ইচ্ছেউড়ান (১ম পর্ব)
- সুদীপ কুমার চক্রবর্তী
একটা নদীর নামে খুঁজি অনিঃশেষ জলধারা
যাকে কেউ ডেকেছিল প্রথম প্লাবন।
নির্জনতার প্রকৃত স্বাদ ও সৌন্দর্য এই প্রথম প্রাণভরে আহরণ করতে পেরেছিল সমীরণ।
সন্ধ্যে হয়ে আসছিল - আজ কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। মেঠো রাস্তার দুদিকে দিগন্তবিস্তৃত শস্যক্ষেত - নৈঃশব্দ্য জটাধারী সন্ন্যাসীর মতো নির্বিকার ধ্যানে ওম মন্ত্র উচ্চারণ করছিল।রাস্তার পাশে ছোট ছোট ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝিঁ র ডাক ক্রমশ স্পষ্টতর হয়ে সৃষ্টি করছিল অন্য এক মোহময় জগৎ। বুনোফুলের গন্ধ আর শস্যামেদুর তার মধ্যে শোনা যাচ্ছিল সমীরণ এর পুরনো সাইকেলের ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ।
আজ সাইকেলে তার সামনের সহযাত্রী মৃত্তিকা।বেশ কিছুক্ষণ আগে দূরে মাইকে শোনা যাচ্ছিল - ও আকাশ সোনা সোনা - ও মাটি সবুজ সবুজ ।গানটা শুনতে শুনতে একেবারে খেই হারিয়ে ফেলেছিল সমীরণ।আসলে মৃত্তিকাকেকে নিয়ে এভাবে কখনো একা বের হতে পারবে এটা কল্পনা করাও ছিলো বেশ কঠিন। এ বছরই কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে সে আর মৃত্তিকা দশম শ্রেণী।
কোথায় স্বর্গদুয়ার - উন্মুক্ত আকাশ
কল্পনায় মিশে যায় রঙিন দিগন্ত
পুরুষ আর প্রকৃতির উষ্ণ নিঃশ্বাস।
সমীরণ এখন স্বর্গোদ্যানে র আদম এবং মৃত্তিকা ইভ।রাস্তার বাঁকে একটা মজা খালের উপর নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো।ভয়ে ভয়ে মৃত্তিকা বললো পার হওয়া যাবে কিভাবে এখন ! সমীরণ নিচের
দিকে তাকিয়ে দেখলো খাদটা সত্যিই বেশ গভীর - সাবধানে পার হতে হবে।তবে সমীরণ এখন যা স্ট্যামিনা এভারেস্ট জয় করাও খুব কঠিন নয়।
সমীরণ বললো দাঁড়া তোকে আগে পার করে দিই তারপর সাইকেল নিয়ে আমি একা পার হবো।দেরি না করে খপ করে মৃত্তিকার হাত্টা ধরে সমীরণ বললো ভয় করিস না আমাকে ধরে থাক।একটু ইতস্তত করে মৃত্তিকা সমীরণ কে শক্ত করে ধরে চলতে শুরু করল।মাঝপথে সমীরণ কে জড়িয়ে ধরলো মৃত্তিকা।মৃত্তিকার নরম পালকের মতো উদ্ভিন্ন যৌবনের স্পর্শে সমীরণ প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল তার পৌরুষ কে - যুগ যুগ ধরে যা আবহমান এক অনিবার্য সত্তা।
সুর যদি ছুঁয়ে যায় নরম হৃদয়
স্বরলিপি লিখে ফেলে প্রেমের অধ্যায়।
মৃত্তিকার বাবা চাকুরি সুত্রে কলকাতায় থাকে।সপ্তাহান্তে আসে - সংসার গুছিয়ে আবার চলে যায়।মৃত্তিকার মা সব কিছু দেখাশুনা করে।মৃত্তিকা গান শেখে।তার স্কুল - প্রাইভেট টিউশন সঙ্গীত চর্চা সবই ওর মায়ের উদ্যোগে।এই মুহূর্তে সমীরণ এর খুব মনে পড়ছিল।আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি .....। মনে মনে বেশ রোমাঞ্চ লাগছিল। সাঁকো টা পার হওয়ার পর সাইকেলে বসে সমীরণ মৃত্তিকা কে প্রায় টেনে তুলে বসালো সাইকেলে।তারপর যেতে যেতে আলতো করে মৃত্তিকার গালে মুখ ঠেকলো সমীরণ - বললো তোর ওই বিখ্যাত গানটা একটু গা তো -আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি .....। বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে মল্লিকা বললো ধ্যাৎ এই রাস্তায় আবার গান গাওয়া যায় নাকি ! এমনিতেই রাস্তার লোক জন সব কেমন হাঁ করে দেখছে । সমীরণ এসব কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো ধুর এরা আমাদের চেনে নাকি - নে নে শুরু কর । এখন গাইবি নাতো কখন গাইবি!
