[সেরা বাংলা প্রবন্ধ ২০২২]
[২য় সেরা]
[এপ্রিল ১ম সংখ্যা] [পঠন / দর্শন সংখ্যার ভিত্তিতে বিচার]
পৌরাণিক রূপকের মোড়কে বাস্তব
- শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ
জ্ঞান হওয়াতে শুনে আসছি "রামায়ণ, মহাভারত" ইতিহাস নয়। তবে কি ইতিবৃত্ত? না কি তাও নয়। আসলে আমরা যেটা ইতিহাস বলে পাঠ্যপুস্তকে পড়ি তা হল ইতিবৃত্ত। শ্রীরাম পৌরাণিক চরিত্র। সেই শ্রীরামচন্দ্রের জন্মভূমি যদি আমরা চিহ্নিত করতে পারি, তাহলে তো শ্রীরামচন্দ্রের চরিত্র নিয়ে কল্পনার বা ধোঁয়াশার কারণ থাকে না। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত ঘোর কাটে কি না।
সংবাদ মাধ্যমের অনেকের স্বাধীন মতামতে প্রকাশিত রামায়ণ হলো একটা নির্ভেজাল উপন্যাস। মহাভারত-ও তাই। ভালোই হলো। ইতিহাস, ইতিবৃত্ত নিয়ে দলাদলি করার চেয়ে একটা হিল্লে হল। তবে, কিন্তু একটা থেকেই গেল। তা হ'ল ধর্মের মোড়কে যেমন ভারিক্কি ছিল, উপন্যাস বলায় সহজ লভ্য মনে হল এই যা। আবার এও ভাবতে পারি, যেটা হল আসলে শাপে বর।
এখন দেখা যাক, উপন্যাস কী? তার সৃষ্টি কেমন করে হয়। কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গুণমুগ্ধ এক পাঠক তাঁর উপন্যাসের ভূয়সী প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন, আপনার প্রতিটি লেখা হুবহু দৈনন্দিন জীবনের ঘটনার প্রতিফলন। শরৎচন্দ্র পাঠকের কথায় আপ্লুত না হয়ে তৎক্ষণাৎ বলেছেন, কোনো ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা নিয়ে কোন উপন্যাস গড়ে ওঠেনি, তা দিনলিপি হতে পারে। উপন্যাস সৃষ্টির প্রয়োজনে ঘটনা আনুপূর্বিক সাজাতে হয়। বাস্তব চরিত্রের সংগে আর্থসামাজিক অবস্থার কথা মাথায় রাখতে হবে। শুধু তাই নয়। বিগত,অনাগত, সম্ভব্য বিষয়গুলি যা সচেতন করবে, প্রভাবিত করবে এবং বাস্তব কল্পনার মিশ্রণে সার্থক উপন্যাস এমন কি সাহিত্যের সকল দিক গড়ে উঠতে পারে।
তত্ত্ব ও তাথ্যিক উপাদান তো থাকবেই। সেই সঙ্গে মূল চরিত্রটিকে বিশেষ ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন হয় পার্শ্বচরিত্রের। সাযুজ্য রেখে বৈচিত্র্যময় ঘটনা সংযোজিত হয়। যেমন, রামায়ণ- মহাভারতে অসংখ্য আখ্যান,উপাখ্যান আছে। যা মূল চরিত্রটিকে বিশেষ ভাবে বিকশিত করে তুলেছে। এখন পরস্পর গুঞ্জন থেকে যা অনুধাবন করছি, রামায়ণ, মহাভারত যদি কারো কারো মত অনুযায়ী উপন্যাস হয়ে থাকে - সেখানেও নিশ্চিত বাস্তব আছে। আর বাস্তব মানে ইতিবৃত্ত। এই ইতিবৃত্ত বা ইতিহাস সাধারণ ব্যক্তির হতে পারে, আবার বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠা অসাধারণ ব্যক্তির হতেই পারে। যে যেমন ব্যক্তি তার তেমন প্রভাব, প্রতিপত্তি। কারো প্রভাব পরিবার পরিজনের মধ্যে, কারো সমাজের গণ্ডিতে আবদ্ধ। কেউ কেউ সারা দেশ তথা সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন, শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন। আজও তাঁরা সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে মনুষ্য হৃদয়ে ইতিহাস হয়ে আছে।
