নিজেকে খুঁজে পেতে চাই
- জয়নাল আবেদিন
আমি কবি হতে চাইনি, শুধু
তোমার কবিতার শব্দ হতে চেয়েছিলাম।
জমাট বাঁধা শব্দগুলোর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে-
নিজেকে মেলে ধরতে উদ্যোগ নিয়েছিলাম মাত্র।
মনে হয় , তুমি আমাকে তোমার সৃষ্টিতে
মেনে নিতে পারোনি। তাই - গোলাপটাকে
পাপড়ি মেলে ফুটে উঠতে দাওনি, পাখিগুলোকে
তাদের সহজাত ডাকাডাকি বন্ধ রাখতে হলো।
আকাশে জমতে থাকা মেঘগুলো- মন খারাপের
ডানা মেলে, বাতাসে ভেসেই দূরে সরে যাচ্ছে।
তোমার কাব্য সুধায় - মন খারাপের দিনগুলো
কত সুখ এনে দেয়। মনে হয়, তোমাকে ছুঁয়ে
অনুভূতির ঐশ্বর্যে - স্বপ্নের বাগানে খোলা আকাশের নিচে চুপচাপ বসে আছি।
কতো না বলা কথা, মনের আঙিনায় উঁকি দিয়ে যায়।
আমি কবি হতে চাইনি , শুধু তোমার
কলমের ঠোঁটে আমার অস্তিত্বটুকু বাঁচিয়ে রেখো। প্রতিটা কবিতায় নিজেকে খুঁজে পেতে চাই।
এভাবেই বেঁচে থাকি এখন ......
অসময়
- জয়নাল আবেদিন
সকালের আলো ফুটে ওঠার বেলায়-
ঝুড়ি , বেলচা , কোদালসহ মজুর গুলো
রোজ নিয়মমাফিক হাজিরা দেয় তিন মাথায়
বন্ধ দোকানগুলোর সামনে।
এই প্রাত্যহিকীই তাদের কটা জীবনের রসদ
যোগান দেয়। যাদের ডাক পড়ে তারা চলে যায়,
বাকি ক'জন শুকনো মুখে তাকিয়ে থাকে
ডাক আসার অপেক্ষায়।
বেলা বেড়ে ওঠে, নিরুপায় মুখগুলো -
অসহায় চোখে শেষ নজর বুলিয়ে নেয়,
দোকানপাট খুলতে থাকলে আর বসা যায় না
ভারী পা গুলো আস্তে- আস্তে পিছন ফেরে।
লক ডাউনের ফলশ্রুতি এমন মানুষগুলোকে
বে-রোজগারি করে দিশেহারা করে -
এ সময় বাসায় ফেরা বড় সংকোচের
দুটো চোখ জল টলটলে ভরে ওঠে।
ক্ষুদে চোখ গুলো আত্মতৃপ্তিতে, জড়িয়ে ধরে
অসময়ে বাবা কে পেয়ে। তারা তো বোঝে না-
এ সময়টা সত্যিই বাবার কাছে বড়ই অসময়।
যে বোঝে, সে শুধু জলের বোতলটা এগিয়ে দেয়
বুকটাকে মরুভূমি হতে দেয় না।
প্রাত্যহিকী
- জয়নাল আবেদিন
ওরা কাঠ কাটে, মরা গাছের শুকনো
ডালপালা। ঘন জঙ্গলে দল বেঁধে
ঢুকে পড়ে, হেঁসো দিয়ে কেটে টুকরো করে।
বোঝা বাঁধে মজবুত দড়িতে, হাটে নিয়ে যায়-
বিক্রি করে, অবশিষ্ট থাকলে ঘরে আনে।
এটাই ক'জনের প্রাত্যহিকী, আদিবাসী মহিলার
সংসারের দায়ভার সবটাই পুরুষ মানুষের হাতে
ছেড়ে দেয় না ওরা। আসলে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে উপোষেই দিন কাটতো ছেলেমেয়ে নিয়ে,
যা, যতটুকু রোজগার বেশিরভাগটাই নেশার দ্রব্যে খরচা করে। অনেক সময় নেশায় চুর হয়ে
ঘরে ফেরার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট থাকে না।
কুসুম, সবিতা, পারুল এসবে অভ্যস্ত
মা- দুম্মাকে ছোট থেকে দেখেছে কাজ করতে -
না খাটলে পেট চলেনা। পুরুষ মানুষের প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই, কোন আক্ষেপ নেই।
স্বামীর অধিকারে বাধা দিতে শেখেনি-
অবহেলা করা পাপ কাজ, নারী হিসেবে
মনের কোনে ঠাঁই দিতে শিখেছে-কিশোরী বয়স থেকেই।
দেখতে দেখতে বড় হওয়া, মনের সহনশীলতা
শেখা -কেমন সহজাত প্রবৃত্তি শরীরে- মনে,
যে রাঁধে- সে চুলও বাঁধে। যে মা গর্ভে সন্তান
ধারণ করে, পৃথিবীর মুখ দেখিয়ে তার মুখের
খাবার ও জোগাড় করে। এটা তাদের জীবনের প্রাত্যহিকী।
ঝড়
- জয়নাল আবেদিন
সেদিন তুমি যখন আমাদের বাড়ি থেকে চলে
গেলে। সারা আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন, একটু ঝড়
উঠলো ঈশান কোণ থেকে। তোমাকে অপেক্ষা
করতে বলেছিলাম, ঝড়টা দেখে যাও।
