মাঠকুটির (পর্ব ১)
- শওকত নূর
শীতের প্রায় বিকেলই কম বেশি কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে উঠত। কিছু কলাই, যব, গম সরিষার পর কতেক শন কাঁটা গুল্মের মাঠ পেরিয়ে নদীর অর্ধেকটা নজরবন্দী হলেও বাকি অর্ধেকটা থেকে ওপারের বালুচর-গ্রাম কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যেত, বেলা পাটে নামতেই। মাঝমাঠের কুটিরটিকে সূর্যাস্তপর ভূতাস্তানা বলে প্রায় লোকেরই ভ্রম হত। যুবক টিংকু শাহরিয়ার ও তাদের বাড়ির ভৃত্যরা দূরের মটরশুঁটি খেতের দেখভালে থেকে কুটির ও তার বাসিন্দাদের নিয়ে নানা আলাপচারিতায় লিপ্ত হত । আলাপে বাসিন্দাদের অসামাজিক হবার বিষয়টিই সারবস্তু হয়ে উঠত। তারা দূরাগত নবীন। এখানে জমি থাকা সূত্রে দূরবর্তী জ্ঞাত/ অজ্ঞাত গাঁ থেকে বছর কয়েক আগের এক ফাল্গুনে এসে এখানে শনছাওয়া কুটিরটি তুলেছেন। প্রথমে স্বামীস্ত্রী দুজন এসেছিলেন, পরে সংখ্যা বৃদ্ধিতে চার এ দাঁড়িয়েছেন। জনশ্রুতিতে পুরুষটি চির-পীড়িত, ঘরবন্দী ; স্ত্রীলোকটি বহির্গামী হলেও কারো সাথে মেশেন না, কথা বলেন না। এক দুর্ভেদ্য রহস্যময়তা যা তাদের ঘিরে রেখেছে তা উন্মোচনে কারো প্রয়াস উদ্যোগ না থাকলেও তাদের নিয়ে সমালোচনার কমতি নেই। একটি বিন্দুতে এসে প্রত্যেকে অবশ্য সমালোচনায় থতমত খেয়ে থাকে । তা হচ্ছে স্রীলোকটির অসাধারণ রূপ সৌন্দর্য। বলতে গেলে অপরূপা অতুলনীয়া তিনি । ঢেকে ঢুকে চললেও বিষয়বস্তু কারোরই নজর এড়ায়নি।
সূর্যাস্তে কুটিরে কেরোসিনের যে কুপি জ্বলে তার আলোয় হয়তো ভেতরটা আলোকিত হয়, বাইরে তার কিঞ্চিৎ রেশ এসে বড়জোর পেছনের নতুন বেড়ে ওঠা ফলদ গাছটিকে ভৌতিক করে তোলে। তারই তলে স্ত্রীলোকটি কিছুক্ষণ দাঁড়ান। কিছু ভাবেন কিংবা প্রাণ ভরে শ্বাস নেন। ভৃত্যদের সাথে টিংকু শাহরিয়ার অদূরের পথ ধরে বাড়ি ফেরে। ভৃত্যরা একই গান প্রতিদিন গলা চড়িয়ে গায়ঃ
শীত গেলে বসন্ত
ওইনা আইলোরে
সামনে ফাল্গুন মাস
বিরহীনির মনের আগুন
হায়রে জ্বলে বারো মাস।
কুটিরের পেছন থেকে ছায়াবয়বটি দ্রুত সরে গেলে ভৃত্য কণ্ঠগুলোতে ত্বরিত শ্লথগতি আসে। শীত-হাওয়া চড়া হতে থাকে। তাদের কণ্ঠগুলোও মৃদুতর হওয়ার সাথে ক্রম কম্পনবৃদ্ধিতে একসময় স্তব্ধতায় নামে। টিংকু শাহরিয়ার আশৈশব কৌতুহলপ্রিয়। মানুষের বিচিত্র আচরণ, মুখচ্ছবি, বিবিধ কর্মকাণ্ডে তথা তাবৎ রহস্যময়তায় সহজ -স্বতঃস্ফূর্ত মস্তিষ্কপাতে ডুবে থাকার প্রবণতা আছে তার । কী এই কুটির তথা কুটিরবাসীদের বৃত্তান্ত হালহকিকত, কী চাওয়া পাওয়া, কীইবা ব্যগ্র সঙ্গী ভৃত্যদের মনের একান্ত গোপন কথা, তা তার মনে কৌতূহল জাগায়। কৌতূহল অপ্রকাশে সে নিশ্চুপ হাঁটে, ভৃত্যদের কথায় কান রাখে, স্ত্রীলোকের রূপ সৌন্দর্য নিয়ে তাদের হাহাকারি বাক্যালাপে ভেতরে আন্দোলিত হয়। সে ভাবে, কুটিরবাসীদের রহস্যটি ভেদ করা কঠিন কিছু নয়, কিন্তু কে যায় তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে