[সেরা বাংলা গল্প ২০২২]
[১ম সেরা]
[মার্চ শেষ সংখ্যা] [পঠন / দর্শন সংখ্যার ভিত্তিতে বিচার]
প্রকৃতির নীরব যন্ত্রণায় অদৃশ্য অশ্রু
- রূপশঙ্কর আচার্য্য
বাবুর বাড়িতে বহুদিন যাবৎ কাজ করি, তাই একটু বিশ্বাস করে থাকে আমায়। আমি অনেক ছোটবেলা থেকে এই বাড়িতে থাকি। আমার বাবাও কাজ করতো, এখন আমি করি, বিশ্বাস করে আমাকে বাড়ির সব দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। আমার সংসার বলে কিছু নেই, তাই বাবুর বাড়ির সমস্ত কাজ-কর্ম আমি করে থাকি। একটি বাগান রয়েছে বাবুর বাড়ির পাশে। সেই বাগানের বিভিন্ন গাছ রয়েছে। বিভিন্ন ফলের গাছ, ফুলের গাছ। আমার ওই বাগানটিই প্রাণ। আমি নিজে হাতে করে, বাগানটিতে একটি আম গাছ লাগিয়েছিলাম। বিয়ে তো করিনি, তাই ওই আম গাছটিই ছিল আমার সন্তান।
গাছটা ধীরে ধীরে বড়ো হয়েছে। বিভিন্ন গাছেদের সঙ্গে এই গাছটাও বৃদ্ধিলাভ করছে। কিছুদিন বাদে দেখলাম গাছে মুকুল ধরেছে।এই মুকুল দেখে আমার খুব আনন্দ লাগল। আমার সন্তানের ফল আসবে। গাছটিতে একঝাঁক আম দেখতে পাব। গাছটির যে প্রাণ আছে, আমি অনুভব করতে পারি। আমি অনুভব করব, শুধু তো তা হয় না। প্রত্যেক জীবেরই প্রাণ আছে। জীব তো দুধরনের-- প্রাণী এবং উদ্ভিদ। আম গাছটি জীব তো, এর তো প্রাণ থাকবেই। কিন্তু বর্তমানের আধুনিক ও প্রযুক্তির যুগে শিক্ষিত সমাজের মানুষ উদ্ভিদকে বাঁচতে দিতে চায় না। কেউ কেউ লক্ষ্য করি আশেপাশের প্রতিবেশীরা বাগানটিতে বিভিন্ন আবর্জনা এসে ফেলে রেখে যায়। আমি পরিষ্কার করি, সুন্দর করে মন্দিরের মতো করে তুলি। আম গাছটিকে তো অনেক সযত্নে নিজের সন্তানের মতো দেখি। তার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য গাছগুলিকেও যত্ন করি, জল দিই। অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে বাগানেই ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু যখন দেখি এই বাগানে আবর্জনা ফেলা হচ্ছে, তখন আমি প্রতিবাদ করতে যাই। তারা আমার প্রতিবাদে সাড়া না দিয়ে আমাকে ঠেলে ফেলে দেয়। তাচ্ছিল্য করে এবং আমার বাবুকে আমার সম্পর্কে মিথ্যা মিথ্যা করে বিভিন্ন নালিশ জানায়। একদিন এক বাবু এসে বলে রঘুবাবু বাড়িতে আছেন? আমি বেরিয়ে গিয়ে বললাম, বাবু এখন বাড়িতে নেই। কী হয়েছে একটু বলুন না। তিনি বললেন, তোমাদের বাগানের সেই আম গাছটার ডালগুলো আমার বাড়ির জানালার দিকে ঝুঁকে গেছে। আমার ছাদের দিকে এগিয়ে পড়েছে। যত রাজ্যের পাতা আমার ছাদে পড়ে। ঝড় দিলে ডাল ভেঙে ছাদে পড়ে। আমার বাড়ির ক্ষতি করছে। তাই আমি চাই এই গাছটা যেন কেটে দেয়। আমি তার কথা শুনে খুব ভয় পেলাম ও খুব মর্মাহত হলাম। খুব কষ্ট পেলাম। পিতার কাছে সন্তানের হাত পা কেটে দেওয়ার সমান এই কাজ।চোখে জল এসে গেল। বুকটা ধড়পড় করতে লাগল। আমি আর কিছু বলতে, পারলাম না। আম গাছের গোঁড়ায় গিয়ে, ক্লান্ত হয়ে বসে রইলাম। সন্ধ্যের পর বাড়ির বাবু যখন বাড়ি ফিরলেন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন কোনো বাবু আমাকে খোঁজাখুঁজি করছিল। আমি সমস্ত ঘটনা বললাম। বাবু তখন বললেন, শোনো জীবনদা অনেকদিন তুমি আমার বাড়িতে কাজ করছো, তাই তুমি তো সবই জানো। অনেকেই এই গাছটার জন্য আমাকে নালিশ করে। আমি