মৃত্তিকা হালকা স্বরে শুরু করলো।
সমীরণ বললো সত্যি তোর গানের গলা কি মিষ্টি ! ভালো করে পড়াশুনাটা কর - ভবিষ্যতে আমার বউ হিসাবে পরিচয় দিতে হবে তো!
মৃত্তিকা গান থামিয়ে বললো - তোমার সাহস বটে - এরই মধ্যে তুমি কত কিছু ভেবে ফেলেছ। ভুলে যাচ্ছ আমাকে লুকিয়ে চুরিয়ে এখানে এনেছ লক্ষ্মীপুজো দেখাবে বোলে।পড়া তে তো একটা লোক দেখলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে সাত হাত দূর দিয়ে পালাও।নেহাত তুমি জোরাজুরি করলে তাই মাকে জানাতে বাধ্য হলাম।দেখলে তো মা কি বললো - বললো না ওখানে আমাদের অনেক আত্মীয় বাড়ি অনেক চেনাশোনা লোক আছে।একবার দেখে ফেললে কি হবে বুঝতে পারছিস ? এখন খুব তো হওয়ায় উড়ছো এইসব রসালো গল্প একবার চাউর হলে কি হবে বুঝতে পারছ?
আমার বাবাই বলো আর তোমার বাবাই বলো ছেড়ে দেবে কি? আহা কি শখ ! বলছে পরে নাকি আমাকে বউ হিসাবে পরিচয় দিতে হবে!
এই খুনসুটি সমীরণ এর মন্দ লাগছিল না।সে আজ মুক্ত জীবনানন্দের ভেসে যাচ্ছে। সে আজ পৃথিবীর সবথেকে সমৃদ্ধশালী কেননা এই মুহূর্তে তার সঙ্গে আছে তার মৃত্তিকা।
এখানে ছড়িয়ে আছে আঁধার কুয়াশা
হেমন্তের স্নিগ্ধ ভালোবাসা। এসো
গন্তব্য পেরিয়ে আজ পা বাড়াই
অনন্তের কাছে।
দুপাশে সবুজ ধানের শীষের গন্ধ উড়ে আসছে হওয়ায়।এ গন্ধ তার অতি চেনা গন্ধ।খালের কালো জলে আলো আঁধারির ছায়া।পূর্ণিমার
চাঁদ ভেসে আছে।অনেক দূর পর্যন্ত কোন জনবসতি নেই।এটাকে বলে বোধকে র ভেরি।
এককালে এখানে হয়ত মাছ চাষ হতো।
এই নীল নির্জনে সাইকেলে আরও ঘন হয়ে বসলো সমীরণ।একহাতে জড়িয়ে ধরলো মৃত্তিকা কে।মৃত্তিকার মৃদু আপত্তি স্বত্বেও সমীরণ সাইকেল থামিয়ে দুহাতে জড়িয়ে দীর্ঘ চুম্বন করলো মৃত্তিকা কে। একটু দূরে কাদের টুকরো টুকরো কথা শোনা যাচ্ছিল।সমীরণ আবার সাইকেল চালাতে শুরু করে দিল।এবার গতিটা একটু বাড়িয়ে দিল।মৃত্তিকা চুপচাপ।সমীরণ একটু সংকোচ বোধ করলো।স্বাভাবিক করার জন্য অকারণ হেসে বললো - করে রাগ করলি নাকি? এতো চুপচাপ হয়ে গেলি যে !
