নোনা জল (পর্ব - ২)
- জয়নাল আবেদিন
দিন দুই হয়ে গেলো বিমলের ছোট মেয়েটার জ্বর কমছে না। বেশ উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটছে বিমলের স্ত্রী ঝুমার। ঘরে তেমন টাকা পয়সা নেই। স্বামী বাড়ি নেই। আশা কর্মীর দিদিটা আজ সকালে কথা ট্যাবলেট দিয়ে গেছে। ভরসা দিয়ে গেছে জ্বর কমে যাবে।
বেলার দিকে শম্ভুনাথের আড়তে টাকার জন্য গিয়েছিল ঝুমা।
- আরে বাবা, কাজে বেরোনোর আগে সকলকে আগাম টাকা দিয়েছি তো। আর এখন দেবো কোথা থেকে। টাকা কড়ি বড়ো মন্দা। বড় বেজার শম্ভুনাথ টাকার কথায়।
- ছোট মেয়েটার খুব জ্বর কদিন। অসহায় গলাতে মিনতি ঝুমার।
- আরে ! জ্বর হয়েছে তো ঘরে বসে থাকলে হবে? হাসপাতালে যাও। বিনে পয়সায় ওষুধ দেয় তো। যাও গে দেখাও। কর্কশ শম্ভুনাথের গলা।
- কিছু টাকা দিলে ভালো হতো গো বাবু। করুন সুর ঝুমার।
-বলে দিয়েছি তো, এখন টাকা পয়সা হবে না। ট্রলার ফিরুক তারপর দেখা যাবে। এখন যাও ব্যস্ত আছি। বিড়বিড় করে শম্ভুনাথ।
খালি হাতে ফিরে আসতে হয় ঝুমাকে। নিয়তি বড় নিষ্ঠুর। অসহায়ের সহায় সহজে জোটে না।
চাষির দোরে চাষা তেমন খেটে মরে।ফসল তুলে
দিতে হয় চাষির গোলায়। কোনরকমে পেটের খোরাক টুকু জোটে। পাল- পার্বণ, অসুখ-বিসুখ ভগবানের দয়াতে কাটে। মালিকের দরজায় হাত পাততে হয়। কখনো জোটে কখনো জোটে না।
গাঙ পাড়ের জেলে বস্তির পরিবারগুলো একই কাঁটায় গাঁথা। মাসের-পর-মাস ট্রলারে বাস।জাল- মাছ, কূলকিনারাহীন জলে হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে, মালিকের আড়ত ভরো। খোরাকির টাকা নাও। বাড়ির মানুষ গুলো বেঁচে থাক। মাছের ঠিকমতো দাম না থাকায়- হিসেবের দিনগুলোয় পাওনার অঙ্কে চোখের নোনা জলে গামছার খুঁট ভেজাও।
- এবারে তো মরসুম ভালো গো বাবু। গেলোবারের থেকে অনেক অনেক বেশী তুলেছি আমরা। মাঝে তো দুবার ডেলিভারি দিছি। সঙ্গে তো কম এলো না !
- বলি , সোনা - রূপো পেলি কটা ? শুধু তো লোহা রে। ওতে কি আর টাকা আসে ?
মুখগুলো সব চুপসে যায়। বেশি জোর যার করলে ট্রলার ছুঁতেই দেবে না আর। পরিবারগুলো শুকিয়ে মরবে। অন্য কোন কাজ নেই।
শম্ভুনাথ মানুষটা বড় একরোখা। মুখের কথা বেরিয়ে গেলে আর ফেরত আসবে না। সঙ্গে দুই মুন্সি একেবারে হাড় বজ্জাত। হিসেবের দাঁড়িপাল্লা সামনে ঝুঁকে থাকবে তো পেছনে ঝুঁকবে না। টাকার যোগ-বিয়োগে ভুল করে কম হয়ে যাবে, বেশি কোনদিন হয়না। বড় ডাগর- ডাগর কথা বলে। কথায় বলে- বাবুর থেকে তো পেয়াদার দাম বেশি। চুপচাপ মেনে নিতে হয়।
দিন যায়। রাত যায়। পৃথিবীর কত পরিবর্তন হয়।
প্রকৃতির কত পরিবর্তন হয়। শুধু পরিবর্তন নেই এই জেলে বস্তির। পাল্টায়নি তাদের জীবনযাত্রা
- পাল্টায়নি তাদের পারিবারিক ছন্দ। নদীই তাদের রুটি-রুজির প্রধান ভরসা। নৌকা ও ট্রলার তাদের আয়ের বাহন। ভুটভুটিতে মানুষ জন পারাপার করা। সদর থেকে মাল বোঝাই করে ঘাটে ঘাটে পৌঁছে দেওয়া । দখিন বাদা থেকে খড় বোঝাই করে শহরমুখী ঘাটে পৌঁছে দেওয়া। জীবনের গতি প্রকৃতি এভাবেই চলমান থাকে।
নৌকো ছেড়ে কিছু মানুষ আজকাল ইটের ভাঁটিতে মজুরের কাজে লেগেছে। পরিশ্রম অনেক বেশি। কেউ কেউ হাঁপিয়ে ওঠে, ভীষণ কষ্ট হয়। মজা করে সেদিন ভাঁটির ম্যানেজার বাবু বলেছিলো, - তোমরা আসলে জলের কুমির গো- ডাঙ্গায় বাস করতে কষ্ট হবে তাই। দেখো কিছুদিন বাস করে, না হলে আবার জলে নেমে যাবে।
No comments:
Post a Comment