শব্দদ্বীপের অতিথি সম্পাদক
জুলাই - আগস্ট - সেপ্টেম্বর
কবি - শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ
বিদ্রোহী কবি সম্পর্কে আমার অনুভূতি
- শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ
কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁকে নিয়ে আমার মধ্যে আবেগের জন্ম কীভাবে হলো। কবে থেকেই বা হলো, সেটাই শুরুতে বলি। শৈশবে শিশু মনের সাথে পরিচয় ঘটে - 'ভোর হলো / দোর খোলো / খুকুমনি ওঠ রে!--' এইভাবে তাঁর ছড়ায় জেগে উঠলাম। একটু বড় হলে জ্ঞান আহরণে বেড়িয়ে পড়তে চাইলাম বেপরোয়া ভাবে 'থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,-' আটপৌরে জীবন নিয়ে কবির মতো বেরিয়ে পড়তে পারিনি। মনের মধ্যে ইচ্ছেটার জন্ম নিল। কৈশোরে একটা ধারণা পোষণ করতাম। পাঠ্যপুস্তকে যাঁদের লেখা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় সেইসব কবি লেখক বোধহয় আর বেঁচে থাকে না। শ্রেণীকক্ষে যখন শুনলাম, বাংলার শিক্ষক সম্প্রতি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দেখে এসেছে। অবাক না হয়ে পারলাম না। ভাবলাম নিশ্চিত প্রিয় কবির সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে। যখন শুনলাম ১৯৪২ খ্রি: থেকে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী তো বটেই, বোবা হয়ে গেছেন। কাউকে চিনতে পযর্ন্ত পারছে না। শুনে হতবাক হয়েছিলাম।
দু'একদিন পরে কবির সম্পর্কে বিষাদ কাটিয়ে, মনের প্রফুল্লতা ফিরে পেলাম। দক্ষিণ পাড়ার তে'মাথার মোড়ে, আনুষ্ঠানিকভাবে কবিপুত্র সব্যসাচীকে আনা হচ্ছে। পুত্রের মুখে বিদ্রোহী কবির কত অজানা কথা শুনতে পাবো। কবির পুত্র কবির মতো একমাথা বাবরি চুল থাকবে। পরে জেনেছি সব্যসাচীর দেখতে, যৌবনের নজরুল ইসলামের মতই । ভালো আবৃত্তিকার। সব্যসাচী যখন নজরুল কবিতা আবৃত্তি করতেন দশদিক কাঁপিয়ে দিতেন। যেন কবিতা পাঠ করছেন না। কবিতার মধ্যে আঁকা চিত্রকল্প উদাত্ত কণ্ঠে ফুটিয়ে তুলতেন। আশায় আছি কবে সেই শুভদিন আসবে। দুর্ভাগ্য কোন অনিবার্য কারণশত সব্যসাচী আর আসেননি। বেশ খারাপ লেগেছিল আমাদের।
আবার যখন শুনলাম, বিদ্যালয় থেকে প্রাচীর পত্রিকার জন্য লেখা চাওয়া হচ্ছে বিষয় কাজী নজরুল ইসলাম। নতুন আনন্দে লিখে ফেললাম -'বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল / চুরুলিয়া গ্রামে ধাম, যে অমর বট করেছ রোপণ, মানব সমাজে হবে না পতন, চিরদিন রবে তোমারি স্মৃতি / লুপ্ত হবে না নাম।' আরো চারটি স্তবক লিখে জমা দিলাম। আমাদের কী কপাল প্রাচীর পত্রিকা প্রকাশের মুখ দেখল না। রবীন্দ্রনাথের কথায় "আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না" সেটাই বাস্তব রূপ পেল। তবে আমাদের মতো ছোটদের মনে সেই যে নজরুল ভাবনা মনের মধ্যে বিঁধে গিয়েছিল ভালোই হলো। তার ফলস্বরূপ আজকের আমরা। কবিকে ভুলতে পারিনি। ভুলতে চাইও না।
কবির সম্পর্কে আরও জানতে শুরু করলাম। কীভাবে তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল। এইটুকু বুঝেছিলাম, ঐশ্বর্যের মধ্যে ডুবে থেকে গড়েনি। অর্থনৈতিক সংকট পথে নামতে সাহায্য করেছিল। পরিবেশের বৈষম্য চাক্ষুষ করেছিলেন। প্রতিকূলতায় গড়ে উঠেছিল বলে বলতে পেরেছিলেন -''হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান!'। বাস্তব অনুভূতির প্রকাশ তাঁর প্রতিটি লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে।