এখানে একটা কথা জেনে রাখা ভালো। আমাদের মনীষীরা পৃথিবী বলতে প্রাচীন সাহিত্যে ভারতবর্ষ বুঝিয়েছেন। তাঁদের বর্ণিত কুশীলবদের ভারতের মাটি ছাড়া করেননি সম্ভবত। তবে, পৌরাণিক কাহিনীকারেরা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে বা অতিমানবীয় করে তুলতে ব্যক্তি স্বার্থের কথা ভেবে বাধ্য হয়েছিল। এখানে ব্যক্তি মানে সমষ্টি ভাবতে হবে, মূলত ব্রহ্মণ্যবাদী। কেন পরে আসছি এই কথায়।
এবার ইতিহাস কাকে বলে বলব। শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার, তিনি "মহাভারতের কথা" - প্রসঙ্গে বলেছেন, ইতিবৃত্তের যে অংশটুকু কালোত্তীর্ণ হয়েও আমাদের ব্যবহারিক জীবনের প্রতি মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক। চলমান জীবনের পাথেয় হয়ে ওঠা অংশই ইতিহাস। তবে এমন ইতিহাস মানব জীবনে কেউ ফিরে পেতে চাইব না। যেমন, মুসলিম রাজত্বের "হারেম"। বহু নারীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে আবদ্ধ রেখে ভোগ করা। আবার "কৌলীন্য" প্রথার অজুহাতে বহু বিবাহের মাধ্যমে ভোগ ও উপার্জনের অভিনব ফন্দি ব্রাহ্মণ সমাজের। এমন অসংখ্য নারকীয় তথ্য তুলে ধরা যায় যা ইতিবৃত্ত। এইগুলি ইতিহাস হয়ে উঠুক কেউ চাইবে না। সত্যি কথা বলতে কি প্রগতিশীল পুরুষ সমাজ তো চাইবেই না। আর নারীরা নৈব নৈবচ।
এমনিতে এইসময়ে সকালে সংবাদপত্রে চোখ বোলালে মনে হয়,সারা সমাজ হারেম হয়ে গেল না কি! আবার মিথ্যে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে ভাবে ভোগ লালসা মেটাচ্ছে ভয়ে আঁতকে ওঠার মত ব্যাপার। সবাই চাইব কলঙ্কিত অধ্যায়ের ইতি হোক। আর বৃত্ত যোগে গোলযোগ পাকাতে চাইনা। এবারে বোধহয় বলতেই পারি ইতিবৃত্ত, ইতিহাস, উপন্যাস কি তা বুঝলাম। পৌরাণিক কাহিনীগুলিতে উক্ত তিনটি অবস্থা বতর্মান। তাহলে এককথায় 'ত্রয়ী' বলতে পারি সেদিক থেকে । কারণ, প্রথম তিনটি বেদ নিয়ে "ত্রয়ী" শব্দটা গঠিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সংগৃহীত সুক্তগুলি নিয়ে চতুর্থ বেদ"অথর্ব" আবিষ্কৃত হয়। এককথায় পৌরাণিক দেবদেবীর জনক বলতে প্রামাণ্য গ্রন্থ যদি কিছু থাকে তা"বেদ" নিঃসন্দেহ। ওই প্রসঙ্গে এখন যেতে চাইনা। বৈদিক সময়ে বেদ-এর যে সুক্তগুলি বিভিন্ন ঘরানায় রচিত হয়েছিল তার উপজীব্য দেব-দেবী বাইরে থেকে আনা নয় মনে রাখতে হবে।
আর্যরা ভারতের বাইরে থেকে এসেছিল ঠিক কিন্তু এই ভারতের আদি আরাধ্য প্রাকৃতিক দেব-দেবীরা যেমন, চন্দ্র,সূর্য, আকাশ, বাতাস, মাটি,জল, গাছ, পাথর ইত্যাদি।এই পরিচিত বস্তু সমূহের পোশাকি নাম দিয়ে, আর্যরা তাদের নিজের মতো করে দেবতা বানিয়েছিল। 'বরুণদেব'- জলের দেবতা। 'পবনদেব'- বাতাসের দেবতা। এমনি সব নাম আমরা জানি। আর্যরা ভারতের আদিবাসীদের বিশ্বাসে গড়া দেবতাদের বৈদিক সাহিত্যের প্রয়োজনে কাঁচামাল হিসাবে গ্রহণ করেছিল। তবে ভালোবেসে না। উপাসকদের মুঠোয় রাখতে। ঘটনা এগোলে বোঝা যাবে। বৈদিক সময়ে আমরা যাদের দেবতা বলে বুঝি বা বোঝানো হয়েছে, তারা কেউ কথা বলতে পারেনা। কারণ তারা ছিল নিরাকার, জড়পদার্থ, সজীব বৃক্ষ, পশুপাখি কিংবা জলচর প্রাণী সমূহ। এখনো কি কথা বলে? মানুষের আদিম অবস্থায় তারা রয়ে গেছে।
