মাতৃদিবসের উৎপত্তি, তাৎপর্য ও বাঙালি প্রতিক্রিয়া
- প্রবোধ কুমার মৃধা
বছরের প্রায় প্রতিটা দিনে বিশ্বব্যাপী নানা দিবস পালিত হয়। এই সকল দিবস উদযাপনের এক একটি উপলক্ষ থাকে। যেমন: ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস, ১০ই ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস, ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস, ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস, ইত্যাদি ইত্যাদি।
কোন একটি নির্দিষ্ট দিনে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশ্বব্যাপী জন-সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয় এবং দিবসটির ভূমিকাকে সর্বসমক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ করে তোলা হয়। মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার আন্তর্জাতিক মাতৃদিবস রূপে উদযাপন করা তেমন একটি বিষয়। মাতৃদিবস পালন কোন একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।অতি প্রাচীন কাল থেকে মাতৃদিবস পালনের বিকল্প রূপে এমন কিছু উৎসব পালন করা হত যেগুলিকে কেন্দ্র করে মাতৃত্বের মহিমা স্মরণ করার ব্যবস্থা ছিল। বিশ্বের প্রায় সর্বত্র মায়ের এবং মাতৃত্বের স্মরণে উৎসব অনুষ্ঠান উদযাপন করতে দেখা যেত। প্রাচীন গ্ৰীসে মাতৃ আরাধনার প্রথা থেকে সেখানে এক বিশিষ্ট দেবী 'সিবেল'-এর উদ্দেশ্যে পালন করা হতো একটি উৎসব। প্রাচীন রোমানদের 'মাত্রোনালিয়া' নামে দেবী জুনোর প্রতি উৎসর্গীকৃত অনুষ্ঠানে মায়েদের উপহার প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বহু আচার অনুষ্ঠান ছিল যেখানে মায়েদের এবং মাতৃত্বকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য একটি নির্দিষ্ট রবিবারকে আলাদা করে রাখা হতো, যেটি 'মাদারিং সানডে' (Mothering Sunday) নামে প্রসিদ্ধ। হিলারিয়া (Hilaria) থেকে আসা মাদারিং সানডের (Mothering Sunday) অনুষ্ঠানটি ছিল খ্রিষ্টানদের অ্যাংগ্লিকান সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পঞ্জিকার অঙ্গ স্বরূপ। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় নারী শক্তি অর্থাৎ মাতৃশক্তির আরাধনাই ছিল মুখ্য। দেবী দুর্গা, কালী, চন্ডী প্রভৃতি নামে বিভিন্ন দৈবী শক্তিকে মাতৃশক্তি রূপে সর্বস্তরের জনগণ সাদরে আবাহন করেছেন, ভক্তির পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করে নিজেদেরকে ধন্য করেছেন। মনের ভূমি মাটি দিয়ে মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠার দ্বারা মৃন্ময়ী মাকে চিন্ময়ী মা-তে উত্তরণ ঘটিয়েছেন।
ইতিহাস বলছে, আমেরিকার ওয়েষ্ট ভার্জিনিয়ার গ্ৰাফটন শহরে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১২মে প্রথম 'মাদার্স ডে' (Mother's Day) পালিত হয়। ভার্জিনিয়ার এক শান্তিবাদী সমাজ কর্মী ছিলেন অ্যান নামের এক মহিলা। তিনি নারী অধিকার নিয়ে ও কাজ করতেন। 'মাদার্স ডে' (Mother's Day) ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা অ্যান ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব বানিয়ে সমাজে পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতেন। অ্যানের এক মেয়ে ছিলেন, নাম আনা মারিয়া বিভ্স জার্ভিস। এক সময় মেয়ে আনার কাছে মা অ্যান আবেদন রেখেছিলেন এই বলে যে, কেউ না কেউ একদিন মায়েদের জন্য একটা দিন উৎসর্গ করুন।আনার হৃদয়ে মায়ের এই আবেদন গভীরভাবে সাড়া ফেলে।