লক্ষ্মীপেঁচা (পর্ব - ২)
- শওকত নূর
ভেতরে গিয়ে দেখলাম বৃদ্ধের কক্ষটি একেবারে একপ্রান্তে। বারান্দা নেই, যে খাটে তিনি হেলানে শুয়ে আছেন, তার শিয়রের কাছেই জানালা। জানালার ওপাশে উঁচু-মাঝারি কিছু গাছগাছালি। আমাকে দেখামাত্র বেশ বিচলিত হয়ে উঠলেন তিনি। তার মুখমণ্ডল সুদর্শন-গোলাকার, মাথার সাদা চুল একেবারে খুদে। ক' সেকেন্ড দৃষ্টি ধরে রাখার পর ওই একই শব্দে চিৎকার দিলেন তিনি; লক্ষ্মীপেঁচা, উ-হু-হু!
বললাম, কেমন আছেন? আমি শিক্ষক, রেড আমার ছাত্র। ভালো আছেন কি?
তিনি আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। আমি মুখের কথা ও ইশারা-ঈঙ্গিত উভয়ই ব্যবহার করে জানতে চাইলাম তিনি যে লক্ষ্মীপেঁচা লক্ষ্মীপেঁচা বলছেন, তা দিয়ে কী বোঝাতে চাইছেন। কোন লক্ষ্মীপেঁচা তিনি ওদিকে দেখেছেন কি না, কিংবা কোন পেঁচা ধারেকাছে এসেছিল কি না। এসে থাকলে তার সাথে কান্নার কী সম্পর্ক প্রভৃতি।
এবারে তার চোখদুটি রীতিমত জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি হুম হুম করার সাথে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ছিলেন। এরপর কী জিজ্ঞাসা করবো খুঁজে না পেয়ে কিছুক্ষণ নীরবে ভাবলাম। হঠাৎ বলে উঠলাম, যে লক্ষ্মীপেঁচার কথা বলছেন দেখেছেন, সেটা কি কিছু বলেছে আপনাকে? অথবা কোনও উল্লেখ্য স্মৃতি? মনে পড়ে কিছু আপনার?
হুম হুম! উদ্বেলিত মাথা নাড়ছিলেন তিনি। এও বোঝালেন একটা পেঁচা উড়ে এসে নিয়মিত তার জানালায় বসত, কিন্তু এখন আর আসছে না। উদগ্রীব বললাম, পেঁচা কী করত? শুধু কি বসে থাকত?
খুবমত কথা বলার প্রচেষ্টা নিলেন তিনি। কিন্তু থেমে গেলেন। কিছু হয়তো মনে করতে পারছিলেন না। দম নিলেন একটু। আমিও। খানিক বাদে অকস্মাৎ বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন তিনি। আধোআধো কথা ও ইশারায় নানা কিছু ব্যক্ত করতে লাগলেন। সব মিলিয়ে এটুকু বোঝা গেল, পেঁচা জানালায় বসে তার সাথে নিবিড় আলাপচারিতায় মত্ত হয়েছে, জীবনের নানা পর্যায়ের নানাবিধ কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এ পেঁচাটা গাঁয়ের বাড়িতে তার শৈশব কৈশোরের সঙ্গী ছিল। এতদিন জানালায় বসে জীবনের নানা পর্যায়ের নানা কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, যেসব কথা তিনি বেমালুম ভুলে গেছিলেন। পেঁচা সেসব মনে করিয়ে দিয়ে খুবই ভালো করেছে। জীবনের আরো কত কথা আছে, অথচ পেঁচাটা আর আসছে না। তিনিও মনে করতে পারছেন না কিছুই। তিনি গভীর দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন, পেঁচা যদি আর কখনোই না আসে।
এবারে ভৃত্যদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম, আপনারা কেউ ওদিকে কি কোন পেঁচা দেখেছেন, ওই গাছে কিংবা এ জানালায়?
