মুখ ও মুখোশ
- প্রবোধ কুমার মৃধা
Face is the index of mind. ইংরেজি প্রবাদটি বহু প্রাচীন। এককালে বাক্যটির সত্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। তখন অধিকাংশ মানুষ ছিলেন প্রথাগত শিক্ষার বাইরে। প্রকৃতিই ছিল তাঁদের পাঠশালা। মুখ্যু মানুষজন ছিলেন প্রকৃতই সহজ সরল। মন মুখ তাঁদের দু-রকম চিল না। ভাবের ঘরে চুরি করার কৌশলী বিদ্যা রপ্ত করার ক্ষেত্র ছিল অধরা।মনের ভাবনা চিন্তা মুখের মুকুরে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়ে ফুটে উঠত। তারপর সময় যত গড়িয়েছে, নিয়ত পরিবর্তনশীল বিশ্বে সভ্যতা যত এগিয়েছে; প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত সুসভ্য মানুষ ততই ছল চাতুরির অনুশীলন ঘটিয়ে বহুরূপী গিরগিটির ন্যায় ক্ষণে ক্ষণে আপন স্বরূপ বদলের কলাকৌশল আয়ত্ত করেছেন। নিজেদেরকে মুখোশের আড়ালে রেখে মনের অভীষ্ট সাধনের মহড়া ক্ষেত্রের মঞ্চ বানিয়ে স্বার্থ সিদ্ধির জাল বুনেছে।
বর্তমান প্রেক্ষিতে old আর gold পরিচয় বহন করতে সর্বৈব সক্ষম নয় ।সমাজ সভ্যতার বিবর্তনের ধারায় বহু পুরাতন আজ অবলুপ্ত, অস্তিত্ব বাঁচিয়ে টিকে থাকার সংখ্যা খুবই সীমিত। পুরাতনের বক্ষ টুটে নিত্য নূতনের আবির্ভাব ঘটছে; পুরাতনের মেলা সমাপনান্তে শুরু হয়েছে নূতনের খেলা । বদলে যাচ্ছে মুখের রূপ, মুখোশের অন্তরালে ওত পেতে আছে হিংস্র হায়নার লোলুপ জিহ্বা। বিকৃত মনের. পরশ্রীকাতরতা লুকোতে দেঁতো হাসির চাতুরিভরা মুখোশের আড়াল খুঁজে নিতে হচ্ছে ।এমন কি মায়ের মুখের মধুর হাসির স্নিগ্ধতা আজ আর সর্বব্যাপ্ত সুলভ নয়; স্বার্থের ভাগাভাগিতে তা আজ দ্বন্দ্বদীর্ণ। সে রাম ও নেই, সে অযোধ্যা ও নেই।সেকালের পাটলিপুত্র আজ পাটনা। এমন প্রমাণ আছে অজস্র।
মুখ দেখে দুখ যেমন চেনা যায় না; তেমনি মুখ দেখে মনের গভীরে চিন্তার রূপরেখার পরিচয় সন্ধান দুষ্কর। বৈদিক যুগে গুরুকুল বা আশ্রমিক শিক্ষার মুখ্য সিলেবাস ছিল শিক্ষার্থীকে সৎ এবং নিষ্ঠাবান মানুষ রূপে গড়ে তোলা ।চতুরাশ্রম জীবন ধারায় কীভাবে সর্বজন হিতায়, সর্বজন সুখায় মন্ত্রে মনুষ্য জীবনকে চালিত করার দীক্ষা গ্ৰহণ করা যায়,আশ্রমিক শিক্ষা কেন্দ্রগুলি ছিল তারই পীঠস্থান।যুগের প্রেক্ষিতে তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তৎকালে আয়োজন ছিল স্বল্প ,প্রয়োজন ও ছিল অল্প। 'আরো চাই, আরো দাও', এই অন্তহীন চাহিদা রূপ স্বর্ণ মৃগের পিছনে মনুষ্য কুলকে সারাক্ষণ ছুটে চলার নেশায় উৎসাহিত করত না।আবাদ-বিবাদ-সুবাদ সকলই ছিল, আর তা ছিল তাঁদের প্রাত্যহিক জীবন ধারার অঙ্গস্বরূপ। তৎসত্ত্বেও ছোট ছোট কুটিরগুলি ছিল এক একটা শান্তির নীড়।
সে অতীত আজ ইতিহাস। তা আজ স্মৃতির খোরাক।বর্তমান জীবন যাত্রা তার চার পাশে গড়ে তুলেছে বাসনা-কামনার স্বপ্ন-সৌধ, বেড়েছে তার ঐশ্বর্য, বেড়েছে তার প্রাচুর্য। অহং সর্বস্ব ভোগবাদী জীবন দর্শন মানুষকে ত্যাগের গরিমা ভুলিয়েছে; নিমজ্জিত করেছে স্বার্থের পঙ্কিল কূপে।অল্পে তাঁর সুখ নাই, অন্যের ভাগ না পেলে তাঁর শান্তি নাই। দুর্বলের অস্ত্রস্বরূপ পরকালের ভয় নাই! নিস্তরঙ্গ জীবন যাপনে তাঁর আনন্দ নাই!
No comments:
Post a Comment