এখন বিদ্রোহী কবির জীবন ও সাহিত্য নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলছে। তাঁর মতাদর্শ উপলব্ধি করার চেষ্টা চলছে। অনেকে নজরুল বিষয়ে পিএইচডি করছে। তাতে ব্যক্তি নজরুল ইসলামের কী বা এসে গেল। তিনি বলেছেন বড় ভাব নিয়ে কখনই ভাবেননি। যা দেখেছেন সেটাই লেখায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এটাই অভ্যাসজাত, এটিই তাঁর স্বভাব। স্বভাবকবি বলে কবি ভান করেন না। সমাজ তথা দেশের প্রয়োজন যা লেখেন, তাতে সাহিত্য গুণ নাই থাক। অমর কাব্য নাই হোক। সত্যিটা তাকে বলতেই হবে। তাই কবি পোশাকি কবিদের প্রতি বাঁকা ইঙ্গিত করে বলেছেন- 'বড় কথা বড় ভাব আসে না ক' মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!/ অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছো সুখে!'। যারা তাঁকে যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ভাবেন না, তাই তিনি নিজেকে বলেছেন 'যুগের না হই, হুজুগের কবি' সবাই এভাবে ভাবলেও কবির হারানোর কিছু নেই।
কবির জন্মলগ্ন থেকে দুঃখ আর পিছু ছাড়েনি। বাড়ির দুঃখ কষ্ট সাময়িক নিবারণের জন্য কী কাজ না তিনি করেননি। সেই দুঃখ-গাথায় আর যেতে চাই না। বহু চর্চিত বিষয়। বিশ্বের মানুষ তো জানে। তাঁকে চেনানোর জন্য বিষদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। সাধারণ চিন্তায়, তাঁর অসাধারণত্ব ধরা পড়ে। তিনি সাম্যবাদের কবি। প্রেমের পূজারী। তাঁর প্রতিটি কবিতা ও গীতিতে সেটাই প্রমাণ করে।
আমরা নামে ও পদবিতে যে কাউকে দেগে দিতে পারি, জাত বা জাতির গণ্ডিতে। কবি হুঙ্কার দিয়ে বলে বসবে- 'হিন্দু না ওরা মুসলিম?,ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?' কবি প্রতীকী ভাবে একটা কথাই বলতে চাইবেন মানবের আলাদা আলাদা জাত বা জাতি হয় তিনি বিশ্বাস করেন না। তেমন আমিও ভাবতে পারি না 'নজরুল গীতি' আমাদের তোমাদের হতে পারে। একটা কথা আমার মতো অনেকেই ভেবে থাকবেন। 'ভক্তিগীতি'র পাশে যদি নামটা না থাকে কিছুতেই নজরুল ইসলামের লেখা কল্পনাও করবেন না। একজন নিষ্ঠাবান কালীসাধক ছাড়া বিধর্মীর কথা মনে ঠাঁই দেবে না কেউ। আমার যেমন ধারণা ছিল। চৈত্রমাসে আমার লাটবাড়ি বরদানগরে বারোয়ারি কালীপূজা হয়। খুব শুনতাম, 'বলরে জবা বল, কোন সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল...' ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গলায়। পরে হালিশহর, নিগমান্দ আশ্রম থেকে 'কীর্তনমালা' বইটি ডাকে আনি। দেখলাম ওই গানটির পাশে রচয়িতার নাম 'নজরুল ইসলাম'। তাই নজরুলগীতি যে প্রক্ষাপটে লেখা হোক, অন্তর নিহিত অর্থ একই থাকে। ভক্তি, শ্রদ্ধা, প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা গলা জড়াজড়ি করে থাকে।
প্রথমে বলেছি নজরুল ইসলাম প্রেমিক কবি। 'পূজারিণী' কবিতায় প্রেম পূজারিণীর বেশে কবির সামনে। কবি বোবা চোখের চাহনিতে নীরবে মুখর হয়ে আছেন। অস্ফুট কাব্যিক ভাষায় বলতে চাইছে, "তৃষাতুর চোখে মোর বড় যেন লেগেছিল ভালো / পূজারিণী! আঁখি-দ্বীপে-জ্বালা তব সেই স্নিগ্ধ সকরুণ আলো"। কবির মতো চোখ দিয়ে এমন প্রেম ভাবতে পারি না কেন? মানবিক প্রেমের এতো দৈন্যদশা কেন? কারণ আমাদের চোখ তো সেঁওলা পড়া কুয়োর দেয়ালে আটকে আছে। সেখানে দুটো ব্যাঙ বাস করে হিন্দু ও মুসলমান। যা-কিছু লাফালাফি ওইটুকুর মধ্যে। বিদ্রোহী কবি, সাম্যবাদী কবি, প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ওই সংকীর্ণতায় কেউ আটকে রাখতে পারেনি। অধিকাংশ মানুষের হৃদয়ে নজরুল বেঁচে আছে পরিপূরক ভালোবাসার বন্ধনে। এভাবেই একের পর এক যুগ পেরিয়ে যাবেন নজরুল ইসলাম।
No comments:
Post a Comment