দেবতাদের খুশী করার জন্য বা দেবতারা ভক্তদের অনুগত কিংবা দাসানুদাস করে রাখার জন্য যে ভাষা মুখে মুখে প্রচারিত হতো ব্রাহ্মণ্যবাদের দ্বারা তা 'শ্রুতি' বা পরবর্তীতে "বেদ" নামে পরিচিত ধর্মগ্রন্থ। বৈদিক সমাজ যখন আরো কয়েক শতক পেরিয়ে এলো। আর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হল যারা মতাদর্শগত কারণে,তারা হল অনার্য। তাদের সঙ্গে যোগ দিলো এদেশের নিপীড়িত ভূমিপুত্ররা। পরবর্তী সময়ে আর্যদের সঙ্গে উভয়ের অবিচ্ছিন্ন ভাবে - অসম লড়াই চলতেই থাকে। আমরা প্রামাণ্য রূপে পৌরাণিক গ্রন্থ পাই 'রামায়ণ'। বেদের পরিপূর্ণ প্রয়োগে সমাজ ব্যবস্থা হাতিয়ার করে গড়ে উঠল 'মহাভারত'। পরবর্তী সময়ে আঠারোটি 'পুরাণ' রচিত হল। মহাভারত তার মধ্যে একটি।
পূজার্চনার নামে দেব-দেবীর তুষ্টি করার জন্য যেমন স্তুতি করা হতো, ভালো ভালো কথা বলে। এখন তেমনই রইল। তবে সংযোজিত হল যেটা তা হল নির্বাক প্রাকৃতিক বস্তু সমূহের পরিবর্তে প্রশাসনিক মহলের কর্তা-ব্যক্তিরা দেবতার আসনে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করল বা করালো আর্যদের উত্তরসূরিক। বর্তমানের দেবতারা কথায় কথায় আর "বর" দেয় না, ভুয়ো প্রতিশ্রুতি অকাতরে বিতরণ করে জনসভায়। সর্বত্র বিভিন্ন নামে এই দেবতাদের বিচরণ ক্ষেত্র। যাইহোক পৌরাণিক দেবতাদের সময়টাকে পৌরাণিক যুগ বলা হতো। সহজেই অনুমেয় পুরাণ অর্থাৎ প্রাচীন কাহিনী নিয়ে লিখিত বলে 'পুরাণ' বলা হয়।এই সময়ের প্রাচীন ধর্ম বিষয়ক সাহিত্যে প্রাচীন মানে বেদের বা তারও আগের কিংবা আর্যদের ভারতের মাটিতে পা রাখার সময়কাল ভাবতে পারি।
এবার বেশি কথা না বলে শুরুর বক্তব্যে আসা যাক। প্রথমে যা কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। পৌরাণিক কাহিনী বাস্তব না কাল্পনিক। তার অনুসন্ধান করা যাক। আমি যদি আপনাকে বলি পাকা বাড়িটি কী দিয়ে তৈরি,এককথায় বলুন? তাহলে কি শুধুই ইট পাথরের কথা বলবেন। সাধারণ কথায় কাঁচা বা পাকা বলে থাকি। একটু বিস্তারিত বললে বলতেই হবে, আগের গাঁথুনি হলে চুন,সুরকি থাকবে। এখন হলে বালি,সিমেন্ট। এইগুলি বাদ দিতে পারবেন? পাকাবাড়িটির ভিত থেকে শুরু করে বাসোপযোগীর আগে পর্যন্ত যারা অফুরন্ত কায়িক পরিশ্রম দিল তারা কি বাদ? শুধু চালাকি করে বললেই হল- বিশ্বকর্মার অলৌকিক ক্ষমতায় মুহূর্তে বানিয়ে দিল। বোকার মত বিশ্বাস করলেই হল, মেনে নেওয়া অসম্ভব। যদি মানতেই হয় এভাবেই ধরতে পারি। খবরের কাগজে বেরিয়েছিল বেশ কিছু দিন আগে। ফাঁকা মাঠে সকালে উঠে সব্বাই দেখল, কয়েকতলা বাড়ি। কপাট, জানালা বসানো। প্লাস্টার, রঙ করা সম্পূর্ণ বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। এমন উন্নত প্রযুক্তি তখন ছিলনা কে কলতে পারি? যা সাধারণ মানুষ জনের কাছে বিশ্বকর্মার তৈরি। 'যা লৌকিক, তা অলৌকিক হয় না'। ভারতের অতীত এমন প্রযুক্তি ছিল, সাধারণের বোধের বাইরের বলে তা তাদের কাছে অলৌকিক। পৌরাণিক চরিত্র রূপকের মোড়কে বাস্তব, সব কিছু।
