[প্রবন্ধে দ্বিতীয় সেরা]
[ফেব্রুয়ারি ১ম সংখ্যা] [পঠন / দর্শন সংখ্যার ভিত্তিতে বিচার]
[ফেব্রুয়ারি ১ম সংখ্যা] [পঠন / দর্শন সংখ্যার ভিত্তিতে বিচার]
আরশি নগরের পড়শি
- সৌম্য ঘোষ
বেদান্ত-দর্শন সম্বন্ধে ডঃ পৌল্ ডয়সন্ সাহেবের মতে, আধুনিক ভারতবর্ষে অধিকাংশ প্রাচীন দর্শনের কেবল ঐতিহাসিক গৌরবটুকু আছে মাত্র। যথার্থ সাংখ্যমতাবলম্বী অল্পই দেখা যায়। এই অভিমত কতটা যথাযথ সেটা চিন্তাশীল পাঠকেরা বিচার করবেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, এখনো প্রত্যেক চিন্তাপরায়ন মানুষের হৃদয়-মন জীবন্তভাবে অধিকার করে আছে বেদান্ত। শংকরাচার্য, রামানুজ, মাধ্ব, বল্লভ, স্বামীজী প্রভৃতির বিশিষ্টাদ্বৈত, দ্বৈত এবং শুদ্ধাদ্বৈত নানারূপে বেদান্ত দর্শনের ভিন্ন ভিন্ন রূপান্তর আমরা পেয়ে থাকি।
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বেদ-উপনিষদ-পুরাণ সম্পর্কে সম্যক চর্চার ফসল সেভাবে আমরা পাইনা। শঙ্করাচার্য উপনিষদকে ধ্রুব স্বরূপ গ্রহণ করেছিলেন। সেজন্য উপনিষদের বিরুদ্ধ মতের সাধনপূর্বক একটি সুসংহত দর্শনশাস্ত্র প্রণয়ণ করা আর হয়নি। উপনিষদের বিভিন্ন স্থানে ব্রহ্মকে নানাপ্রকারের রঞ্জিত করা হয়েছে। কোথাও তিনি অনির্বচনীয় ও মনের অগম্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আবার কোথাও বলা হয়েছে, ব্রহ্মা জগত সৃষ্টিকর্তা। ব্রহ্ম ছাড়া আর সমস্তই মায়া। শঙ্করাচার্য উপনিষদের দর্শনকে দুটি স্তরে ভাগ করেছেন। একটি নিগূঢ় দার্শনিক, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Esoteric অর্থাৎ সগুণা বিদ্যা বা পারমার্থিক অবস্থা। এই বিদ্যা সর্বকালেই অতি স্বল্প সংখ্যক জ্ঞানীর ধারণাগম্য। দ্বিতীয়টি, ধর্মতত্ত্ব বা ব্যবহারিকী অবস্থা। ইংরেজিতে Exoteric . এটার সর্বসাধারণের জন্য। যারা রূপ চায়, স্বরূপ চায় না। যারা পূজা করে, ধ্যান করে না।
আমরা যারা শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আলোকে আলোকিত, ব্রহ্মা সম্পর্কে আমরা একটি ভিন্ন ধারণায় অবস্থান করি। ব্রহ্মা অর্থাৎ পরমাত্মা নির্গুণানন্দ। এই সগুণা বিদ্যার সঙ্গে পরমাত্মার নির্গুণা বিদ্যার সম্পূর্ণ প্রভেদ। ব্রহ্ম মানুষের বাক্যমনের অতীত এটাই মূল সূত্র। ব্রহ্মার সঙ্গে গুণের আরোপ করা হলে তাঁকেই খর্ব করা হয়। গুণের সীমা সংকীর্ণ।
"যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।
অবিজ্ঞাতং বিজানতাং বিজ্ঞাতমবিজানতাম্।।"
অর্থাৎ নেতি নেতি। ব্রহ্মাকে জানতে যত চেষ্টা , যত বাক্য সৃষ্টি বা প্রয়োগ সবকিছুর একটি উত্তর -- "ইহা নহে, ইহা নহে।" ('বৃহদারণ্যক উপনিষদ')
রাজা বাষ্কলির প্রশ্নের উত্তরে ঋষি বাহ্ব বলেন, 'পরমাত্মা শান্ত।'
তিনি সম্পূর্ণ রূপে সমগ্রত আমাদের আত্মারূপে আছেন। জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের সেই একই বক্তব্য। আমরা যখন প্রতীয়মান জগত সংসার থেকে অন্তরের গভীরতম হৃদয়প্রদেশে প্রবেশ করি সেখানেই ব্রহ্মে এসে উপনীত হই। বাউল দর্শন, সহজিয়া দর্শন, সুফিতত্ত্ব সেই একই কথা বলে। মূল এক, উপায় ভিন্ন ভিন্ন। এখানেই আবার পরমহংসদেবের সেই অমোঘ তত্ত্ব "যত মত, তত পথ"। মূলের সাথে মিলিত হতে চাইলে তাঁকে পেতে হবে জ্ঞানের দ্বারা নয়, অনুভবের দ্বারা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, "জ্ঞানে জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় --- উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ থাকে; পরন্তু অনুভবে উভয়ে সম্মিলিত হইয়া যায়।" (ঋণ: "রবীন্দ্র রচনাবলী: পঞ্চদশ খন্ড: পৃ:৭৬২)
জগত্তত্ত্বে ব্রহ্মা কর্তৃক তাঁর সৃষ্টির কাহিনীর বিচিত্র সব কল্পনার বর্ণনা রয়েছে। শঙ্করাচার্যও তাই বলেছেন। কিন্তু একজন অনুসন্ধিৎসু পাঠক হিসাবে প্রশ্ন জাগে --- ব্রহ্মা কেন অচানক বস্তুজগৎ সৃষ্টি করলেন? জগত্তত্ত্বে বর্ণিত বস্তুজগতের সৃষ্টি যে যুক্তি ও বিজ্ঞান বিরোধী তা-ই নয়, বেদান্তের একটি প্রধান মতেরও বিপরীত। শঙ্করাচার্য বলেছেন, সৃষ্টি কেবল একবার হয় নি। অনন্তকাল ধরে ব্রহ্মের দ্বারা সৃষ্টি হচ্ছে এবং লয় পাচ্ছে। সুতরাং কোনো সৃষ্টিকেই 'আদি সৃষ্টি' বলা যায়না। এখানেই প্রশ্ন আসে মনে, ব্রহ্মা কেন সৃষ্টি করলেন? এই সৃষ্টির কারণ বা উদ্দেশ্যটাই বা কি? কেবল নিজের গৌরব প্রচারের জন্য? তাঁর নিজের খেলার জন্য? জীবের প্রতি প্রীতি পূর্বক? অসংখ্য জীবকে সৃষ্টি করে অনন্ত দুঃখে নিমগ্ন করার মধ্যে প্রীতির কোন্ লক্ষণ দেখা যায়?