মুখ ঘুরিয়ে মৃদু হেসে মৃত্তিকা বললো আমার কিন্তু বেশ ভয় করছে এখন কি করবো ঠিক ভেবে পাচ্ছি না।মাইকের হিন্দি গান ক্রমশ উচ্চ গ্রামে বেজে উঠছিল।পাড়ার ভেতর ওরা এখন একটা বড় প্যান্ডেলের কাছাকাছি।কতকগুলো ছেলে জটলা পাকিয়ে গানের তালে তালে নাচছিল।মেয়েরা পুজোর আয়োজন করছে।ঝলমল করছে আলো।ভিনদেশী ওদের দুজনকে জোড়ায় দেখে ছেলেগুলো দুচারটে টিকা টিপ্পনী কাটলো।বে পাড়ায় কোন ছেলের সঙ্গে মেয়ে বান্ধবীকে দেখলে এ এক ধরনের শালীনতার বহিঃপ্রকাশ।
পরপর বেশ কয়েকটি প্যান্ডেলে ঘুরল - মোটামুটি ছবিটা অল্পবিস্তর একই রকম।মৃত্তিকা বললো এই ক্ষুদিরাম তলায় আমার কনক পিসির বাড়ী ওখানে একটা বড়ো পুজো হয়।এই রাস্তাটায় বেশ লোকজন - বেশ একটা পূজো পূজো ভাব। কিছুটা হাঁটার পর চোখে পড়লো শহিদ ক্ষুদিরাম স্মৃতি সংঘ।সামনে বড় খোলা মাঠের একপাশে বিরাট প্যান্ডেল আর তার সামনে মেলার আয়োজন চোখে পড়ার মতো।
প্রচুর লোকসমাগম। সাইকেলটা এক জায়গায় রেখে মৃত্তিকার হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে ওর পছন্দের পুচকা আর ভেলপুরি খেলো।নাগর দোলার সামনে এসে দাঁড়ালো সমীরণ।তারপর বললো চল একটু নাগর দোলায় চড়া যাক।
মৃত্তিকা রে রে করে উঠলো।না বাবা আমার খুব ভয় করে।
আরে ধুর ! ভয় আবার কি তুই তো আমার পাশে বসবি।কোন আপত্তি না শুনে মৃত্তিকা দু খানা টিকিট কেটে মৃত্তিকার হাত ধরে চড়ে বসলো নাগর দোলায়।ওদের সামনের চেয়ার টা কিন্তু ফাঁকাই পড়ে রইলো।দুলতে শুরু করলো নাগর দোলা। আহা রে! কেজে নামটা দিয়েছিল নাগর দোলা। পাশে এরকম কেউ থাকলে সত্যিই নাগরদোলা।যত উপরে উঠতে থাকলো মৃত্তিকা চোখ বুজে চেপে ধরলো সমীরণ কে।আর সমীরণ ও এ সুযোগ হাতছাড়া করলো না।প্রায় মিনিট দশেক একটা ঘোরের মধ্যে কাটলো।শেষ হতেই সমীরণ বললো হোক না আরও একবার।মৃত্তিকা চুপ করে নামতে নামতে বললো না আমার খুব ভয় করে তাছাড়া বাড়ি ফিরতে হবে।
চারদিকে বিভিন্ন ধরনের দোকান পসরা বসেছে।পাশ দিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ এক মাঝবয়েসি ভদ্রমহিলা মৃত্তিকার হাত ধরে টেনে ধরলো।কি রে মিষ্টি নয় ! কার সঙ্গে এসেছিস?
মৃত্তিকার ডাকনাম মিষ্টি।কিছুটা থ্ত মত খেয়ে
মৃত্তিকা বললো এই যে সমীরণ দা আছে সঙ্গে।
সমীরণ দা এইযে আমার কনক পিসি ।
সমীরণ মহিলাকে বেশ খানিকক্ষণ নিরীক্ষণ করার পর মনে মনে ভাবলো এ মহিলা তার খুব চেনা।খুব ছোট বেলায় তাদের বাড়িতে একে দেখেছে।এখন চেহারার বেশ পরিবর্তন হয়েছে।মোটা হয়ে গেছে খুব।মহিলাও বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করছিল সমীরণ কে।
বেশ কর্কশ কণ্ঠে ঝাঁঝিয়ে উঠলো মহিলা - কে বাছা তুমি ?কোন পাড়ায় ? কাদের তুমি ?
