রূপকথার জামা
- তনিমা হাজরা
মামীমার কথা বলতে গেলে আমার জন্মদিনে তার বানানো হাজার রঙের কুঁচিদার ফ্রকটার কথা মনে পড়ে।।
আমার ঊনত্রিশ বছরে বিধবা হওয়া তিন সন্তানের মা মামীমা, আলুসেদ্ধ, লঙ্কাপোড়া আর এক তরকারী নিরামিষ ভাত খাওয়া মামীমা কি করে যে দেওর ননদ বা বোনেদের এতো উথলে পড়া দাম্পত্যসুখ দেখে তার মধ্যে ডুবে থাকতে পারতো এমন নির্মল প্রাণে, সবাইকে ভালবাসতে পারতো এমন করে, সেকথাটা আমার বড্ড মনে পড়ে।।
মামার তখন চাকরিতে লক আউট। সংসারে ভাত নেই, তাই নিরুপায় মামীমা যে রেলগাড়িটায় ছেলেমেয়ে নিয়ে ননদের বাড়ি কলকাতা যাচ্ছিল, বিষ্ণুপুর ষ্টেশনের একটু আগে গাড়িটা হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেল, মামীমা জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, কী হয়েছে গো?
রেললাইনের পাশ থেকে একটা দেহাতি লোক বলল, একটা মদ্দলোক কাটা পইড়্যেছে গো, সব সাফ হলে তবেই টেরেন ছাইড়বেক।
সেই লোকটা আমার মামা ছিলো, আমার দায়িত্ব এড়িয়ে পালিয়ে যাওয়া মামা।।
ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী-মা সবার দায়িত্ব এড়িয়ে পালিয়ে যাওয়া মামাকে আমার একটুও মনে পড়ে না। ঘা খেতে খেতে সন্তানদের জন্য প্রতি পলে পলে প্রাণপাত করে করে বেঁচে থাকার অদম্য যোদ্ধা মামীমাকে আমার খুব মনে পড়ে।।
সব শোক তুচ্ছ করে মামীমা দারুণ নাচতে পারতো, আমাদের পাড়ার ফাংশানে, গানের তালে তালে আমাদের নাচ তুলে দিতো মামীমা।
জীবনে না পাওয়া প্রেমের মুখে কষিয়ে লাথি মেরে, যত দেওর, ননদ আর তাদের ছেলেপুলেদের বিয়েথাওয়ার সময়ে, তাদের চন্দন পরিয়ে, বেনারসি পরিয়ে তারপরে, নিজের সাদা শাড়িখানা গায়ে চড়িয়ে গোপাল জর্দা আর পান মুখে দিয়ে সেই ভুবনমোহিনী হাসিটি হাসবার,ঔদ্ধত্য আর ঔদার্য দেখাতে পারতো আমার বীরাঙ্গনা মামীমা।।
সব শারীরিক কামনা বাসনার মুখে নুড়ো গুঁজে দিয়ে,মা হয়ে বেঁচে ছিল আমার মামীমা, পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের টিউশানি পড়িয়ে, উল বুনে, মেশিনে জামাসেলাই করে, আত্মীয়স্বজনদের নানা সাহায্য, দান অনুদান গ্রহণ করে,জন্মাষ্টমী, একাদশী, অম্বুবাচী, বারের পুজো, ইত্যাদি হাজারটা উপোস কাপাস, এসব করতে করতেই শ্বাশুড়ির অনুশাসনের নীচে ইঁটচাপা হলুদ ঘাসের মতো আমার মামীমার স্নিগ্ধ যৌবন পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ভাগ্যকে বুড়ো আঙুল দেখাতে দেখাতে।।
তারপরে মেয়ের বিয়ে হল, ছেলেরা সব নিজের পায়ে দাঁড়ালো, অঢেল টাকাপয়সা রোজগার করে মামীমাকে তারা খুব খুব আদরে যত্নে রাখলো।।
ওহ! যে ফ্রকটা দিয়ে কবিতার শুরু, সেই ফ্রকটার বাকি কথাটা বলি, কারণ সেই ফ্রকটা ভারি অদ্ভুত ছিল যে, অনেক রঙের ছিটকাপড় জুড়ে জুড়ে বানানো ছিল সেই ফ্রক, কারণ একটা জামা বানানোর জন্য একটা গোটা ছিটকাপড় কিনবার সামর্থ্য তখন আমার মামীমার ছিল না, কিন্তু উপহার দেবার মতো একটা স্নেহময় ইচ্ছে আর মায়াময় মন কিন্তু ছিল মামীমার কাছে, তাই অর্ডারবাড়ির বেঁচে যাওয়া টুকরো টুকরো কাপড়গুলো জমিয়ে জমিয়ে সেগুলো জুড়ে জুড়ে আমার জন্য সেই জামাটা বানিয়েছিল মামীমা।। অনেক দামী দামী জামার চেয়েও সেই জামাটাই আমার ভারি প্রিয় ছিল।
আট-নয় বছর বয়সের আমি নিজের মনে মনে সেই ফ্রকটার নাম রেখেছিলাম, "রূপকথার জামা"।জামাটা গায়ে দিয়ে আমি নানা রঙের দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে পারতাম।। তখন বুঝিনি আমি, আজ বুঝি, সবার ছুঁড়ে দেওয়া প্রেম, ফেলে যাওয়া করুণা,ছুঁড়ে দেওয়া দয়া, অবহেলা ফেলে রেখে যাওয়া তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গ এসব নিখুঁতভাবে জুড়ে জুড়ে, এমন একটা " রূপকথার জামা" বানাতে হলে মামীমার মতন একজন অত্যন্ত দক্ষ দর্জি হতে হয়।।
No comments:
Post a Comment