বেদান্ত বলেছে, নির্গুণ বিদ্যা থেকে সগুণ বিদ্যা যত দূরে অবস্থিত, সত্য থেকে এই সংসার তত দূরে। অর্থাৎ নির্গুণ বিদ্যার মধ্যে রয়েছে অনন্ত সত্য। পারমার্থিক বেদান্ত রূপগুণাতীত বিশুদ্ধ সত্যের সন্ধানে নিযুক্ত। পারমার্থিক বিদ্যায়
জগৎ 'মৃগতৃষ্ণিকাবৎ' মায়ামাত্র। ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছুই নেই। এটাই একমাত্র সত্য। এই সত্য তর্কের দ্বারা নয় অনুভবের দ্বারা জানতে হয়। তবুও নিরুত্তর থাকে এই প্রশ্ন, কেন তবে জীবকুলের সৃষ্টি? সংসার-জগতের সৃষ্টি? আদৌও কি এর প্রয়োজন ছিল? জীবকুলকে এই শ্বাপদ জগতে এনে প্রতিপদে বিপদ-দুঃখ-বেদনা- যন্ত্রণা-খিদে-তৃষ্ণায় কাতর করে 'অনন্ত সত্য' কোন্ শিক্ষা দিতে চাইলেন? বেদান্ত বলে, "সংসারস্য অনাদিত্বম্"।
মানুষ উদ্ভিদের মত। অল্প অল্প করে বেড়ে ওঠে অবশেষে লয়প্রাপ্ত হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ লয় হয় না। উদ্ভিদ যেমন মরার আগে বীজ রেখে যায়, তেমনি মানুষ মৃত্যুকালে আপন কর্ম রেখে যায়। সেই কর্ম পরজন্মে অঙ্কুরিত হয়। কোন জন্ম প্রথম নয়, অন্তও নয়। এটাই হলো পুনঃসৃজন।
ভারতীয় দর্শন এই মত পোষণ করে।
ভারতীয় মনীষীগণ এবং গ্রীক তত্ত্বজ্ঞানী প্লেটো-র অভিমত, জগত ছায়ামাত্র; সত্য এর আড়ালে অবস্থান করছে। শঙ্করাচার্য বলেন, 'জগত মায়া'; প্লেটো বলেন, 'জগত ছায়া'; কান্ট বললেন, 'জগত আমাদের মনের প্রতীতি মাত্র সত্য পদার্থ নয়'। গ্রীক এবং ভারতীয় দর্শন আত্মপ্রত্যয় দ্বারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রমাণ করতে পারেননি। এই অভাব পূরণ করেন জার্মান পন্ডিত ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) এবং তাঁর প্রধান শিষ্য শোপেনহৌয়ার (Schopenhauer)। মানবমনকে বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখিয়েছেন, বাহ্য জগৎ প্রকৃতপক্ষে বাহ্য সত্তার অনাদি অনন্ত ভিত্তিভূমি নয়; তা আমাদেরই বুদ্ধিবৃত্তির ছাঁচ মাত্র। অনাদি অনন্ত আছে আমাদের মনের মাঝে।
মন গেয়ে ওঠে লালন শাহ্-র গানে-সুরে। সবকথা যে তিনি বলেই গেছেন:
"বাড়ির কাছে আরশী নগর
(একঘর) সেথা পড়শী বসত করে-
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।।
গেরাম বেড়ে অগাধ পানি
নাই কিনারা নাই তরণী পারে,
বাঞ্ছা করি দেখব তারে
(আমি) কেমনে সেথা যাই রে।।
কি বলব পড়শীর কথা,
হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা নাই-রে
ক্ষণেক থাকে শূণ্যের উপর
(ওসে) ক্ষণেক ভাসে নীরে।।
পড়শী যদি আমায় ছুঁতো,
যম যাতনা সকল যেতো দূরে।
সে আর লালন একখানে রয়-
(তবু) লক্ষ যোজন ফাঁক রে।।"
Excellent, Super.
ReplyDeleteঅসাধারণ একটি প্রবন্ধ। অনেক কিছু জানলাম। খুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteExcellent essay.
ReplyDeleteঅসামান্য জ্ঞান থাকলেই এমন তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা সম্ভব। 'শব্দদ্বীপ'-কে ধন্যবাদ জানাই।
ReplyDelete