বিশেষ অর্থে ভারতের ভূমিপুত্রদের বশে রাখার জন্যে। তাদেরি বিশ্বাসে গড়া প্রাকৃতিক দেবদেবীর সবাক করে তোলা একমাত্র লেখনীর গুনে। এমন কিছু বাস্তব যার মধ্যে বিজ্ঞান আছে। কিন্তু, নিরক্ষর সাদাসিধে সাধারণ মানুষজন, তাদের মনে অন্ধ বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। খুব কৌশলে , চাতুরীর মাধ্যমে যেমন বলা হয়েছে- " শ্রীরামচন্দ্র" যদি ভগবান না হবেন, তাঁর হাতের ছোঁয়ায় "শিলা" ভাসে কী করে? কথাটা ফেলার নয়। পাথর বলে কথা। আচ্ছা আমি যদি আস্ত ইট জলে ভাসাই, পাঠককুল অবাক হবেন নিশ্চিত ! তবে 'ঝামা'-ইট হওয়া চাই। যে পাথর চাঁইটি ভাসতে দেখি- ওই পাথরে অসংখ্য অবরুদ্ধ বায়ুকোষ আছে। ঝামা ইটে তাই থাকে।
আমি প্রমাণ করতে চাইছি না, পাথর ভাসা না-ভাসার ওপর ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের অস্তিত্ব থাকা ন-থাকা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইছি। এই ধৃষ্টতা আমার নেই। আমরা যদি যেকোনো প্রাচীন ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থের কাটাছেঁড়া করে বিশ্লেষণ করি তাহলে নির্মম বাস্তব খুঁজে পাবোই। ধারাবাহিক ভাবে, শোষণ, শাসন, কি ভাবে না পরম্পরায় খোলস পালটে চলে আসছে। ভয়ে বা ভক্তিতে অতি সাধারণ মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে অমানবিক পীড়ন। এবার শেষ কামড়টি বুদ্ধিমান পাঠক দিতে পারবেন। নিবন্ধের শেষ পর্যায়ে যা দাঁড়াল তা হল বাস্তব সত্য অবলম্বনে পৌরাণিক কাহিনী রচিত।
এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে, আধ্যাত্মিক, জন্মান্তরবাদ, পারলৌকিক, মৃত্যুর পরে সূক্ষ্ম দেহে অবস্থান- এই বিষয়গুলির কি সত্য বলে কিছু আছে? সোজা কথায় কায়াহীন কাহিনী কল্পনা করা নিরর্থক। উক্ত বিষয়গুলিতে কোন প্রকার কায়া আবিষ্কৃত হয়নি বলে আমার ধারণা। তবে পাণ্ডিত্যের ঐন্দ্রজালিক মায়া আছে। গোলমালের বিষয় হলে, চিরদিন গোলমাল পাকিয়ে যাবে। এ আর এমন কি? যে যেমন ভাবে যা বিশ্বাস করে করুক না। বিশ্বাস ভাঙানোর দায় আমার ঘাড়ে তো কেউ জোর করে চাপিয়ে দেয়নি।আমি এটাই বিশ্বাস করি, জগতের সমগ্র মানুষের অকল্যাণকর কিছু না হলে, বিভাজন সৃষ্টি করার মতো উস্কানি না থাকলে, আমার অসুবিধা নেই। নিছক বিনোদনের জন্য অনেক কিছু মেনে নিতে পারি। তা ধর্ম রূপে আসুক বা সাহিত্য রূপে। তবে সেই বিনোদন যেন সাহিত্যের মধ্যে উশৃঙ্খলতার জন্ম না দেয়। সাহিত্য সাধকদিগের সজাগ থাকতে হবে- সুস্থ সমাজের কথা মাথায় রেখে, সৃজনশীলতা আরো সচেতন হয়ে।
No comments:
Post a Comment