না স্যার, ওইধারে তো বিশেষ চাইটাই না। একজন জবাব দিল।
হুম -স্যার, আমি একদিন একটা পক্ষী ওই কাঁঠোলগাছের মাথায় থম ধইরা বইয়া থাকতে দেখছি। মনে তো হইল ওইডা পেঁচাই। ডাকও শুনছি মাঝেসাঝে। এই ডাক আমার বহুল চেনা।
এ নিয়ে ভৃত্যদের সাথে আর কোন কথা বললাম না আমি। মনে মনে ভাবলাম, এমন হতে পারে যে খাটে বসে কোন পেঁচাকে ভদ্রলোক গাছের ডালে বসে থাকতে দেখেছেন, অথবা নিয়মিত দেখতেন - এমন কোন পেঁচা হয়তো শৈশব কৈশোর যৌবনে বা জীবনের নানা সময়ে তিনি দেখে থাকবেন। আর তা থেকে কিছু কিছু স্মৃতি তিনি ফিরে পেয়েছেন। জানালায় পেঁচার বসা, তার সাথে কথোপকথন - এ বিষয়টি হতে পারে নিখাদ কল্পনা কিংবা হ্যালুসিনেশন ধরনের কিছু, যা একাকীত্ব থেকে এসে থাকবে, অথবা ভিন্ন কোনও কিছু যার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ মনস্তাত্ত্বিকগন দিতে সক্ষম হবেন।
ভাবনার ফাঁকে লক্ষ্য করলাম, তিনি জানালাপথে একনিবিষ্ট চেয়ে আছেন। হয়তো অপেক্ষা করছেন লক্ষ্মীপেঁচাটিকে দেখতে পাবেন বলে। ভৃত্যদের উদ্দেশ্যে বললাম, তা ওনার স্ত্রী তো মনে হয় বেঁচে নেই, নাকি?
জি হ্যাঁ, সে মারা গেছে পাঁচ বৎসর আগে।
কোথায় সমাহিত হয়েছেন?
ওনাদের গ্রামের বাড়িতে।
ওই ছবিটি কার, হাতে লাঠি ধরা? দেয়ালে টাঙানো এক ছবি দেখিয়ে বললাম।
ওনার ইস্ত্রির।
হুম, তা ওনাদের গ্রাম চিনেন, এমন কেউ আছেন আপনাদের মধ্যে?
জি, আমি ওনাদের গ্রামের লোক, একোই পাড়ায় বাড়ি।
বেশ, তা ওনার স্ত্রীর কবরস্থান সম্পর্কে একটু বলুন। আশেপাশে কী কী আছে, কবর কেমন -বাঁধানো, নাকি বাঁশের বেড়া, এইসব।
কব্বোর বাঁন্ধানোই, লেখা আছে, নাম, জন্ম, মৃত্যু। চারিধারে গাছ আছে, ওইধারে খেতখোলা।
কী কী গাছ আছে?
আমগাছ আছে মাথার ধারে, পায়ের ধারে কাঁঠোলের গাছ। আরো আছে নাইরকোল, সুবারি, বরোইর গাছ, কলার ছোপও আছে -অতো তো আর গুইনা কওন যায় না - নানান গাছোই আছে।
খেতে কী কী ফসল হয়? আশপাশের খেতে?
নানান সময় নানান ফসলই হয়- ধান,পাট তরিতরকারি, মাঝেমধ্যে গমও বুনে।
বাড়ির ঘরগুলো কেমন? টিনের, নাকি দালান?
চাল টিনের, মাইঝাল আর দেওয়াল পাক্কা।
তা ওনারা গোসল করেন কোথায়? নদী, খালবিল,পুকুর, কিসে?
