাবিক।" ('নৌকাডুবি)
তখন সুধীন্দ্রনাথের মধ্যে হীনযানী শূন্যতার ব্যঞ্জনা অনুভূত হয়ে যায়।
সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় শুধু 'শূন্যতাবোধ'-ই নয়, 'নির্বাণ' শব্দের অজস্র ব্যবহার দেখি। এই নির্মাণ চেতনা সকল তৃষ্ণার সমাপ্তিতে কখনও প্রেমানুভবের পরম সুখস্বরূপ, কখনও মৃত্যুর পটভূমিকায় মুক্ত-স্বরূপ। কিন্তু নির্মাণ এবং অন্বিষ্ট বিবেচিত হলেও সুধীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হতে পারেননি।জড়বাদী চেতনাসূত্রে কখনও তা কপোল-কল্পনা রূপে অনুভূত হয়েছে। তাঁর রচিত বিভিন্ন কাব্য থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উদ্ধৃতি হিসাবে ব্যবহার করলামঃ-
(ক) "হৃদয়ের মহাশূন্য কম্পমান নির্বাণের শীতে"
(পুনর্জন্ম : অর্কেস্ট্রা)
(খ) " নির্বাণ বুদ্ধির স্বপ্ন, মৃত্যুঞ্জয় জ্বলন্ত হৃদয়"
(সৃষ্টির রহস্য : ক্রন্দসী)
(গ) "নির্বাণ সর্বতোভদ্র:"
( প্রতিপদ : উত্তরফাল্গুনী)
বস্তুতপক্ষে মনে হয়েছে, দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি লাভই হলো সুধীন্দ্রনাথের কাম্য। মনোবিশ্ব ও বস্তুবিশ্ব যে বেদনা ও যন্ত্রণায় তাঁকে বিদ্ধ করেছে, তার থেকে মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষায় বৌদ্ধ দর্শনের নির্মাণ হয়েছে প্রার্থিত। তাই তাঁকে বলতে হয় ---
"দাও মোরে নির্গুণ নির্বাণ"।।
No comments:
Post a Comment