সমীরণ বুঝতে পারছে দিদিমনি বেশ কড়া।
বেশ ভয়ের অবহেও সমীরণ সপ্রতিভ ভাবে উত্তর দিল আমি সমীরণ -বাউন পাড়ার চট্টুজ্জেদের। মহিলার পরের প্রশ্ন বাবার নাম কি? সমরেশ চট্টুজ্জে কে হয় তোমার?
বাবার নাম সতীনাথ চট্টুজ্জি। সমরেশ চট্টুজ্জে আমার ছোট কাকা। তোমার কাকা পোস্ট অফিসে চাকরি করে তো।কদমতলায় বিয়ে হয়েছে। তা ছেলেমেয়ে কজন? এতক্ষনে মহিলাকে মনে করতে পারলো সমীরণ।ছোটো কাকার সঙ্গেই কথা বলতে দেখেছে এই মহিলাকে।ছোটো কাকার ই তো বিয়ে হয়ে গেছে প্রায় ষোল সতেরো বছর আগে।একটু ধাতস্থ হয়ে সমীরণ উত্তর দিল হ্যাঁ ছোটো কাকার কদমতলায় বিয়ে হয়েছে। ছোটো কাকার দুটো ছেলে।
আমরা অনেক ঋণী সময়ের কাছে
সময় কি বিনিময়ে কিছু ছেয়েছে!
শুধু তার ক্ষতচিহ্ন আজও রয়ে গেছে।
এবারে কনক পিসি ওর দিকে ঘুরে বললো হ্যারে মিষ্টি তুই যে ওই ছোঁড়াটার সঙ্গে হুট করে চলে এলি তো দাদা তোকে এই রাতবিরেতে ওর সঙ্গে আসতে দিলো?মৃত্তিকার চোখে মুখে বেশ ভয় ফুটে উঠেছে মৃদুস্বরে বললো না মানে বাবা তো বাড়িতে নেই মাকে বলে এসেছি।
মহিলা খেঁকিয়ে উঠলো বাঃ! বৌদির তো বেশ পরিবর্তন হয়েছে। এখন চল আমাদের বাড়ি দুদিন থেকে যাবি । রবিবার তোর পিসেমশাই তোকে দিয়ে আসবে।আর ওই ছোঁড়া টাকে ফিরে যেতে বল।একথা শুনে সমীরণ এর বুকের ভিতরটা ছ্যাঁক করে উঠলো।মৃত্তিকা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল নাগো পিসি কাল সকাল থেকেই পড়তে যেতে হবে।তাছাড়া থাকার কথা তো মাকে বলে আসা হয় নি।
হাঁটতে হাঁটতে একটু ফাঁকায় এসে বেশ বাজখাঁই গলায় বলতে লাগলো ওই বাড়ির ছেলের সঙ্গে তোকে মিশতে দিল বৌদি! বৌদি তো সব জানে।
ওর সঙ্গে তুই যে মিশছিস ওর বাবা সতীনাথ মাস্টার তা জানে? কোনদিন বিয়ে দেবে ওর তোর সঙ্গে? এ আশা কখনও করিস না।তুই তো ছোট ওসব বুঝবি না।এখন বরং মন দিয়ে পড়াশুনাটা কর।জানিস ওর বাবা সতীনাথ মাস্টার আমার আর সমরেশদার সম্পর্কটা কোনদিন মেনে নেয় নি।আমার দাদা বৌদি সবাই রাজি ছিলো শুধু জাতের দোহাই দিয়ে ওই সতীনাথ মাস্টার আমাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে দিয়েছিল।আর সমরেশদা সবকিছু ভুলে গিয়ে দাদার কথা য় নাচতে নাচতে বিয়ে করতে চলে গেলো। এই হচ্ছে এদের চরিত্র।আর আবার তুই ও এদের ফাঁদে পা দিচ্ছিস।দেখিস না বিয়ের পর থেকে তোদের ওখানে আমি আর তেমন যাই নি।