তার কারণে অ্যানের মৃত্যুর দিনটিকে সারা বিশ্বের প্রতিটি মায়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন তিনি। তারপর থেকে মায়েদের প্রতি সম্মানে পালিত হয়ে আসছে 'মা দিবসটি'। যেটি ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে 'মা দিবস বা মাতৃ দিবস' হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারটি আন্তর্জাতিক মাতৃদিবস রূপে পালিত হয়। তবে অনেক দেশ আলাদা আলাদা দিনে মাতৃদিবস উদযাপন করে,সেগুলি সাধারণতঃ মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে হয়ে থাকে।
পিতৃ দিবসের পরিপূরক হিসেবে পালন করা হয় মাতৃদিবস। মা শব্দের ব্যাপকতা সমুদ্রের থেকেও বিশাল। বড়ো আপন ও পরিচিত শব্দ 'মা'। মায়ের মধ্যে নারীত্বের পূর্ণ মহিমা বিকশিত হয়ে ওঠে। মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ীর যোগ, মায়ের থেকে আপন কেউ হতে পারেন না।মা এবং মাতৃস্নেহের সহজাত সুরক্ষা কবচ ছাড়া শুধু মানুষ কেন মনুষ্যেতর জীব থেকে কীট পতঙ্গ কেউই নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে, নিরাপদে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।মা শব্দ থেকেই বোধকরি মাভৈ শব্দের সৃষ্টি,যা সন্তানের কাছে নির্ভয়তার নিশ্চয়তা প্রদান করে। অতএব মাতৃদিবস কোন একটা নির্দিষ্ট দিন নয়। ৩৬৫ দিনই মাতৃ দিবস। নির্দিষ্ট মাতৃ দিবসটি কেবলমাত্র প্রতীকী। কেবল স্মরণ করিয়ে দেওয়া, সন্তানের সর্বক্ষণের অতন্দ্র প্রহরী স্বর্গাদপি গরীয়সী জননীর অপার মাহাত্বের কথা। উক্ত দিনটিতে আমরা সমবেত ভাবে বিশ্বব্যাপী বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের জাগরণ ঘটিয়ে বিশ্ব মাতৃত্বের আরাধনায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করি।
হুজুকে মাতা বলে একটা কথা আছে। দেশে বিদেশে হুজুকে মাতা মানুষের অভাব নেই। বাঙালিরা এই কাজে খুবই দক্ষ। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে মাতৃ দিবস পালনের বা মায়ের স্মরণে কোন নির্দিষ্ট দিন বা উৎসব অনুষ্ঠানের হদিশ মেলে না। তবে এটি সম্পূর্ণভাবে পাশ্চাত্যের আমদানি। আমাদের প্রাচীন সভ্যতা ছিল মূলত আধ্যাত্মিকতায় জারিত। ভোগবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নানা ভাবে সমৃদ্ধ করেছে।
বাঙালিরা মাকে অন্তর থেকেই শ্রদ্ধা করেন এবং ভালোবাসেন। কিন্তু মাকে নিয়ে বিশেষ কোনো দিবস পালনের ধারণা তাদের মাথায় আসেনি।প্রায় দু'শ বছরের ব্রিটিশ শাসন আমাদের জাতীয় জীবনে পাশ্চাত্য সভ্যতার বীজ বপন করে দেয়, তার থেকে আর আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি, পারা সম্ভব ও না। মাতৃ দিবস পালন তারই ফলশ্রুতি। তাই বাঙালিরা আজ বিশ্বের বহু দেশের বহু জাতির দেখাদেখি মাতৃ দিবস পালন করেন যা তাদের পূর্ব পুরুষদের যাপন ইতিহাসে ছিল না। বারো মাসে তেরো পার্বণের সঙ্গে মাতৃ দিবস পালন পর্বটি যুক্ত হলে ক্ষতি নেই। তবে মনে রাখা দরকার, লোকের দেখে এবং লোককে দেখিয়ে ঘটা করে মাতৃদিবস পালনের বাহাদুরি দেখাব আর বাকি দিনগুলিতে মায়ের সুখ-দুঃখের খোঁজ-খবর রাখব না, তা কোন সুস্থ মানসিকতার পরিচয় নয়। আন্তরিকতা থাক বা না থাক, লোক দেখানো সৌজন্য বোধটা আমাদের নতুন প্রজন্ম বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে সোশাল মিডিয়ার বিভিন্ন মাধ্যমে মাতৃ দিবস পালনের বাগাড়ম্বরময় কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে মাতৃ বন্দনায় কোন কার্পণ্য রাখে না। অথচ সন্ধান নিলে দেখা যায় তাদেরই অনেকের মায়েরা কোথায় কী