তুমি হাসি মাখা মুখে বলেছিলে- আমিই তো ঝড় তুমি চলে যাবার পর-পরই ঝড়টা বেশ বেড়ে
গেলো। চারিদিক তোলপাড় গাছপালা, বিদ্যুৎ চমকানো-ভয়াবহ একটা সন্ধ্যার মুহূর্ত।
তারপরই এলো বৃষ্টি।
সময় তখন মধ্যরাত্রি পেরিয়েছে, দুর্যোগ তখনও সমানে-
তুমি এই মুহূর্তে কোথায়, রাস্তায় আটকে না বাড়ি পৌঁছেছ জানিনা। আমি বিছানায় ঠায় বসে আছি, চোখে ঘুম আসে না।
অস্থির একটা সময়ের মধ্যে অন্ধকার ঘরে চুপচাপ বসে আছি।
তোমার ঔদ্ধত্যে বরাবরই আমি বিচলিত হই, তুমি অবাধ্য চিরকাল। ইউনিভার্সিটি থেকে একদিন আউট ট্রাম ঘাটে গিয়েছিলাম আমরা।
তুমি বলেছিলে বাড়ি পৌঁছে দেবে,
কিন্তু-একটা বাসে তুলে দিয়ে, একটু বিশেষ কাজ আছে বলে চলে গেলে। সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম।
তুমি আমাকে বুঝতে পারোনি বা বুঝতে চাওনি,
কেমন উদাসীন তোমার কার্যকলাপ-এমনকি
নিজের জন্যও ভাবো কিনা জানিনা।
হঠাৎই তুমি বিদেশ চলে গেলে। জানানোর প্রয়োজনও মনে করো নি।
উচ্চাকাঙ্ক্ষা তোমার চিরকালই ছিলো,তবে
আমার আকাঙ্ক্ষাটাও তোমার জানা উচিত ছিলো। আজও আমার মনের মধ্যে ঝড় বয়ে চলে। কাউকে বলতে পারিনা।
তবে ,তোমাকে কোনদিন জানাবো না .........
বাবার চিঠি
- জয়নাল আবেদিন
বাবার নামে একটা চিঠি এলো,
সেদিন বিকেলের ডাকে। খামের মোড়কে
আবদ্ধ, তবে - খামটা বেশ সুন্দর দেখতে।
মা'র হাতে দিলাম চিঠিটা, মা-কেমন
উদাস ভাবে বললে, -যার চিঠি সেই যখন নেই,
ওর কোন মূল্য নেই আমার কাছে। রেখে দে।
অথচ সপ্তাহান্তে কতো চিঠি আসতো বাবার নামে, লেখা চেয়ে-গল্প কবিতা। কোনটা সাহিত্য সভার। বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের, বিয়ে- অন্নপ্রাশন।
বাবা খুব যত্ন করে সব চিঠিগুলো পড়তো, কিছু
কিছু লেখার পোস্ট কার্ডে উত্তরও লিখতো।
কেউ কেউ শটান বাড়িতে চলে আসতো, তাদের খুব খাতির করত বাবা।
আজ এক মাস হয়ে গেল বাবা আমাদের মধ্যে নেই। তার অস্তিত্ব সারা বাড়ি জুড়ে,
শুধু এক মাসে বাবার কাছে কেউ আসেনি-
লেখা চেয়ে বা সভার জন্য কোন চিঠি কেউ লেখেনি। কেমন চুপচাপ ভুলে গেলো সবকিছু।
সিঁড়ি ভাঙা অংকের হিসাবে বিয়োগ চিহ্নের
কবলে পড়ে অস্তিত্ব বিলোপ হয়ে গেলো।
নিয়মের বেড়াজালে সকলকেই হারতে হবে
জায়গা ছাড়তে হবে প্রকৃতির নিয়মেই,
কিছু ব্যতিক্রম থাকবে, বাবার সেদিনের
প্রাপ্ত চিঠির মতো।
ছুটির ঘন্টা
- জয়নাল আবেদিন
স্কুল ছুটির ঘন্টা পড়লে
ছুটি- ছুটি শব্দে ক্লাস ছাড়ার -
সেই শোরগোল, একসাথে
বেরোনো - কাঁধে ব্যাগ, হাতে সুটকেস
সে মজাই ছিলো আলাদা ।
জগত সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না
খাওয়ার কোন ভাবনা নেই,
পড়াশোনা - খেলাধুলা এই টাই
ধ্যান- জ্ঞান, লড়াইটা এখানেই
অদৃশ্য চাবুকটা তৈরি থাকতো সর্বময় ।
আজো ছুটির ঘন্টা বাজে
ছাত্র-ছাত্রী গুটিসুটি হেঁটে গেটে আসে,
বাবা-মা কেউ এসে ছেলের হাতটি
ধরে, ভারী ওজনের ব্যাগটা নেয় নিজের
কাঁধে। এ বোঝা বইতে হবে যে কতদিন।
জীবনটা রুটিনে ঘেরা - সময়টা বাঁধা
ঘড়ির কাঁটার মতো টিক টিক ঘোরা,
পান থেকে খসলে চুন-মায়ের রাঙা চোখ
বুকেতে পেটায় ঘড়ির শব্দ, তাতেই জব্দ
সময় টা ব্যবহার করো, জীবনটা সবে শুরু।
সকালটা শুরুতেই পিঠে নিয়ে বোঝা
জীবনটা গড়া হতে অতো নয় সোজা,
পরপর পা ফেলে চলতে শিখতে হবে
আরামটা খুঁজো তুমি - কাজ শেষ করে।
আগে পায়ে ভর দাও, দাঁড়ানোটা শেখো
আরামটা আসবে নিজে যে যেভাবেই -
হোক দেখো ...
No comments:
Post a Comment