এতক্ষনে সমীরণ এ মহিলার তার উপর এতো রাগের কারন বুঝতে পারলো। এবার ওই মহিলা সমীরণ এর দিকে ফিরে বললো - শোনো বাছা তুমি হলে সতীনাথ মাস্টার এর ছেলে সুযোগ বুঝে আবার আমাদের এই নিষ্পাপ মিষ্টিকে ফাঁসাতে চলেছ। তবে এটা আমি আর হতে দেবো না।তুমি বাছা ফিরে যাও আর ওর মাকে বলে যেও ওকে ওর পিসেমশাই রোববার দিয়ে আসবে।
সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে সমীরণ এর - চোখের সামনে কোজাগরী চাঁদ ঢুকে যাচ্ছে ধূসর মেঘের অন্ধকারে। তারপর মহিলা বললো এত দূর থেকে এসেছ তুমি বরং বাড়িতে এসে একটু মিষ্টি জল খেয়ে যাও।অগত্যা সমীরণ সাইকেল নিয়ে ওদের পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো।একটা পাকা বাড়ি তার লাগোয়া টিনের ছাউনি দেওয়া আরও কয় কটা ঘর।বাড়িটার কাছাকাছি এসে কনক পিসি সশব্দে হাঁক ছাড়ল পটাই এই পটা ই একবার এদিকে আয় তো - কমলের দোকান থেকে একটু মিষ্টি এনে দে তোর বাবা পরে দাম দিয়ে আসবে।একটা বছর বার তেরোর ছেলে নাচতে নাচতে ছুটে এলো - সামনে এসে হঠাৎ বলে বসলো এই মিষ্টি দি এটা কি তোর বর নাকি রে ! বলেই হাসতে হাসতে ছুট।মহিলা এবার গর্জন করে বলতে লাগলো আজকালকার ছেলেমেয়েরা কিরকম দেঁপো দেখেছো তো - আর হবে নাই বা কেন অমন ছেলের সঙ্গে রাতবিরেতে একা একা বের হলে সকলে তো এসব বলবেই।সমীরণ এর এসব শোনার আগ্রহ ছিলো না।ফেরার দুশ্চিন্তা তাকে তাড়া করছিল।ওদিকে মৃত্তিকাও দাঁড়ে শিকল বাঁধা পাখির মতো ছটপট করছিল।ঘরের ভিতর ধানের বস্তা মাছ ধরার জাল ইত্যাদি দেখে মনে হলো এরা বেশ অবস্থাসম্পন্ন চাষী ।দেওয়ালে টাঙানো একটা বড় ঘড়িতে নটা ছুঁই ছুঁই।ক্রমশ উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে যাচ্ছিল সমীরণ এর।পটাই মিষ্টি এনে ধপ করে বসে পড়ল সমীরণ এর পাশে।
আর কিছুই ভালো লাগছিলো না।কনক পিসি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সমীরণ বললো এখন কি হবে রে - কি করা যায়।মৃত্তিকা হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো। পটাই হাঁ করে দেখছিল এইসব।কনক পিসি আবার ঘরে ঢুকতেই পটাই বলে উঠলো ও মা মিষ্টিদিদি কাঁদছে কেন তুমি কি বকেছ? তারপর সমীরণ এর দিকে তাকিয়ে বললো তুমি কি সত্যিই মিষ্টি দিদির বর ? কনক পিসি বকা দিতেই পটাই ঘর ছেড়ে পালালো।দেখছিস তো তোদের এইসব দেখে এইটুকু টুকু ছেলেমেয়েরাও কিসব ভাবছে !