অবস্থায় আছেন অনেক সন্তান ঠিক মতো খবরই রাখে না। এমন ও দেখা গিয়েছে, মা আছেন কোন শহর বা শহরতলীতে পরিচারিকা হয়ে আর মায়ের সেই শূন্য স্থান পূরণ করে শাশুড়ি আছেন বহাল তবিয়তে। মায়েরা যতদিন সংসারটাকে বুকে আগলে নিজের শতাংশটুকু দিতে পেরেছেন ততদিন চলছিল ভালো। তারপর যখন বার্ধক্যে উপনীত হয়ে অসমর্থ হয়ে পড়লেন তখন হয়ে উঠলেন সন্তানের তথা সংসারের বোঝা। সেই বোঝা নামাতে সন্তানগণ উপায় খুঁজতে আগ্ৰহী হলে পর ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষিতা স্ত্রীরা এসে বৃদ্ধা মাকে বৃদ্ধাবাসে পাঠাবার পরামর্শে ইন্ধন যোগায়। সন্তান এক জন হলে বৃদ্ধাবাস অনিবার্য হয়ে পড়ে, একাধিক হলে কোন না কোন সন্তান মাকে কাছে রেখে দেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় শিক্ষিত এবং পয়সাওয়ালা সন্তানগণ পয়সার জোরে মাকে বৃদ্ধাবাসের বাসিন্দা করে দিতে বেশি আগ্ৰহী। বর্তমানে এই ধারা আধুনিক শিক্ষিত সমাজের সভ্য কালচারের অঙ্গ হয়ে উঠছে। ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি, বাৎসল্য স্নেহের মূল্য ধীরে ধীরে ব্যাক-ডেটেড হয়ে পড়ছে। রোবোটিক যুগের ভবিষ্যৎ পদধ্বনির ইঙ্গিত স্পষ্ট। এমন ধারা চলতে থাকলে ভারতীয় সমাজ জীবনের সনাতন ঐতিহ্য সুদূর ভবিষ্যতে একদিন বিলুপ্ত হতে বাধ্য।
সংসারে মায়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য, অপরিমেয়। কোন উপায়েই তার মূল্যায়ন সম্ভব নয়। জগতে এমন কিছু নেই যা মায়ের সমান্তরালে তুলনীয় হতে পারে।এক কথায় মায়ের কোন বিকল্প হয় না।মা হলেন ধাত্রী। ধারণ, পালন এবং সেবা শুশ্রূষা করাই তাঁর সহজাত ধর্ম।মা একাধারে গর্ভধারিণী জননী, ধর্মপ্রাণা পত্নী ও লক্ষ্মী স্বরূপা গৃহিণী। মায়ের অবর্তমানে সংসারের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। সন্তানের জন্য মা তাঁর স্বার্থ,পরমার্থ,অমরত্ব সব কিছুই অকুণ্ঠ চিত্তে বিসর্জন দিতে পারেন। শেষ কিন্তু সন্তানের জন্য মা প্রয়োজনে নিজের প্রাণটা পর্যন্ত ত্যাগ করতে রাজি আছেন।
'মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু যেন ভার।'
ছোট্ট শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে মনের শান্তি, প্রাণের আরাম। অসীম নির্ভরতা, আত্মার নিবিড় আত্মীয়তা। আমাদের জল হাওয়াতে 'মা'কথাটি আন্তরিক আবেগ দ্বারা পরিপুষ্ট। আমাদের অঙ্গের ভূষণ মা শব্দ উচ্চারণে অন্তর আর্দ্র হয়।কল্যাণময়ী নারী মূর্তির পূর্ণ প্রকাশ দেখতে পাই 'মা' শব্দটির মধ্যে।বাংলার স্নিগ্ধ মমতা মাখা পরিমন্ডলে 'মা'শব্দটি বড়ো মধুর, বড়ো প্রাণস্পর্শী। কিন্তু বড়ো পরিতাপের বিষয়, আমাদের আধুনিক প্রজন্মের বাঙালিদের অনেকেই অন্ধ পাশ্চাত্য অনুকরণের মোহে মা নামের আধার দেবী প্রতিমাকে mom বা mummy বানিয়ে শো-কেসের মমিতে রূপান্তরিত করছে। দেবী মা আজ ভোগবাদী বাসনা কামনার মূর্ত প্রতিমূর্তি mummy তে পরিবর্তিত হয়েছে, আর এ বিষয়ে আধুনিক মায়েদের অনেকেই সন্তানদের মুখে 'মা' ডাকের পরিবর্তে mummy ডাক শুনতে অতি উৎসাহী। Mom শব্দে উগ্ৰতা আছে,স্নিগ্ধতা নেই। আড়ম্বর আছে,আবেগ নেই। মোহ আছে, মহত্ব নেই। মা-এর হাসিতে চাঁদের শীতল জ্যোৎস্না ঝরে, mom-এর হাসিতে উগ্ৰ মাদকতা বিচ্ছুরিত হয়।পল্লী জননীর দর্শনে সেই যে 'মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।' সে ঐশ্বর্য অতুলনীয়,স্বর্গীয় সুষমায় সমুদ্ভাসিত। তার কাছে কৃত্রিম প্রসাধনের প্রলেপে পালিশ করা মোমের মূর্তি mom বড়ো বিসদৃশ।
No comments:
Post a Comment