পুহুর আছে, বিল খানিকটা দূরে।
আচ্ছা, আজ উঠব। এই ছবিটা একটু দেখি - হুম- মোছাঃ মাকসুরা বেগম , জন্ম--, মৃত্যু --
চলি এবার। ভৃত্যদের উদ্দেশ্যে বললাম।
জি, স্যার।
ভদ্রলোকের সাথে ইশারায় বিদায় নিয়ে সেদিনের মতো বেরিয়ে এলাম। এরপর আরো দুদিন তার সাথে সরাসরি ও ইশারা ইঙ্গিতে কথা বলেছি ; জেনেছি লক্ষ্মীপেঁচা আসেনি, তিনিও অধিক কিছু মনে করতে পারছেন না -সেই আহাজারি। এরমধ্যে লক্ষ্মীপেঁচা বিগত দিনে তাকে কী কী স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আনুমানিক ইশারা করে করে যেসবে তার আনন্দঘন সায় পেয়েছি তা নিম্নরূপ :
তার ছেলেবেলায় লক্ষ্মীপেঁচা গাছে বসে থাকত, তিনি ঘুড়ি ওড়াতেন, ফুটবল, ভলিবল -হাডুডু - কাবাডি খেলতেন, তিনি পুকুরে বিলে মাছ ধরতেন, সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে স্কুলে আসাযাওয়া করতেন, গাছ থেকে ফল পাড়তেন, বন্ধুদের সাথে ঘুরতেন, আড্ডা দিতেন, একসময় বিয়ে করলেন, স্ত্রীকে নিয়ে গাছগাছালির নিচে হাঁটাহাঁটি করতেন, বসতেন, মা বাবার সেবাযত্ন করতেন, আঙিনায় গাছ লাগাতেন, ফসলের খেত দেখতেন, ফসল পরিচর্যা করতেন - প্রায় প্রতিটি কাজই লক্ষ্মীপেঁচার চোখের সামনে ঘটত, আর ঠিক সেই পেঁচাটাই এখানে এসে তাকে সঙ্গ দিয়েছে, সবকথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। অথচ এখন পেঁচাটা আর আসছে না।
আমার এসব বর্ণনা বিবৃতির প্রতি ক্ষেত্রে তিনি চোখমুখ বিস্ফারিত প্রবল সমর্থনসূচক উচ্ছ্বসিত হতেন, শিশুসুলভ হো হো হাসতেন, আবার নিমিষে অশ্রুসজল হাউমাউ কেঁদে উঠতেন। নিশ্চয়ই দুয়েরই মূলে রয়েছে স্মৃতি জাগানিয়া সুখদুঃখের সংমিশ্রণ।
মাঝে উল্লিখিত দুদিনের একদিন আমি একটি ক্যামেরা নিয়ে বাসাটিতে যাই। সেটি দিয়ে দেয়াল থেকে ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রীর যুবক ও বৃদ্ধবয়সের দুটি করে ছবি নিই। গত পাঁচদিন আমি পড়ানোর উদ্দেশ্যে বাসাটিতে গেলেও ভদ্রলোকের কক্ষে ঢুঁ দিইনি। বসার ঘর থেকে পূর্ববৎ শব্দপাত শুনেছি।
ষষ্ঠ দিন আমি যথারীতি হাজির হলাম তার কক্ষে।
এই পাঁচদিনের অবসরে আমি কিছু কাজ করেছি। শহরপ্রান্তের গ্রাম এলাকায় গিয়েছি, গাছপালা, ঘরবাড়ি, কবরস্থানের ছবি নিয়েছি, পুকুর, ফসল-খেতসহ নানাস্থানের ছবি নিয়েছি, চমৎকার একটি লক্ষ্মীপেঁচার ছবিও সংগ্রহ করেছি। এসব নিয়ে আমি আমার আবাসিক এলাকার পরিচিত এক ফটোস্টুডিওতে গিয়েছি। সেখানে স্টুডিওম্যানের সাথে বসে যা করেছি, তারই সারসংক্ষেপ নিয়ে আজ এ বাসায় হাজির হয়েছি - কর্মকাণ্ডের গড়ফলটি পোস্টার আকার দাঁড়িয়েছে। কিছু অর্থ খরচে পোস্টারটি বাঁধাই করে তা নিয়ে এসেছি - এ মুহূর্তে তা মোড়কাবৃতও আমার বগলে ধরা।
আজ ভদ্রলোকের কক্ষে প্রবেশমাত্র খুব বেশিমাত্রায় বিচলিত হয়ে উঠলেন তিনি । যতটা আমাকে দেখে, ততটাই সম্ভবত আমার বগলে ধরা বস্তুটি দেখে। আমার আপাদমস্তকে ফ্যালফ্যাল করে চাইতে লাগলেন তিনি। আমি কোন কথা বললাম না। কোন ইশারা ইঙ্গিতেরও প্রয়োগ ঘটালাম না। নীরবে বগলে ধরা বৃহদাকৃতির বাঁধাই করা ফটোসমাহার ফ্রেমটির কাগুজে-মোড়ক ছাড়াতে লাগলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, ছাত্রের চূড়ান্ত পরীক্ষা সমাপ্তির পথে, আমারও বিদায় আসন্ন, হে বিধাতা, আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস যেন সফল হয়! লক্ষ্মীপেঁচা আর আসুক না আসুক, এ দিয়েই যেন লক্ষ্মীপেঁচার অসমাপ্ত কাজ আপাত সুসম্পন্ন হয়!