যাক বাছা তুমি তাড়াতাড়ি একটু মিষ্টি জল খেয়ে বাড়ি ফিরে যাও রাত বাড়ছে - এখুনি ওর পিসেমশাই ফিরে আসবে।এবার মৃত্তিকা সশব্দে কেঁদে উঠলো নাগো পিসি আমাকে ও ছেড়ে দাও আমিও সমীরণ দার সঙ্গে বাড়ি ফিরে যাবো। সমীরণ এই অবস্থায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কনক পিসিকে ঢিপ করে একটা প্রনাম করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল পিসি যদি মৃত্তিকা কে যদি ছেড়ে দাও আমরা একসঙ্গে বাড়ি ফিরতে পারি।
আচমকা সমীরণ এর এ হেন আচরণ দেখে কনক পিসি খুব অবাক হয়ে গেলো। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো তুমি সতীনাথ মাস্টার এর ছেলে আমাকে প্রনাম করলে ? তুমি কি জানো এধরনের অনেক ঘটনায় আমি সমরেশ দার জন্যে কত দুঃখ পেয়েছি ।কিন্তু তার ফল কি হোয়েছে ? তোমার বাবা কি আমাদের বিয়ে দিয়েছিল? যাক এখন আর এসব কথা বলতে চাই না। শুধু বলতে চাই তোমার আর মিষ্টির এই সম্পর্কটা কি তোমার বাবা কখনও মেনে নেবে ?
মেনে না নিলে তখন তুমি কি করবে ? সমরেশ দার মতো তুমিও বিয়ে করে ফেলবে আর মিষ্টটা সারা জীবন আমার মতো শুধুই কষ্ট পাবে।এর কোন উত্তর সমীরণ এর জানা নেই।মাথা হেঁট করে চুপচাপ শুনছিল।চোখ গুলো ছলছল করে টসটস করে জল গড়িয়ে পড়ল।কনক পিসি এসব দেখে খুব আবেগ বিহ্বল হয়ে বললো একি তুমি কাঁদছো নাকি? এতো বড়ো ছেলে কাঁদেনা। আচ্ছা ঠিক আছে তোমাদের আমি একটা সুযোগ দিলাম তুমি মিষ্টিকে নিয়ে যাও ভবিষ্যতে তোমার মতো করে গড়ে নাও তবে কখনও ঠকিও না। কথা রেখো। মনে রেখো বিশ্বাস আর নিঃশ্বাস একবার ভেঙ্গে গেলে আর কখনও ফিরে পাওয়া যায় না।ভবিষ্যতে তোমাদের একসঙ্গে দেখে আমি আমার ভিতরের জ্বালা টা জুড়াতে চাই।মিষ্টিকে চুমু খেল কনক পিসি।সমীরণ এর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো বাবা সাবধানে যাও - মিষ্টিকে কখনও কষ্ট দিও না। সমীরণ আর নিজেকে সামলাতে পারছিল না। স্নেহ - বাৎসল্য - মায়া - মমতা জীবনের সবকিছু হিসেব নিকেশকে ওলোট পালোট করে দিতে পারে।সমীরণ আবারও প্রণাম করল কনক পিসিকে।এবার পিসি চুমু খেয়ে বললো যা বাবা সব সাবধানে যা।ওরে পটাই গদাই কে নিয়ে ওদের একটু এগিয়ে দিয়ে আয়।এতক্ষনে হাসি ফুটলো সমীরণ এর মুখে।সমীরণ এর তো কনকপিসির কাছে কৃতজ্ঞতা র শেষ নেই। বুঝলো এটা হলো কনকপিসি র একটা অপূর্ণতার অভিমান।যাইহোক কনক পিসিকে বিদায় জানিয়ে এবার ওরা রওনা হলো বাড়ির দিকে।পটাইটা ইঁচড়ে পাকা যেতে যেতে সমীরণ কে বললো তুমি কি মিষ্টিদিদিকে বিয়ে করে ফেলেছ? সমীরণ মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো না রে এখনও বিয়ে করিনি তবে বিয়ের সময় তোকে অনেক আগে থেকে নিমন্ত্রণ করবো।মৃত্তিকা কপট রাগ দেখিয়ে বললো গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল - এখন আগে বাড়ি ফেরার চিন্তা করো। কিছুটা যাওয়ার পর মাইকের ছেঁচামেচি হই হট্টগোল সব থেমে গেলো। আবার সেই বোধকে র ভেরী। সমীরণ বললো যাও পটাই এবার তোমরা ফিরে যাও আমরা চলে যাবো।