[সেরা বাংলা প্রবন্ধ ২০২২]
[৩য় সেরা]
[মার্চ ১ম সংখ্যা] [পঠন / দর্শন সংখ্যার ভিত্তিতে বিচার]
[৩য় সেরা]
[মার্চ ১ম সংখ্যা] [পঠন / দর্শন সংখ্যার ভিত্তিতে বিচার]
তত্ত্বমসি
- সৌম্য ঘোষ
এই যে আমরা জগতকে দেশে ব্যাপ্ত, কালে প্রবাহিত, কার্যকারণ সম্বন্ধে দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে দেখছি -- কান্ট ও শোপেনহৌয়ারের মতে তা' মনের প্রতীতি মাত্র। কেউ বলছেন, জগত মায়া, কেউবা বলছেন, জগত ছায়া। কান্ট বলেন, জগত আমাদের মনের প্রতীতি মাত্র সত্য পদার্থ নয়।
সকলই মায়া। তাহলে কাকে স্বীকার করব? শংকরাচার্য বলেছেন, অস্বীকার করতে গেলে আগে স্বীকার করতে হয়। জীবাত্মা ও পরমাত্মা উভয়কে নিয়েই আমরা দ্বিধাগ্রস্ত। ভারতীয় দার্শনিকরা বলেছেন, জীব ব্রহ্মের অংশ হতে পারে না। কারণ ব্রহ্ম অংশরহিত।
আবার জীবাত্মা ব্রহ্ম থেকে স্বতন্ত্র হতে পারে না। কারণ ব্রহ্ম একমেবাদ্বিতীয়ম! জীব ব্রহ্মের বিকার হতে পারে না। কারণ তিনি নির্বিকার (একথা কান্টও স্বীকার করেছেন)। এই যে ভ্রমাত্মক দ্বিধাগ্রস্ততা, সাধারণ মানুষ হিসাবে আমরা কি সিদ্ধান্তে উপনীত হবো?
জীব ব্রহ্মের অংশ নয়, আবার স্বতন্ত্র নয় --- সুতরাং জীবাত্মা স্বয়ং পরমাত্মা। কোন প্রভেদ নেই। আমার আত্মা যদি স্বয়ং ব্রহ্ম হয়, তাহলে সর্বশক্তিমত্তাও আমার আছে। শঙ্করাচার্যের একটি লেখায় পড়লাম, 'যেমন কাষ্ঠের মধ্যে অগ্নি গোপন থাকে তেমনি এ-সকল শক্তিও আমার মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে মুক্তির পর তা প্রকাশ পায়।'
আবার প্রশ্ন: কেনই বা প্রচ্ছন্ন থাকে?
উত্তর পেলাম: উপাধিসকল এর কারণ। তাহলে উপাধি কি ? মন, ইন্দ্রিয়, প্রাণ ও তার পঞ্চশাখা (চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক) এবং সূক্ষ্ম শরীর। এরাই উপাধি হয়ে জন্মে জন্মে আত্মাকে আবৃত করে থাকে। এইসকল 'উপাধি'র উৎস---- মায়া। আবার মায়া উৎসারিত হয়--- অবিদ্যা থেকে। এই যে আমাদের অজ্ঞানতা, পাপবোধ, দুঃখ এসবের মূল কারণ অবিদ্যা। তবে কি এই দুঃখ-পাপ অজ্ঞানতা থেকে আমাদের মুক্তি নেই?