চাইছি, এক লোক দেখে গাছটা কেটে দেব এবং এই বাগানটা পরিষ্কার করে বাড়ি বানাব। আমি আমার বাড়ির মালিকের কথা শুনে, এতটাই কষ্ট পেয়েছি বাইরের যে বাড়ির বাবু এসে নালিশ করেছিলেন, তার থেকে অনেক বেশী কষ্ট পেলাম। আমার বাবা এই বাড়িতে ছোটবেলা থেকে কাজ করতেন, তারপর আমি কাজ করি। আমার বাবা আমার যে নাম জীবন দিয়েছিলেন এই রঘুবাবুর গাছ কেটে ফেলে দিয়ে ফ্ল্যাট বাড়ি বানানোর পরিকল্পনায় এই জীবনের শ্বাস যেন বেড়িয়ে যাচ্ছে। যেন জীবনটাই বেরিয়ে যাচ্ছে।
আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। একদিন হঠাৎ দেখি, ওই গাছটাতে কে যেন, ব্যানার লাগানোর জন্য পেরেক মারছে। আমি রেগে গোলাম। এ কি করছ, এর তো প্রাণ আছে। এর যে যন্ত্রণা,কষ্ট হচ্ছে, তুমি দেখতে পাচ্ছ না।লোকগুলো আমার দিকে তাকিয়ে বলছে বুড়োটার বয়স হয়েছে, মাথাটাও গেছে। আমি তাদের কথায় কান না দিয়ে তাদেরকে ঠেলে ফেলে দিলাম। সামনে যে টিউব-কল ছিল সেই টিউব-কল থেকে, জল এনে ওই গাছটার, ক্ষতস্থানে দিলাম। লোকগুলো হাসতে হাসতে, আমাকে পাগল ভেবে তাচ্ছিল্য করতে করতে চলে গেল। বিকেলে বাবু ডেকে বললেন, কাল লোকজন আসবে গাছ কাটতে। আমি সারারাত ঘুমাতে পারছি না। গাছটার সামনে গিয়ে তাকে বলছি সন্তান আমি তোকে কি করে বাঁচাই?
আমি তো তোকে বাঁচাতে, পারবো না। আমার বয়স হয়েছে, সামর্থ্য নেই। আমি নিজেই আশ্রিত, আমি কি করে তোকে বাঁচাই? আজ আর কোনোকিছুই, আমার মুখ দিয়ে ঢুকল না। জল পর্যন্ত তৃষ্ণা লাগেনি।গাছের গোড়াতেই আমি, ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে,থাকার কারণে বেলা করে, ঘুম থেকে উঠি। দেখি গাছ কাটার পরিকল্পনা নিয়ে দড়ি,কাছি,করাত, সবকিছু নিয়ে হাজির কিছু লোক। গাছ কাটা শুরু হয়ে গেছে। শব্দ শুনে আমি ধড়পড় করে উঠে, প্রতিবাদ করি,ওকে মেরো না, ওকে মেরো না গাছটার সামনে আড় হয়ে পড়ি। আমাকে মালিক অন্য লোক দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি, ছটফট করি,চিৎকার করি।
সকলের পা ধরি, পায়ে খুব করে মাথা ঠুকতে থাকি আর বলি গাছটাকে মেরো না। ও আমার সন্তান। ওকে মেরো না। আমাকে ধরে রাখে দুজন। চোখের সামনে আমি ছটফট, করতে থাকি আর গাছটিও ছটফট করছে। যেন তার চোখ দিয়ে অনর্গল, জল বেরিয়ে পড়ল। করাত দিয়ে গাছটা কাটা হয়ে গেল। আমি আর সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে দুজনের হাতকে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে ছিটকে, দিয়ে গাছের একেবারে সামনে হাজির। তখন গাছটা আমাকে নিয়েই সশরীরে মাটিতে পড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। মরলাম আমি ও আমার সন্তান দুজনেই। আমার কষ্ট আমি চিৎকার করে বলতে পারলাম। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বলতে পারলাম। কিন্তু সেই আমার আম গাছ, সেই আমার সন্তান নীরব যন্ত্রণা নিয়ে মারা গেল। এই নিষ্ঠুর পরিবেশ ভবিষ্যতে অনুভব করতে পারবে একটি গাছ যে একটি প্রাণ তা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। একটি গাছ বহু মানুষের প্রাণ।পৃথিবী শ্রেষ্ঠ জীবরূপে বিচারবুদ্ধিবৃত্তি, সম্পন্ন জীবরূপে পৃথিবীর সমগ্র মানুষের প্রাণ।
No comments:
Post a Comment