পকেট থেকে দু টাকার একটা নোট বের করে পটাই এর হাতে দিল।আবার সাইকেলে মৃত্তিকা কে চড়িয়ে চললো বাড়ির দিকে।অনেকটা রাত্রি হয়ে গেছে।প্রায় দশ কিমি পথ এখনও যেতে হবে। চাঁদের আলো আঁধারিতে এ এক অন্য পৃথিবী।কিছুদিন আগে সমীরণ একটা সিনেমা দেখছিল নদিয়া কে পার । সেখানে নায়ক নায়িকার এক রাস্তা অতিক্রমের দৃশ্য এখনো গেঁথে আছে তার মনে। একটা অসাধারণ গান আছে সেই দৃশ্যে।পাশে ভালোবাসার লোক থাকলে এ গানের মানে ই আলাদা হলে যায়। সমীরণ বললো শোন একটা হিন্দি গান শোন - বলেই আরম্ভ করলো - বড়ে আচ্ছে লোগতে হ্যায় - ইয়ে ধরতি ইয়ে নদিয়া ইয়ে ...... ওর তুম।
একহাতে সাইকেল আর অন্য হাতে মৃত্তিকা । না মৃত্তিকা এবারে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিচ্ছে সমীরণ কে।
এদিকে আবার সেই মজা খাল ভাঙ্গা সাঁকো - জ্যোৎসনা য় ফিন ফুটে আছে।সামগ্রিক নির্জনতায় এ এক অধি ভৌতিক পরিবেশ।
এবারে একেবারে সাইকেল ওপারে রেখে কোলে তুলে মৃত্তিকা কে পার করলো সমীরণ।মৃত্তিকা ভয়ে ভয়ে বললো তাড়াতাড়ি চলো রাস্তাটা একেবারে নির্জন।সাইকেলের গতি বাড়িয়ে দিলো সমীরণ।কতকগুলো মাতালের অসংলগ্ন কথা বার্তা কানে আসছিল। সামনের শশ্মানে সব দাহ করে ফিরছিল সব।ওদের সাইকেলে দেখে হৈ হৈ করে নানান মন্তব্য করে উঠলো।সমীরণ আরও জোরে প্রায় হওয়ার বেগে চালাচ্ছিল সাইকেল। গাজীপুর হাট তলায় যখন এলো একটা লোক চা এর দোকান বন্ধ করছিল।সমীরণ তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো রাত প্রায় পৌণে বারো।আরও দু কিমি পথ । দূরে তখনও মাইক অমায়িক।শোনা যাচ্ছে এই রাত তোমার আমার।কি রোমান্টিক গান - আহা!
মৃত্তিকার বাড়ির সামনে সাইকেল রেখে গেট পেরিয়ে ওর হাত ধরে ঢুকলো প্রাচীরের ভিতরে সমীরণ। অন্ধকারে বুকে চেপে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল।আজকের এই রাত তোর মনে থাকবে! এবার মৃত্তিকা দুহাতে সমীরণ এর মুখ নামিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো আজকের এই দিনটা মরার আগে পর্যন্ত মনে থাকবে। তারপর সমীরণ দরজায় বার কয়েক নক করলো। একটা আলো জ্বলে উঠলো। ওর মা বেরিয়ে এলো। এতো দেরী করলি। আমার খুব চিন্তা হচ্ছিলো। যাও সমীরণ সাবধানে যাও। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। যেন স্বর্গীয় একটা রাত নিভে গেলো। এবার সাইকেল নিয়ে সমীরণ ফিরে চললো বাড়ির অভিমুখে।এই সুখস্বপ্ন তাকে আজ ভরিয়ে দিয়েছে তার জীবন।মাইকে ভেসে আসছে - যে রাতে মোর দুয়ার খানি ভাঙলো ঝড়ে।
বাড়ির একেবারে কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেল বাবার ঘরে তখনও আলো জ্বলছে। বুকের ভেতর একটা হিম তরঙ্গ বয়ে গেল।মনের মধ্যে উকি মারলো ডেভিড কপার ফিল্ডের সেই ভয়ঙ্কর গুরুগম্ভীর নিষ্ঠুর চরিত্র মিকোবারকে।
No comments:
Post a Comment