মোড়ক খোলা সমাপনান্তে ফটোসমাহার ধারকটি দাঁড় করালাম পাশের টেবিলে, এমনভাবে যাতে করে পুরো সমাহারটি একনজরে তার দৃষ্টিতে আটকায়:
সমাহারে চোখ ধরে আচমকা প্রবল উল্লসিত, উচ্ছ্বসিত, উদ্বেলিত হলেন তিনি- শুরুতেই দেখতে পাচ্ছেন ফলবন্ত আমগাছের মাথায় বসে থাকা একটি চমৎকার লক্ষ্মীপেঁচা! ডানেই গাছের নিচে তার ও তার স্ত্রীর যুবক বয়সের যুগল ছবি - একটি বাঁধানো কবর-সামনে পেছনে একটি করে গাছ, আরো গাছ, ফসলখেত, পুকুর, আধোপাকা কিছু ঘর, কিছু অচেনা ছেলের দল, ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্য, ফুটবল - ফুটবল ও কাবাডির মাঠ, মাছধরা, ফলপাড়ার দৃশ্য, ঘনমেঘ দিগন্ত, দণ্ডায়মান কিছু মাঝবয়সী নরনারী, গরু ছাগল ফুল, মৌমাছি, বিবিধ পাখির ঝাঁক, স্কুলঘর প্রভৃতি।
ফটোসমাহার ধারকটি টেবিলে স্থির দণ্ডায়মান। খানিকটা ক্লান্তি নিয়ে স্থির দণ্ডায়মান আমিও। প্রতি দৃশ্যে শশব্যস্ত নজর করে চলেছেন তিনি। খুবমত হাসি বিস্ফারিত হতে লাগল তার চোখেমুখে। একদুই মিনিটের মাথায় ধারকের শীর্ষ থেকে শেষ নাগাদ পৌঁছে তিনি আবারও শীর্ষে ফিরেছেন, দৃষ্টি লক্ষ্মীপেঁচাতে স্থির। স্মৃতির আদ্যোপান্ত যেন ঘুরে আসা হলো। এবারে ব্যাপক উচ্ছ্বাসে উঠে যেতে সচেষ্ট হলেন তিনি। লক্ষ্য ফটোসমাহার ধারক। আমি এক হাতের আলতো বাধায় থামালাম তাকে। অন্য হাতে ফ্রেমটি টেবিল থেকে তুলে তার বাড়ন্ত দুহাতের মধ্যখানে সমর্পণ করলাম। দুহাতে ফ্রেমটি বুকে জড়িয়ে হো হো হেসে উঠলেন তিনি, ক-সেকেন্ডের মাথায় তা পর্যবসিত হলো অশ্রুসিক্ত হাউমাউ কান্নায়। তিনি মুখে বারবার বলতে লাগলেন, লক্ষ্মীপেঁচা, হা হা হা, এই লক্ষ্মীপেঁচা!
No comments:
Post a Comment