" অজ্ঞানং কেন ভবতীতিচেৎ? ন কেনাপি ভবতীতি। অজ্ঞানমনাদ্যনির্বচনীয়ং।''
সংসার থেকে যে মুক্তির পথ আছে, তা বেদ এবং বেদান্ত থেকে তুলে ধরছিঃ
বেদের প্রাচীন শ্লোকে প্রথম স্বর্গ, পরে নরকের কথা আছে। কিন্তু পুনর্জন্মবাদ কোথাও দেখা যায় না।
বেদান্তে স্বর্গ-নরক ভোগ এবং পুনর্জন্ম উভয় মতই মিশ্রিত হয়েছে।
বেদান্ত মতে, পুণ্যকারীগণ পিতৃযান প্রাপ্ত হয়ে ক্রমশ চন্দ্রলোকে গমন করেন। সেখানে নিজ সৎকর্মের ফল নিঃশেষ করে পুনশ্চ মর্তলোকে জন্মগ্রহণ করেন। যাঁরা সগুণ ব্রহ্মের উপাসক তাঁরা দেবযান মার্গ প্রাপ্ত হয়ে উত্তরোত্তর ব্রহ্মলোকে গমন করেন। পৃথিবীতে "তেষাং ন পুনরাবৃত্তি।" ব্রহ্মলোকে নির্গুণ ব্রহ্মের পূর্ণজ্ঞান অর্জন করে মোক্ষ প্রাপ্ত হয়। বেদান্তে পাপকারীদের জন্য নরকযন্ত্রণা এবং বারংবার নিচজন্মভোগের উল্লেখ আছে। এই জগত এবং সংসার কেবলমাত্র তাদের কাছেই সত্য যারা অবিদ্যা দ্বারা আচ্ছন্ন। পারমার্থিক বেদান্তমতে, এই জগত এবং সংসার কিছুই সত্য নয়; সত্য কেবল ব্রহ্ম। যিনি আমাদের আত্মারূপে উপলব্ধ।
"আমিই ব্রহ্ম ।" এই জ্ঞানই মোক্ষ। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "যাহার মন সকল অবস্থাতেই সন্তুষ্ট এবং ব্রহ্মে নিবিষ্ট। সমস্ত কামনা যিনি সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিয়াছেন, তিনি মোক্ষলাভ করিতে পারিবেন। জগতের সকলেরই পুনর্জন্ম হয়। কেবল যিনি আমাকে পান তাহার আর পুনর্জন্ম হয় না।"
গীতায় সৎগুণসম্পন্ন সাধক সম্বন্ধে বলা হয়েছে:
" অভিমান শূন্যতা, দম্ভহীনতা, অহিংসা, সহনশীলতা, সরলতা, দেহের ও মনের শুচিতা, মনকে সংযত করা, সকল বিষয়ে বৈরাগ্য, অহংকার না করা, নির্ভীক হওয়া, দানে প্রবৃত্তি, শান্তভাব, সর্বজীবে দয়া,
লজ্জা, নম্রতা, শুচিতা, নিজেকে বড় না করা "।
ফিরে আসি জার্মান অধ্যাপক ডঃ পৌল্ ডয়সেনের কথায়ঃ
তিনি বলেছেন, অনেকেই বেদান্তকে ধর্মনীতিঅংশে অঙ্গহীন বলে দোষ দিয়ে থাকে। তাঁর মতে, উচ্চতম এবং বিশুদ্ধতম ধর্মনীতিজ্ঞান বেদান্ত থেকেই পাওয়া যায়। 'প্রতিবেশীকে নিজের মত ভালবাসতে হবে' -- একথা বাইবেলে বলা আছে। কথাটি সত্য। কিন্তু যখন আমি আমার সমস্ত সুখ-দুঃখ স্বয়ং অনুভব করি, প্রতিবেশীর মধ্যে অনুভব করি না তখন প্রতিবেশীকে কেনই বা নিজের মত ভালবাসবো? বাইবেলে এর কোন উত্তর নেই। এই উত্তর আমরা পাই বেদে। বেদে একটি শব্দে এর উত্তর আছে ---- "তত্ত্বমসি!"
অর্থাৎ তুমিও সে। বেদ বলেছে, তুমি প্রতিবেশীকে স্বতন্ত্র বলে জানালেও, তোমরা এক এবং অভিন্ন। ভগবদ্গীতায় আছে, যিনি আপনার মধ্যে সকলকে দেখেন তিনি 'ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং'। অর্থাৎ আপনার দ্বারা আপনাকে হিংসা করেন না। এটাই সমস্ত ধর্মনীতির সারকথা। এটাই ব্রহ্মজ্ঞানীর প্রতিষ্ঠা স্থল। যিনি নিজেকে 'সবার' বলে জানেন, তিনি নিজের জন্য কিছুই প্রার্থনা করেন না। তিনি সমস্ত জাগতিক সৌন্দর্য নিজের মধ্যেই উপলব্ধি করেন। তাই কারো কোন ক্ষতি করেন না। তিনি মায়া দ্বারা পরিবৃত হয়েও, মায়ায় মুগ্ধ হন না। অবশেষে যখন মৃত্যু তাঁর শিয়রে উপস্থিত হয় "ন তস্য প্রাণা উৎক্রামন্তি।... ব্রহ্ম এব সন্ ব্রহ্ম অপ্যোতি।" তিনি নদীর মতো ব্রহ্ম সমুদ্রে প্রবেশ করেন। এই যে মিলন তা অনন্ত সমুদ্রে জলবিন্দুর মিলনের মত নয়; এ যেন অনন্ত সমুদ্র তুষার বন্ধন মোচন করে নিজের সর্বব্যাপী নিত্য ও সর্বক্ষমস্বরূপে ফিরে যাওয়া।।
আপনার লেখা অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
ReplyDeleteআপনার লেখা পড়ে জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। কিছু শিখি।
এজন্যই আপনার প্রবন্ধ এতখানি মূল্যবান আমার কাছে।
ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই।
ReplyDeleteভালো লাগলো
ReplyDeleteআমাদের স্বীকার করার কিছু নেই আবার অস্বীকার করার ও কিছু নেই। এই চিন্তা বিলাপ না গ্রহণীয় না বর্জনীয়।
ReplyDelete