তথ্য উদঘাটনে? কেন তারা পৈতৃক নিবাস ত্যাগে দূরাঞ্চলের ফাইটা মাঠবাসিন্দা হয়েছেন, কেনইবা ফাইটা বসবাসকে উৎকৃষ্ট ধরে লোক সান্নিধ্য এড়িয়ে চলেন, সে তথ্যোৎঘাটনে নাক গলানো সহজসাধ্য, তবে তা কতটা শোভন অশোভন তার পরিমাপ অনেকটাই জটিল। তাদের আগমন হেতু ও ফাইটা জীবন প্রীতি নিয়ে নানা জনশ্রুতি নিত্য বাতাসে ওড়ে। তার সত্যাসত্যে থাকে বিতর্ক। ফলে রহস্য হয়ে ওঠে ধোঁয়াচ্ছন্ন। টিংকু শাহরিয়ার তা ভেদ করতে নারাজ। ফলে স্ত্রীলোকটি পথেঘাটে দু চারবার তার মুখোমুখি হলেও চলমান নৈঃশব্দ্যে ব্যত্যয় আনেনি সে। প্রতি সন্ধ্যায় সে নির্বাক ভৃত্যদের সাথে হেঁটে বাড়ি পৌঁছে যায়। বিষয়বস্তু পথেই ঢাকা পড়ে থাকে।
গাছপালা প্রকৃতি, বিশেষত বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত আশৈশব টিংকু শাহরিয়ারকে বিচিত্র অনুভূতিতে প্রভাবিত করে এসেছে । এই যে এখন শীত শেষের গম কলাইয়ের ক্ষেত - সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা বিকেলে, আলোয় অথবা অন্ধকারে, কখনো শীত ভেজা বৃষ্টিতে তার মনে তা বিচিত্র ভাবের উদ্রেক ঘটায়। এইসব প্রাকৃতিক নিয়ামক ঘিরে আশৈশব তার রয়েছে অসংখ্য খেয়াল কিংবা শখের কাজের ফিরিস্তিও। ঘুড়ি ওড়ানো, বাঁশি বাজানো, আলে বসে ছবি আঁকা, বই পড়া, পাখি কিংবা খরগোশ সেজে ঘন ফসলে পালানো, এমনই নানা কিছু। স্কুল জীবনের প্রায় শেষ দিকে এসে এই কলাইবনের সাথে যুক্ত হয়েছে লড়াইয়ের ষাঁড় চড়ানোর মতো অদ্ভুত এক খেয়াল। কলাইয়ের ক্ষেতে এই ষাঁড় চড়ানোর কাজটি নাকি আবার মোক্ষম হয় ভোর রাতের দিকে। গজ উঁচানো , চোখা শিঙো ষাঁড় শীতে কাঁপতে কাঁপতে ভোর রাতের কুয়াশাচ্ছন্ন কলাইয়ের বনে যদি চড়ে তো সেই ষাঁড় হবে মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী - সব ভৃত্যের এই অভিমত। ভৃত্য নেমক আলী এই মতে প্রবল বিশ্বাসী, আগ্রহী, নিষ্ঠাবান ও নিবেদিতপ্রাণ। বিষয়টি টিংকু শাহরিয়ারকেও বেশ পেয়ে বসেছে। কলাইবনে ষাঁড় ছেড়ে দিয়ে নেমক আলী প্রায়ই প্রাকৃতিক কিংবা অন্য কোনও কাজে দূরে কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়। টিংকু শাহরিয়ার আলে দাঁড়িয়ে মুক্ত হাওয়ায় হাত পা ছোঁড়ে, উঠবস করে অথবা বার শতেক বুকডন দেয়।
সে রাতটা সম্ভবত ছিল পূর্ণিমার। নেমক আলী যথারীতি উধাও। টিংকু শাহরিয়ার প্রায় কুয়াশাহীন ঝকমকে তথা কাঁচস্বচ্ছ আলোয় তার রুটিন কাজ করছে। হাত পা ঘোরানোর ফাঁকে সে থেকে থেকে দৃষ্টি ছোঁড়ে দূরাকাশের চাঁদে ও দিকবিস্তারী মাঠালোয়। তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আবেশে থেকে থেকে সে কিছুক্ষণ করে থেমে থাকে। আবারো হাত পা ছোঁড়ে, লেফট রাইট করে। লেফট রাইটের এক ফাঁকে হঠাৎই সে চমকে ওঠে। কেউ অকস্মাৎ কথা বলে উঠেছে পেছনে। কণ্ঠটা মেয়েলি। কে কথা বলল? কম্পিত বুকে অপ্রস্তুত থমকে দাঁড়ালো সে। আবারো কণ্ঠটা অস্ফুট তার কানে উঠলো, ছোট মিয়া!
