[সেরা বাংলা প্রবন্ধ ২০২২]
[২য় সেরা]
[মার্চ ১ম সংখ্যা] [পঠন / দর্শন সংখ্যার ভিত্তিতে বিচার]
[২য় সেরা]
[মার্চ ১ম সংখ্যা] [পঠন / দর্শন সংখ্যার ভিত্তিতে বিচার]
বসন্ত উৎসব
- প্রবোধ কুমার মৃধা
আমাদের ঋতুচক্রের কনিষ্ঠ ঋতু বসন্ত।ঋতুরাজ বসন্ত। শীতের জড়তা কাটিয়ে রিক্ত প্রকৃতি আবার প্রাণস্পন্দনে মুখরিত হয়ে ওঠে। কোকিলের কুহুতান, মধুকরের গুঞ্জন, সুরভিত কুসুমের সুগন্ধ বসন্ত আগমনের বার্তা ঘোষণা করে।পঞ্জিকা অনুযায়ী বসন্ত কাল শুরু হয় ফাল্গুন মাসে।
'এত দিন যে বসে ছিলেম
পথ চেয়ে আর কাল গুনে
দেখা পেলেম ফাল্গুনে।'
ধরার বুকে ফাগুন আসে নবীন আনন্দের ডালি নিয়ে। খুলে যায় দখিন দুয়ার, মনে মনে বনে বনে রঙ লাগে: 'রঙ লাগালে বনে বনে...।'
অথবা
'তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে,'
উৎসবের অর্থ হলো, ঐতিহ্যগত ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠেয় সামাজিক আনন্দ অনুষ্ঠান ।বসন্ত কালে বেশ কয়েকটি উৎসব বা পার্বণ দিন অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গে।যেমন, বসন্ত পঞ্চমী বা দেবী সরস্বতীর বন্দনা, মহা শিবরাত্রি, দোলযাত্রা ও হোলি, বাসন্তী দুর্গা পূজা, নীলকণ্ঠ শিবের নীল উৎসব, গাজন,চড়ক প্রভৃতি। তবে এত সবের মধ্যে দোল উৎসব বা দোলপূর্ণিমা শ্রেষ্ঠ উৎসব রূপে বসন্ত উৎসবের শিরোপা লাভ করেছে।
ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে হয় দোলযাত্রা। বহির্বঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় হোলি, দোলযাত্রার ঠিক পরের দিন।দোলযাত্রা এবং হোলি পরষ্পর পরিপূরক।
হিন্দু বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুযায়ী ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির গুলাল সহযোগে শ্রীমতী রাধিকা এবং অন্যান্য গোপী গণের
সাথে রঙের খেলায় মেতে ওঠেন। এই আনন্দ উৎসবের ঘটনা থেকে দোল খেলার উৎপত্তি।এমনি এক ফাল্গুনী পূর্ণিমায় জন্ম গ্ৰহণ করেছিলেন প্রেমের ঠাকুর অবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। ক্ষেত্র বিশেষে তাই ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিকে গৌর পূর্ণিমা বলা হয়ে থাকে।
দোল পূর্ণিমার আগের দিন বাঁশ-খড়-কাঠ ইত্যাদি জ্বালিয়ে বহ্ন্যুৎসবের আয়োজন করা হয়। একে বলা হয় হোলিকা দহন বা নেড়া পোড়া। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর ভগিনী হোলিকার অগ্নি দহনে মৃত্যুর কারণে এই নাম করণ।বঙ্গে এই পর্বকে অন্য নামে চাঁচড় বলা হয়।
দোল উৎসব রঙের উৎসব।যৌবনের প্রতীক রাধা-কৃষ্ণের মিলনের উৎসব।যৌবনের জয় গানের উৎসব। পরমাত্মা ও জীবাত্মার মহামিলনের মহোৎসব। উৎসবের সামিল হন আবাল -বৃদ্ধ -বণিতা। আবির এবং রং দিয়ে পরষ্পর পরষ্পরকে রাঙিয়ে দেন।নানা ধর্মের নানা সম্প্রদায়ের মানুষ এই বসন্ত উৎসবে অংশ নিয়ে থাকেন। অনাবিল আনন্দ আর যৌবনের প্রাণ-প্রাচুর্যে ছন্দিত হয়ে ওঠে প্রেমিক--প্রেমিকার হৃদয়। দোল উৎসবের প্রাণ কেন্দ্রে আছে রাধা-কৃষ্ণের লীলা বৈচিত্র। ভক্ত আর ভগবানের মিলন মাহাত্ম ।
দোলযাত্রা উপলক্ষে বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বহু কাল যাবৎ। তার মধ্যে রাঙামাটি বীরভূমের শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত বসন্তোৎসব আন্তরিকতায় ,আড়ম্বরে ,স্বকীয় গৌরবে,আক্ষরিক অর্থে শ্রেষ্ঠ বসন্ত উৎসব। শান্তিনিকেতনে পালিত অন্যান্য ঋতু উৎসবের মতো এটি ও একটি ঋতু উৎসব।নৃত্য ও গীতের মধ্য দিয়ে বসন্ত উৎসব পালনের রীতি চলে আসছে রবীন্দ্র নাথের সময় কাল থেকে। ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে বসন্ত পঞ্চমী উপলক্ষে আম্রকুঞ্জে যে উৎসবের সূচনা হয়েছিল কবি পুত্র বালক শমীন্দ্র নাথ ঠাকুরের হাত দিয়ে।(১১ বছর বয়সকালে যার অকাল প্রয়াণ ঘটে)! দিনে দিনে সেই উৎসবের গরিমা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। অগণিত জন সমাগম হয় এই বসন্ত উৎসব উদযাপন প্রাঙ্গণে । উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উপস্থিত সবাই।
'ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল,লাগল যে দোল।' গানটি দিয়ে সমবেত নৃত্যের তালে তালে শুরু হয় প্রভাত ফেরি।তারপর সারাদিন চলে গানের তালে তালে নাচের অনুষ্ঠান। সে এক উদ্দাম আবেগ আর আনন্দঘন দুর্লভ মুহূর্তের সৃষ্টি হয় সারা অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ ঘিরে।আবিরের রঙে রঞ্জিত হবে ওঠে আশ্রম প্রকৃতির ধূলিকণা থেকে বৃক্ষরাজি।উপস্থিত অগণিত আবেগ মথিত অন্তর থেকে ধ্বনিত হয়,
'...রঙে রঙে রাঙিল আকাশ
গানে গানে নিখিল উদাস
যেন চলচঞ্চল নব পল্লবদল
মর্মরে মোর মনে মনে ।।
ওরে ভাই , ফাগুন লেগেছে বনে বনে।
ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে,
আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে।।'
সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসে।উৎসবের আনন্দে কোন বিরাম নেই।তখন ও আশ্রমের আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বণিত হয়ে চলেছে,
'রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে-
তোমার আপন রাগে ,তোমার গোপন রাগে,
তোমার, তরুণ হাসির অরুণ রাগে,
অশ্রু জলের করুণ রাগে।।
রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে,
-----------------তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও
যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে,
কাঁদন বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে।।'
বসন্তের আগমন উপলক্ষে বসন্ত উৎসব বহির্বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে পালিত হয়। ভারত ছাড়া চীন, ফ্রান্স, জাপান, থাইল্যান্ডস, বাংলাদেশ প্রভৃতি একাধিক দেশে স্ব স্ব ঐতিহ্য এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে নানান আঙ্গিকে এই বসন্ত উৎসব পালন করা হয় সাড়ম্বরে সমারোহে।
No comments:
Post a Comment