বিস্তর ভয় ঢুকেছে টিংকু শাহরিয়ারের মনে। এমন অচেনা, সুরেলা অশ্রুতপূর্ব সম্বোধন! কে এমন সময়ে ডাকে? স্থান কাল পাত্র ও অন্যান্য: মাঝমাঠ, শেষরাত, নারীকণ্ঠ, সীমাবদ্ধ কুটিরবাসীগন! বাস্তব সম্ভাব্যতায় বলোচ্য বিষয়টি স্বাভাবিক ঘটনার আওতায় একেবারে পড়ে না। পেছনে তাকিয়ে কোনও অবাস্তব ভয়ংকর দৃশ্যে জ্ঞান হারাবার ভুলটি করে বসবে কি সে? হার্ট এ্যাটাকও তো হতে পারে। বছর দুই আগে পাশের গাঁয়ের কে একজন শেষরাতে ষাঁড় চড়াতে গিয়ে দৈত্যবেশী ষাঁড়ের গুঁতোয় প্রাণ হারাতে বসেছিল। তাদের ষাঁড়টি তো দিব্যি কলাই চিবানোতে ডুবে আছে। পেছনে খানিকটা দূর থেকে প্রথম কথার উচ্চারণটি হয়েছিল। এখন পদশব্দ অতি ধীরে এগিয়ে আসছে। এ নিশ্চয়ই অপার্থিব কিছু। দৌড়ুবে সে? নির্ঘাত ! দৌড়ালে যেতে হবে সামনে তথা বাড়ি থেকে উল্টো পথে। অতএব, ভয়ংকর বিষয় হলে মারা পড়বে সে নিঃসন্দেহে। তবুও ---, তাছাড়া আর পথ কী?
এরই মধ্যে কণ্ঠটি আবারো উচ্চারিত হল, ছোট মিয়া, কী, ভাবতেছেন? ভয় পাইলেন? আমি মানুষ। ভূত প্রেত, জ্বীন পরী না।
কে? কম্পমান বুকে-পায়ে ফিরে তাকায় টিংকু শাহরিয়ার। আশ্চর্য হয়। আবির্ভূতার মুখমণ্ডল যতটা আচ্ছাদন-আচ্ছন্ন থাকার কথা, তা নেই। খানিকটা মুক্ত নিরাভরণা বলা চলে। চাঁদের আলোয় চাঁদমুখ বিস্ফারিত হওয়া স্বাভাবিক হলেও তা রীতিমত বিষণ্ণ, বিধ্বস্ত। টিংকু শাহরিয়ার থতমত দাঁড়ানো।
ক সেকেন্ডের বিরতির পর আবারো মুখ খুললেন তিনি, তবে মাথানিচু।
ছোটমিয়া, খুব বিপদে পইড়া আসছি। একটু শুনবেন?
জি বলুন।
আমার সাথে একটু যাবেন?
কোথায়? কেন?
বাড়িতে।
কেন?
আমার সে জানি কেমন করতেছে। নিরুপায় হইয়া আসছি। কই যাব? কথা হয়নাই কোনদিন। আপনে আমার ছোট মিয়ার মতো। তাদের বাড়িতে এইরকম একজন আছে। তাই ভাবলাম --
কী হয়েছে ওনার?
হয়তো শুনছেন সে ঘরে পড়া। নানান অসুখবিসুখ। মনে করতেছি সে বুঝি আইজ! জলদি যদি একটু --।
আচ্ছা চলুন।
সে থাউক না থাউক যদি একজন ডাক্তার --। জ্ঞান নাই তার। নাড়ি পাইনাই আইজ অনেক চেষ্টায়ও। দিশাহারা ছুইটা আসছি এই ধারে। যদি সে না থাকে, উ হু হু ---
তাহলে তো ডাক্তার ডেকে আনাই জরুরি। আমি গিয়ে দেখে আর কী করব? সময় নষ্ট হবে। তারচেয়ে ডাক্তার ডাকতে যাওয়াই ভালো, যাই।
আপনার অনেক মেহেরবানি।
যদি পাই ডাক্তার, আর এমন সময়ে আসতে চায়, যাই দেখা যাক। চেষ্টা তো জরুরি।
আমি যাই। সে বুঝি আইজ আর নাই। সে না থাকলে --। উ হু হু!
ভেজা কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে কুটিরের দিকে দ্রুত ছুটলেন তিনি । তার ফোঁপানো কান্নার সাথে অদূরের কুটির থেকে সঞ্চারিত ভয় পাওয়া সমবেত শিশু চিৎকার এসে মিশ্রিত হচ্ছিল মাঠের কনকনে হিমেল বাতাসে।
No comments:
Post a Comment